হংকং যাত্রার টিকেটে চোখ বুলিয়ে মাথায় যেনো বাজ পড়লো। বিদঘুটে টাইমিং। ভোর ছয়টায় ফ্লাইট, ঢাকা থেকে। মানে রাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে হবে। এত ভোরে এয়ারপোর্টে পৌঁছানো একটি কঠিন ব্যাপার। তাও আবার ঢাকায়! চট্টগ্রামের মানুষের জন্য ঢাকা এমনিতেই অনেক দূর! নিশুতি রাতে তো এই দূরত্ব অনেক। ঢাকা শহরে আত্মীয়–স্বজন প্রচুর। গাড়িরও অভাব নেই। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে নিশুতি রাত। এতো রাতে কারো বাসা থেকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য গাড়ি নিতে লজ্জা শুধু চোখে নয়, বুকেও লাগে। আত্মীয়দের কারো ড্রাইভারই বাসায় থাকে না। বেশ দূরেই নিজের বাসায় থাকে। তারা সকালে এসে দিনভর ডিউটি করে রাতে ফিরে যায়। কিন্তু আমাকে যদি এয়ারপোর্টে লিফট দিতে হয় তাহলে ড্রাইভারকে থেকে যেতে হবে, তার ঘুমানোর জায়গা নেই। অথবা তার বাসা থেকে এসে আমাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে আবার বাসায় ফিরতে কিংবা বাকি রাত নির্ঘুম কাটাতে হবে। এসব ভাবা যত সহজ, করা ঢের কঠিন। দিনভর ডিউটি করা একজন ড্রাইভারের জন্য ব্যাপারটি ভয়াবহ রকমের কষ্টের। কাউকে এতো কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না। উবার নিয়ে চলে যাওয়া যায়। কিন্তু নিরাপত্তার ব্যাপারটিকেও খাটো করে দেখা যায় না।
চট্টগ্রাম থেকে পূর্বমুখী কোন ফ্লাইট না থাকায় আমাকে এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির কবলে পড়তে হলো। আহা, কী সুন্দর আয়োজনই না ছিল! থাই এয়ার চট্টগ্রাম থেকে বহুদিন ফ্লাইট অপারেট করতো। তখন মাত্র ঘন্টা কয়েকের ট্রানজিটে ইউরোপ আমেরিকাসহ বিশ্বের যে কোন দেশে চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাই করা সম্ভব হতো। শুধু থাইল্যান্ডই নয়, চীন জাপান কোরিয়া হংকং ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়াও বাড়ির পাশের শহর হয়ে উঠেছিল। সিংগাপুর এয়ারলাইন্স, সিল্ক এয়ার, ফুকেট এয়ারসহ বিভিন্ন ফ্লাইট অপারেটর চিটাগাং থেকে ফ্লাইট অপারেটর করেছিল। চট্টগ্রামের মানুষের জন্য এসব ফ্লাইট যে কত বড় আশীর্বাদ ছিল তা আজ চরম এক অনিশ্চয়তায় দাঁড়িয়ে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে যদি পূর্বমুখী যাত্রা করতে পারতাম তাহলে নিশুতি রাত নিয়ে এই যে অনিশ্চয়তা তা দেখা দিতো না। আমাকেও এত কষ্ট করে ভোররাতে ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছার যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না। চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাই করে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কিংবা সিংগাপুর হয়ে আমি অনায়াসে হংকং চলে যেতে পারতাম। শুধু থাই এয়ারকেও যদি টিকিয়ে রাখা যেতো তাহলেও চট্টগ্রামের মানুষের বহু কষ্টের অবসান হতো। চট্টগ্রাম থেকে ব্যাংকক অতঃপর খুলে যেতো বিশ্বের দুয়ার!
কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। হংকং যেতে হলে আমাকে নিশি রাতে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কড়া নাড়তেই হবে। তাও আবার রাত ৩ টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যেই।
কিছুটা অস্থিরতার মধ্যে সময় পার করছিলাম। রাতে গিয়ে কারো বাসায় উঠে রাত ৩টার সময় এয়ারপোর্টে পৌঁছার কষ্টের ব্যাপারটি অনুধাবন করার চেষ্টা করছিলাম। আমার অনিশ্চয়তার কথা শুনে ঘনিষ্ট একজন বন্ধু চমৎকার একটি পরামর্শ দিলেন। বললেন, কারো বাসায় না উঠে এয়ারপোর্টের কাছে একটি হোটেলে উঠে যান। ওরা এয়ারপোর্টে আপনাকে ড্রপ করে দেবে। এই সার্ভিস তারা দেয়। কথাটি বেশ মনে ধরলো আমার।
ওই বন্ধুই ফোন নম্বর যোগাড় করে দিলেন। আমি একটি হোটেলে রুম বুকিং দিলাম। কথা ফাইন্যাল করে নিলাম যে, আমাকে রাতে এয়ারপোর্ট থেকে তুলে নিতে হবে আবার রাত সাড়ে ৩টায় এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিতে হবে। তারা বললেন, কোন সমস্যা নেই। এয়ারপোর্ট ‘ড্রপ এন্ড পিকআপ’ আমাদের সার্ভিসের মধ্যে পড়ে। বেশ ভালো অংকের বাড়তি টাকা খরচ হলেও বুকের উপর থেকে কিছুটা বোঝা নেমে গেলো। চট্টগ্রাম থেকে ফ্লাই করার সুযোগ থাকলে অনেকগুলো টাকা আমার সাশ্রয় হতো। শুধু হোটেল ভাড়াই নয়, চট্টগ্রাম–ঢাকা বিমানের খরচটাও তো কম নয়। চট্টগ্রাম থেকে পশ্চিমে গিয়ে আবার চট্টগ্রামের উপর দিয়ে পূর্বে যাওয়ার কষ্টের সাথে বাড়তি খরচের কষ্ট বেশ হতাশা সৃষ্টি করে। অথচ বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে পূর্বমুখী একাধিক ফ্লাইট অনায়াসে চলাচলের সুযোগ রয়েছে। আমাদের নানামুখী ব্যর্থতার কারনে বিভিন্ন ফ্লাইট অপারেটর এসেও টিকতে পারেনি, ব্যবসা গুটিয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।
নির্দিষ্ট দিনে রাত সোয়া ৮টার ফ্লাইটে আমি ঢাকা পৌঁছালাম। ডোমেস্টিক এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে দেখি আমার জন্য হোটেলের ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। বেশ বড়সড় একটি মাইক্রোবাস। যাত্রী আমি একাই। এয়ারপোর্টের কাছেই হোটেল। প্রথম দেখায় ব্যবস্থা বেশ ভালো বলে মনে হলো। রিসিপশনে পাসপোর্ট নিয়ে ফটোকপি নিজেরা করে নিল। আমার নাম রেকর্ড করার পাশাপাশি দারুন স্বাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস দেয়া হলো। মাত্র ঘন্টা কয়েকের জন্য পুরো একদিনের রুম ভাড়া দিতে কষ্ট হলেও বরফকুচি দেয়া ওয়েলকাম ড্রিংকস বেশ স্বস্তি দিল। রিসিপশনের তরুণী বললো, ৩টার সময় আমাদের গাড়ি তৈরি থাকবে। বেরুনোর সময় নিচের রেস্টুরেন্টে আপনাকে হালকা নাস্তা এবং চা কিংবা কফি সার্ভ করা হবে। আমাদের গাড়ি আপনাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেবে। আপনার ভ্রমণ নিরাপদ হোক, সামনের দিনগুলোতে নিশ্চয় আবার দেখা হবে। বাহ, বেশ প্রোফেশনাল তো। দারুণ স্মার্ট। কাস্টমার ড্রিলিংস এমন সুন্দর হলে ব্যবসা তো জমবেই। আমাকে চাবি দেয়া হলো। লিফটে চড়ে রুমে চলে আসলাম। বেল বয় লাগেজ নিয়ে আসবে। রুমে ঢুকে মনটি আরো ভালো হয়ে গেলো। বেশিক্ষণ থাকবো না ঠিকই, তবে বিছানাটি এতো দারুণ যে ভোরে ঘুম ভাঙবে কিনা সন্দেহ হচ্ছিল। লো টেম্পারেচারে পুরো ঘরটিকে বরফ বানিয়ে এমন দারুণ বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমানোর মজাটা একটু অন্যরকম। সুসজ্জিত রুমটিতে পাঁচ তারকা হোটেলের আয়োজন সর্বত্র। এক–দুইজন মানুষের যা যা দরকার তার সবই দিয়ে দেয়া হয়েছে রুমটিতে। ফ্রেশ হয়ে কফি মেকার চালিয়ে দিলাম। হাতের কাছে এমন আয়োজন থাকলে কফি না খাওয়ার কি কোন মানে আছে! ডিনারের আগে আস্ত এক মগ কফি সাবাড় করে দেয়ার অভ্যাস তো আমার বহুদিনের!
