‘জলাবদ্ধতা’ এই নামের সঙ্গে আমি আগে তেমন পরিচিত ছিলাম না। যত সময় গড়াচ্ছে ততই এই শব্দটার সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি। শুধু জড়িয়ে যাচ্ছি বললে ভুল হবে জড়ানো হচ্ছে বা ভুক্তভোগী করে তোলা হচ্ছে।
একটা সময়ে চট্টগ্রামকে প্রাচ্যের রানির সঙ্গে তুলনা করা হতো। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে এই নগরী গড়ে উঠেছে। দুইপাশে পাহাড় আর মাঝখানে রাস্তা। ছোট ছোট পাহাড়ের কোল ঘেঁষেই বাড়িঘর।
আমার সেই ছোটবেলায় দেখা চট্টগ্রামের সেই নগরী আর নেই। এখনও মনে পড়ে ‘আপন নিবাস’ যখন বানানো হচ্ছে তখন অনেকে দেখতে যেতো সুউচ্চ দালান বানানো হচ্ছে বলে। সে দালানও একটা নিদিষ্ট তলা পর্যন্ত বানানোর পারমিশন পেয়েছিলো। অথচ এখন অলিগলিতেও এর চেয়ে বড় বড় দালান বানানো হয়েছে, হচ্ছে। কোথাও পানি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবস্থা তো দূরে থাক, পাহাড় কেটে, নালা, পুকুর ভরাট করেই দালান বানানো হচ্ছে। আমি যে এলাকায় থাকি তার পাশেই রাজাপুকুর লেইন। কয়েক বছর আগেও এখানে পুকুর দেখতে না পেলেও বড় খালের মতো ছিলো। এতো বাড়ি বানানোর ফলে এই খাল বা নালার অবশিষ্টাংশও এখন নেই। সে–রকম মাস্টারপুলে ওঠার আগে বড় নালা ছিলো। সেটাও বিলুপ্ত। বিশাল চাক্তাই খাল বলুয়ার দীঘি শ্মশানের পাশ ঘেঁষে ছিলো। আবর্জনার স্তুপের কারণে খালগুলো ভরাট হয়েছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পানি নিষ্কাশনের। অল্প বৃষ্টিতে রাস্তা আর খাল এক হয়ে যায়। দুর্ঘটনায় অনেকের মৃত্যু কারণ এই খালও।
জিইসির মোড়ে, গোলপাহাড় এলাকায় কখনও পানি উপচে পড়বে কেউ ভেবেছেন বলে মনে হয় না। অথচ সেসব এলাকায় কোমর সমান পানি জমে যায় অল্প বৃষ্টিতেও। বড় বড় নালা, খাল ভরাট করে সে জায়গায় বহুতল ভবন বানানো হয়েছে। এইসব ভবন, পাহাড় কাটা, নালা, পুকুর দেখাশোনার দায়িত্বে যারা আছেন তারা কোথায় থাকেন, যখন তাদের নাকের ডগার ওপর এইসব ভরাট করে বহুতল ভবন বানানো হয়? পত্রিকায় না লেখা পর্যন্ত কারো টনক নড়ে না।
ঠিক তেমনিভাবে জলাবদ্ধতার কারণে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত হুঁশ আসে না প্রশাসনের। কয়েকজন মারা যাওয়ার পর তত্ত্বাবধানে যারা থাকেন নড়াচড়া দিয়ে ওঠেন।
একটা পত্রিকায় প্রকাশিত হলো ৬ হাজার কোটি টাকা খরচের পরও কেন জলাবদ্ধতা?
নতুন নতুন এলাকায় জলবদ্ধতার তীব্রতা বেড়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে প্রকল্পের পর প্রকল্পের কাজ করেও এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। আবার সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সিডিএ’র বিরোধ লেগেই আছে। একে অপরকে দোষারোপ করেই যাচ্ছে বছরের পর বছর। অন্যদিকে মিটিংয়ের পর মিটিং করেই যাচ্ছে মীমাংসার কোনো লক্ষণই দেখা মিলছে না। মেয়র আর সিডিএ’র কাজ কি শুধু মিটিং করা?
নগরবাসীর কষ্ট এদেরকে ছুঁতে পারছে না। আর কত প্রাণ গেলে ওনাদের একসাথে বসে নগরের এই দূরাবস্থা দূর করে নগরের সৌন্দর্যবর্ধন, খাল, নালা পরিষ্কার করে পানি চলাচলের পথে বাধা সৃষ্টি হবে না, তা জানতে চাই। দীর্ঘমেয়াদী জলবদ্ধতার প্রধান কারণ অপরিকল্পিত নগরায়ণ।আগে পরিকল্পিতভাবে নগরকে রক্ষা করতে হবে। যত্রতত্র বাড়ি–ঘর, দোকানপাট বানানো বন্ধ করতে হবে। অবৈধ এইসব বন্ধ করার মতো সাহস থাকতে হবে যারা এসব পদে বহাল আছেন। এই নগর তো ওনাদেরও, নিজের বাড়িই ভাবতে হবে এই শহরকে। আমাদের এই শহরকে বাঁচানোর জন্য সবাই মিলে পরিকল্পনা করে একসাথে কাজ করতে হবে। জনগণকে সচেতন করুন আবর্জনা নিদিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য। প্রয়োজনে সিসিটিভি লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে যেসব এলাকায় এমন আবর্জনা স্তুপ করে রাখে। পুলিশের সহযোগিতায় নিরাপদ শহর গড়ে তুলতে হবে। নালা নর্দমা পরিস্কার রাখুন। চসিকের কাজ হলো এইসব পরিচ্ছন্নতার জন্য বেশি লোকবল নিয়োগ করা। অথচ প্রায় সময়ে শোনা যায় লোকবল কম। আর কোন মায়ের সন্তান, কারো বাবা, মা বৃষ্টির জলে যেন পিচলে পড়ে মৃত্যু না হয়। এখনও এমন আছেন বাবা নালায় পড়ে যাবার পরও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সে জানে না বাবার কবর কোথাই। যে সন্তান খেলার ছলে ডুবে মরে সে মায়ের আহাজারির যেন আর শুনতে না হয়।
পাহাড়ধসে যেন আর কারো মৃত্যু না হয়। পাহাড় কেটে আর একটাও বাড়ি যেন না বানায়। যারা জড়িত এইসবে তাদের যাবজ্জীবন শাস্তি হওয়া দরকার। ১৬ বছরে অনেক মামলা হলেও, শাস্তি হয়েছে কারও নজির নেই।
জলবদ্ধতা বলুন, পাহাড়ধস বলুন, কিংবা বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কথা বলুন, এসবের জন্য আমরাই দায়ী। নিজেদের লোভের কারণে, দায়িত্বহীনতার কারণে আমাদের এই পরিণতি। এসব সমস্যা থেকে মুক্তির পথ বের করে সুন্দর নগরী গড়ে তুলতে হলে আন্তরিক ও সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে।











