চট্টগ্রামের ফুসফুস খ্যাত নগরীর সিআরবির মতো সংরক্ষিত এলাকায় এবার মাসব্যাপী শুরু হচ্ছে বাণিজ্যিক মেলার আদলে জামদানি মেলা। সিআরবির শিরীষতলার পুরো মাঠ টিনের ঘেরাও দিয়ে মাঠের ভেতরে ছোট–বড় অনেকগুলো স্টল নির্মাণ করা হয়েছে। মাঠে বিছানো হয়েছে ইট। উপরে দেয়া হয়েছে ত্রিপল। মাসব্যাপী দেশীয় পণ্য ও জামদানি মেলার নামে এ আয়োজন আজ থেকে শুরু হচ্ছে। গতকাল সিআরবি শিরীষতলায় গিয়ে একাধিক স্টল মালিক এবং মেলা আয়োজনের সাথে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৬৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। মেলার জন্য টিনের ঘেরা দিয়ে মাঠ জুড়ে স্টল, মাসব্যাপী উচ্চস্বরে মাইকে পণ্যের পাবলিসিটিতে পরিবেশ প্রতিবেশের ক্ষতির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংস্কৃতি কর্মী ও পরিবেশবিদরা।
সিআররির মতো শত বছরের সবুজ প্রকৃতির নির্জন এলাকায় মাসব্যাপী মেলার অনুমতি দেয়ায় পরিবেশবিদ ও সংস্কৃতি কর্মীরা রেলওয়ের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাইফুল আলম বাবু বলেন, সিআরবি সবুজ প্রকৃতি ঘেরা সংস্কৃতিময় এলাকায়। এমন একটি সংরক্ষিত এলাকায় মাসব্যাপী বাণিজ্যিক মেলা দেয়ার আগে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিত ছিল। সিআরবি শিরীষতলায় এর আগে কখনোই মেলা (অর্থের বিনিময়ে স্টল বরাদ্দ দিয়ে) অনুষ্ঠিত হয়নি। সিআরবিতো মেলার জায়গা না। সিআরবিকে কেন্দ্র করে প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে সংস্কৃতির একটি বলয় তৈরি হয়েছে। এখন এটিকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে মেতেছে একটি চক্র। মেলার জন্য অনেকেই চাইবে–তাই বলে সিআরবির মতো জায়গায় মেলার জন্য মাঠ ভাড়া দিতে হবে ? এটা রেল কর্তৃপক্ষের ভাবা উচিত ছিল।
সিআরবির শত বছরের এই সবুজ প্রকৃতির মাঝে চট্টগ্রামবাসী পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে থাকে। এছাড়াও বসন্ত উৎসবসহ বেশকিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে কখনো পণ্য মেলা হয়নি। একবার যদি মেলা শুরু হয় তাহলে এরকম বারবার মেলার আসর বসতে থাকবে এবং পরিবেশের বিপর্যয় ঘটবে বলেও আশংকা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ শরীফ চৌহান। তিনি বলেন, সিআরবি চট্টগ্রামবাসীর বুক ভরে শ্বাস নেয়ার একটি জায়গা। এই সিআরবি ছাড়া এই যান্ত্রিক ও কোলাহলপূর্ণ শহরে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষের নিঃশ্বাস ফেলার মত জায়গার খুবই অভাব। শতবর্ষী বৃক্ষেঘেরা পাহাড়, টিলায় ঘেরা সিআরবি এলাকাটি চট্টগ্রামের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্রও। চট্টগ্রামের মানুষ এ এলাকাটিকে নগরীর ফুসফুস বলে। অথচ এরকম একটি সংরক্ষিত এলাকাকে ঘিরে একটি লুটেরা শ্রেণি মাসব্যাপী মেলার নামে বাণিজ্যে নেমেছে। এখানে মাসব্যাপী মেলার নামে মাইকে উচ্চস্বরে পণ্যের পাবলিসিটির জন্য অনেকগুলো মাইক লাগানো হয়েছে। এর ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