ইন্টারকমে ফোন করে ডিনারের কি ব্যবস্থা আছে জানতে চাইলাম। তরুণী বললো, রেস্টুরেন্টে সব খাবারই আছে। আপনি যা অর্ডার করবেন তাই করে দেয়া যাবে। আর রুম সার্ভিসও আছে। অর্ডার করলে খাবার রুমে পৌঁছে দেয়া হবে। অনেকটা ফিসফিস করে বলার মতো করে তরুণী বললো, তাতে বিল কিন্তু অনেক বেশি হবে!
আমি হেসে উঠলাম। জানতে চাইলাম রেস্টুরেন্ট কোন ফ্লোরে! রয়ে সয়ে রেস্টুরেন্টে গেলাম। ঢাকা শহর। ইচ্ছে করলে বাইরে গিয়ে কোথাও খেয়ে আসতে পারি। কোন স্বজনের বাসায় গিয়েও দিব্যি খাওয়া দাওয়া করা যায়। কিন্তু দিনভর নানা পরিশ্রমের পর তড়িঘড়ি করে রাতে ঢাকায় পৌঁছে বেশ টায়ার্ড লাগছিল। বেরুতেই ইচ্ছে করছিল না। তবুও ‘ফিসফিসানি’র তোড়ে রেস্টুরেন্টে না এসে রুমে বসে খাওয়ার সাহস হলো না।
ডিনার সেরে রুমে ফিরে টিভি অন করলাম। একটি নিউজ চ্যানেলে চোখ রাখলাম। দুনিয়ার নানা খবর। স্ক্রলে চোখ রেখে সবই দেখে নিলাম। অধিকাংশ খবরই কষ্টের। কষ্ট ছাড়া বুঝি খবর হয় না!! কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে একটু ঘুমানোর উদ্যোগ নিলাম। ওয়েক আপ কল দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম। ঘন্টা তিনেক ঘুমাতে পারলে মন্দ হতো না। তবে আমি বেশ জানি যে এমন পরিস্থিতিতে আমার চোখে ঘুম আসবে না। সাত সকালে কোন কাজ থাকলে রাতে আমার ঘুম আসেনা। বেলা দশটার আগে কোন কাজ থাকলে আমার মনের উপর অন্যরকমের চাপ পড়ে। এখন তো ভোররাতে ফ্লাইট ধরার চাপ! সেই চাপ নিয়ে এপাশ–ওপাশ করতে করতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল কে জানে, ওয়েক–আপ কলে ধড়পড় করে উঠলাম। তিনটা বেজে গেছে। দ্রুত তৈরি হতে হবে।
রেস্টুরেন্টে নাস্তা সার্ভ করা হয়েছে। ক্ষুধা নেই। নাস্তা করার কোনও ইচ্ছে হচ্ছিল না। শুধু এক কাপ চা করে দিতে বললাম। ঘন করে দুধের চা। নাস্তায় ব্রেড বাটারের পাশাপাশি কিছু ফলমূলও দেয়া হয়েছে। কলার রঙ এবং সাইজ খুবই লোভনীয়। সাজিয়ে রাখা কলার দিকে তাকিয়ে মনে হলো এমন সুন্দর একটি কলা মনে হয় খাওয়া যায়। বেশ মিষ্টি, গন্ধও দারুণ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ঘড়ির কাঁটায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। টিক টিক করে এগুচ্ছে সময়। সাড়ে তিনটা হতে আর খুব বেশি দেরি নেই। আমি দ্রুতই গাড়িতে চড়লাম। (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।