‘চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও কানেক্টিভিটি : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সেমিনারে ভারত ও বাংলাদেশকে ট্রেড, ট্রানজিট এবং ট্যুরিজমের ওপর জোর দিতে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এতে বক্তারা বলেন, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পূরক অর্থনীতির প্রয়োজন রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশকে ট্রেড, ট্রানজিট এবং ট্যুরিজমের ওপর জোর দিতে হবে। দেশ দুটিকে মাল্টিলেবেল কানিক্টিভিটির ব্যাপারে ভাবতে হবে। ভারত–বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করলে এই অঞ্চলের অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ–ভারত ইতিহাস ও ঐতিহ্য পরিষদ এবং উন্নয়ন সমন্বয় আয়োজিত সেমিনারে অর্থনীতিবিদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম ঘিরে অনেক মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এগুলো নির্ধারিত সময়ে শেষ করা দরকার। কোনো রকম বাধা বিপত্তি ছাড়া এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে চট্টগ্রামের চেহারা বদলে যাবে। চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়ার হাব হয়ে উঠবে। তবে শুধুমাত্র প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেই হবে না, সমন্বয়ও করতে হবে। এই সমন্বয়ের জন্য কো–অর্ডিনেটিং টাস্কফোর্স করা যায় কিনা সেটা ভেবে দেখা দরকার। অংশগ্রহণমূলক কার্যক্রম দরকার।‘চট্টগ্রাম আমাদের ইঞ্জিনের মতো’ মন্তব্য করে আতিউর রহমান বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতিতে অবদান রাখার সক্ষমতা চট্টগ্রামের রয়েছে, যেখানে মাল্টি স্টেকহোল্ডারের অংশগ্রহণ থাকতে পারে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। চট্টগ্রাম এগিয়ে গেলে বাংলাদেশও এগিয়ে যাবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারত–বাংলাদেশ এক সঙ্গে কাজ করতে চায়।
আসলে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য চট্টগ্রাম সারা পৃথিবীতে বিশিষ্ট নগর। পৃথিবীতে এমন কোনো নগর নেই যেখানে সমুদ্র, নদী পাহাড়, বন, হ্রদ–এই পাঁচটি প্রকৃতির দান আছে। নগরের এই প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করতে পারছি না আমরা। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই বৈশিষ্ট্য রক্ষা করার জন্য পরিকল্পনা করা উচিত।
আমরা নগর উন্নয়নের কথা বলছি। নাগরিকের উন্নয়নের কথা ভাবি না। বড় নগর চাচ্ছি। আমরা এই নগর রক্ষা করার মতো মানুষ কি না আমাকে সেটিও দেখতে হবে। পৃথিবীর কোনো দেশে সব লোক নগরে থাকে না। মুম্বাইয়ে ৬০ লাখ লোক প্রতিদিন আসা–যাওয়া করে। চট্টগ্রাম শহরের আশপাশে পটিয়া, হাটহাজারী, রাউজানকে উপশহর হিসেবে উন্নয়ন করি না কেন? উপশহর হলে নগরে চাপ থাকবে না। এসব উপশহর থেকে শহরে যাতায়াত করবে মানুষ।
সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে। বলা দরকার, চট্টগ্রামে অনেকগুলো সেবা সংস্থা কাজ করে। নিজেরা নিজেদের মত প্রকল্প আনছে আর ঢাকঢোল পিটিয়ে বাস্তবায়ন করছে। কেউ রাস্তা তৈরি করছে আর আরেক সংস্থা এসে তা কাটছে। কোনো সমন্বয় নেই। তাহলে তো উন্নয়নের সুফল আসছে না। এভাবে চলতে পারে না। সেজন্য চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য সেবাসংস্থাগুলোর সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যতটুকু জানি, ‘সমন্বয় সভাগুলোতে সেবাসংস্থার দায়িত্বশীল কেউ না এসে তাদের প্রতিনিধি পাঠানো হয়। ফলে অগ্রগতিও হয় না।’ বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমন্বয় নিশ্চিত করার জন্য সিটি মেয়রকে অভিভাবকত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি হিসেবে মেয়রকে সেবা প্রদানকারী সংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় সাধনের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষমতাও দিতে হবে। শহরটা যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের অধীনে, সেহেতু সিটি মেয়রকে এর দায়িত্ব দেওয়া শ্রেয়। নগরের ভেতরে যে কোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলে মেয়রকে অবহিত করতে হবে। সমন্বয় করতে হবে। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি থেকে শুরু করে সবকিছুর জন্য সিটি কর্পোরেশনকে দায়ী করা হয়। বাস্তবে একাধিক সংস্থা কাজ করতে গিয়ে শহরে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করে থাকে। সমন্বয়হীনতার কারণে নাগরিক দুর্ভোগ ও সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে যে সব দুর্ঘটনা ঘটে, তাতে কষ্ট পাওয়া ছাড়া গতি নেই। মেয়রের অভিভাবকত্ব থাকলে, জবাবদিহি করার সুযোগ থাকতো।
সেমিনারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল বলেন, সেবার মান বৃদ্ধির জন্য মাস্টার প্ল্যান করেছি। আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দর মাতারবাড়ি ২–৩ মাসের মধ্যে চালু হবে। ভারতের সেভেন সিস্টার্স ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের দ্বার উন্মোচন করবে। চট্টগ্রাম বন্দর সবার জন্য উন্মুক্ত। এখানে যে কোনো দেশ ব্যবহার করতে পারে। আমরা সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।
বন্দর চেয়ারম্যানের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, দেশের উন্নয়নে চট্টগ্রাম এখন মাইলফলক। সঠিকভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন হলে চট্টগ্রাম হবে সত্যিকার অর্থে আধুনিক নগরী। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রামে। এ কারণে চট্টগ্রামকে বলা হয় বন্দরনগরী। বাংলাদেশের অর্থনীতি পরিচালিত হয় এই বন্দর দিয়ে। এই বন্দরকে বাঁচাতে হলে চট্টগ্রামে উন্নয়নের কোনও বিকল্প নেই। সবাই সম্মিলিতভাবে কাজ করলে চট্টগ্রাম দ্রুত এগিয়ে যাবে। দেশেরও উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। মনে রাখতে হবে, চট্টগ্রামকে অবহেলিত রেখে বাংলাদেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব নয়।