সরেজমিনে গতকাল মাসব্যাপী জামদানি মেলার জন্য ঘেরাও দেয়া সিআরবি মাঠে গিয়ে দেখা গেছে, মেলার প্রবেশ পথে বাণিজ্য মেলার আদলে নির্মাণ করা হয়েছে সুউচ্চ–সুদৃশ্য গেট। গেট দিয়ে প্রবেশমুখে দেখা গেল প্রায় ৩শ’ বর্গফুটের বিশাল এলাকা জুড়ে শতাধিক মুখরোচক আচার, চনামনার ঠ্যাং, গজা–মুরালি নিয়ে বসেছে ঢাকার গঙ্গাপুর নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা বিসমিল্লাহ ড্রাই ফুডস। স্টলে দেখা হল প্রতিষ্ঠানের মালিক মোহাম্মদ রফিকের সাথে। মেলার নানান বিষয় নিয়ে (মেলা কয় দিন থাকবে ? স্টল ভাড়া কত?, এখানে আসার জন্য কে যোগাযোগ করেছে) তার সাথে কথা হলে মোহাম্মদ রফিক আজাদীকে বলেন, মেলার আয়োজক কমিটির প্রধান হলেন এ মাজেদ সর্দ্দার। উনার সাথে মিজান মোল্লা, রায়হান, রাশেদ, শামীমসহ অনেকেই আছেন। কিন্তু আমাদের সাথে যোগাযোগ করে রায়হান উদ্দিন নামে আয়োজক কমিটির এক ব্যক্তি। রায়হান সব দোকানদারদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ভাড়া নির্ধারণ করেন। আমার সাথে কন্ট্রাক্ট হয়েছে পুরো মেলা জুড়ে আমার এই আইটেমের দোকান আর থাকতে পারবে না। শুধু আমারটাই থাকবে। এই জন্য এক মাসে আমার স্টল ভাড়া ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। অন্যগুলো ৬৫ হাজার টাকা করে। এখানে মোট ৭০টি স্টল হয়েছে। মেলা ১০ তারিখ থেকে শুরু হবে আগামী মাসের (অক্টোবরের) ১০ তারিখ পর্যন্ত থাকবে।
মেলায় বসা স্টলের বেশ কয়েকজন মালিকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত মেলা চলবে বলে তাদেরকে এখানে আনা হয়েছে। ভাড়াও সেইভাবে হয়েছে। মেলা শুক্রবার (আজ) উদ্বোধন হওয়ার কথা থাকলেও গতকাল বিকেলে তাদেরকে জানানো হয়েছে উদ্বোধনের তারিখ পিছিয়ে ১০ সেপ্টেম্বর করা হয়েছে। আজ শুক্রবার দোয়া পড়িয়ে মেলা শুরু করা হবে।
মেলার মাঠে পাওয়া যায় মেলা আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য রায়হান উদ্দিনকে। রায়হান উদ্দিন মেলার মূল আয়োজক এ মাজেদ সর্দ্দারের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। তিনি মেলার সব দোকানদারদের সাথে যোগাযোগ করে ভাড়া নির্ধারণ করেন এবং ভাড়া আদায় করেন। মেলায় সিরামিকের তার একটি বড় স্টল রয়েছে। মেলার মাঠের মাঝখানে সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গায় তার স্টলটি। রায়হান উদ্দিন আজাদীকে বলেন, মেলার মূল আয়োজক এ মাজেদ সর্দ্দার। তিনি চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এরকম মেলার আয়োজন করে থাকেন। চট্টগ্রামের সবাই তাকে চেনেন। এই মেলার সাথে এখানকার অনেকেই আছেন। আমাদের সব আয়োজন শেষ। স্টল বরাদ্দ হয়ে গেছে। এখন মেলা শুরু হবে।
সিআরবির মাঠে মেলার আয়োজনের অনুমতি দেয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন আজাদীকে বলেন, ‘সিআরবিতে জামদানি মেলা করার জন্য ঢাকা থেকে একজন লোক এসেছিলেন। আমাদের কাছে আবেদন করেছেন। আমি ১৫ দিনের অনুমতি দিয়েছি। তবে কোনো ভাড়ার বিনিময়ে নয়। আমরা সিআরবি মাঠ ব্যবহারের জন্য এখনো পর্যন্ত ভাড়া নিইনি কারো কাছ থেকে। এখন আমরা ভাড়া নির্ধারণ করবো। ওই ব্যক্তি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জামদানি শাড়ি দেয়ার বেশ কিছু ছবি আমাকে দেখিয়েছেন। এজন্য আমি তাকে মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছি। দেশীয় জামদানি শাড়ির প্রসারের ব্যাপারে। এখন মেলায় প্রতিটি স্টল থেকে এতো টাকা ভাড়া নিচ্ছে সেটা আমি জানতাম না। বিষয়টি আমি দেখবো।’
সিআরবির মতো সংরক্ষিত এলাকায় মাসব্যাপী জামদানি মেলার নামে বাণিজ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে এ মেলা আয়োজক কমিটির প্রধান এ মাজেদ সর্দ্দার আজাদীকে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগ করি, সব মন্ত্রী আমাকে আদর করেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আমি ডেমরা থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি।’ মাজেদ সর্দ্দার নিজেকে ডেমরা থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি পরিচয় দিলেও অনলাইনে ডেমরা থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি বের করে সেখানে দেখা যায় এ মাজেদ সর্দ্দার ডেমরা থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের সহ সভাপতি। চলতি বছরের গত ২৭ মে জাতীয় শ্রমিক লীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি এবিএম শফিউল আলম বুলু এবং সাধারণ সম্পাদক মো. ইব্রাহিম স্বাক্ষরিত ৩৫ সদস্য বিশিষ্ট ডেমরা থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে তাতে এ মাজেদ সর্দ্দারকে সহ সভাপতি। কমিটির সভাপতির তালিকায় নাম রয়েছে মো. কামাল হোসেন তারেক এবং সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম। কার্যকরী সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা।
এ মাজেদ সর্দ্দার নিজেকে দলের অনেক ত্যাগী নেতা উল্লেখ করে বলেন, দলের আমার ত্যাগ না থাকলে মন্ত্রী মহোদয় কি আমার জন্য জিএমকে ফোন করতো ? আমি সারাদেশে মেলা করি। প্রশাসনের সবাই আমাকে সহযোগিতা করেন। মেলার অনুমতি কয়দিনের জন্য নিয়েছেন জানতে চাইলে এ মাজেদ সর্দ্দার বলেন, মেলা ৪৫ দিন চলবে। রেলওয়ে প্রথমে ১৫ দিনের অনুমতি দিয়েছে। এই ১৫ দিন শেষ হলে আবার ১৫ দিনের অনুমতি দিবে। এই ১৫দিন শেষ হলে আবার ১৫ দিনের জন্য দিবে। রেলওয়ে এক সাথে ১ মাসের জন্য অনুমতি দিতে পারে না। ১৫দিন করে নিতে হয়। এটা নিয়ম। মেলা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম সাহেব উদ্বোধন করবেন। তিনি ঢাকায় থাকার কারণে ১০ তারিখ মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হবে। শুক্রবার (আজ) দোয়া পড়িয়ে মেলা শুরু করবো। রেলওয়ে থেকে ফ্রি মাঠ নিয়ে প্রতি দোকান থেকে ৬৫ হাজার টাকা নিয়ে বিশাল বাণিজ্য করছেন (৭০টি দোকান থেকে ৬৫ হাজার টাকা করে ৪৫ লাখ ৫০ হাজার, মেলার প্রবেশ মুখে বিসমিল্লা ড্রাই ফুডস স্টল থেকে ১ লাখ ৮০ হাজারসহ এক মাসের মেলায় ৪৭ টাকা ৩০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে) এমন প্রশ্নের জবাবে মাজেদ সর্দ্দার বলেন, মেলা আয়োজনে অনেক খরচ। এই খরচের টাকা আমরা স্টল থেকে নিই। এখানে বাণিজ্যের কিছু নেই ভাই। প্রথমে ৭০টি স্টল করার কথা ছিল। পরবর্তীতে জিএম সাহেব বলেছেন, মাঠের মাঝখানে খোলা জায়গা রাখতে হবে। এই কারণে আমরা পুরো মাঠে ৩৫টি স্টল করেছি। আমার ম্যানেজার রায়হার উদ্দিনের সাথে আপনি যোগাযোগ করলে সব জানবেন। এখনো স্টল নির্মাণের কাজ চলছে। প্রতি স্টল থেকে ৩৫ হাজার টাকা করে নিচ্ছি। আমাদেরকে জিএম সাহেব বলেছেন তাদের মাঠে যেখানে গর্ত আছে সেগুলো বালি দিয়ে ভরাট করে দেয়ার জন্য। আমি ৩০ গাড়ি বালি দিয়ে মাঠ ভরাট করেছি। সেখানে কতটাকা টাকা খবর হয়েছে দেখেন? পুরো মাঠে ইট বিছিয়েছি। ইটগুলো ভাড়ায় এনেছি, সেখানে কত টাকা খরচ হয়েছে দেখেন? মেলা শেষ হলে যাদের থেকে এনেছি–তারা নিয়ে যাবে। তাছাড়া মাসব্যাপী বিদ্যুৎ বিল আসবে ৪ লাখের মতো। পুরো মাঠ টিন দিয়ে ঘেরাও দেয়া হয়েছে। ত্রিপল দিয়ে ছাউনি দেয়া হয়েছে। এখানে খরচ হয়েছে ৭ লাখের মতো। রেলওয়েকে দিতে হবে। এরপর আর কি টাকা থাকে আপনিই বলেন? সিআরবি তো সংরক্ষিত এলাকা, এই সবুজ প্রকৃতির মাঝে চট্টগ্রামবাসী বুক ভরে শ্বাস নেয়, বিকালে এবং সন্ধ্যায় লোকজন ঘুরতে আসেন, এখানে শুধু পহেলা বৈশাখ আর বসন্ত উৎসব হয়। এখানে তো কোনো মেলা হয় না, আপনি এখানে মেলা করতে আসলেন কেন? এর জবাবে মাজেদ সর্দ্দার বলেন, ভাই আমি মেলার পাশাপাশি সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করছি। এটার পর আর এখানে মেলা করবো না।