গত ১৭ আগস্ট শরীরে জ্বর আসে চার বছর বয়সী সাইফুর রহমানের। ১৯ আগস্ট পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এর একদিন পর (২০ আগস্ট) একমাত্র ছেলেকে সন্দ্বীপ থেকে শহরে এনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করান বাবা মো. শাহীন। হাসপাতালে আনার পর সাইফুরকে প্রথমে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের ৯নং ওয়ার্ডে ভর্তি দেয়া হয়। অবস্থা ‘ক্রিটিক্যাল’ হওয়ায় একদিন পরই শিশু আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। ওই দিন (২১ আগস্ট) থেকে ৮ দিন ধরে পিআইসিইউতে (পেডিয়াট্রিক আইসিইউ) চিকিৎসাধীন চার বছর বয়সী সাইফুর।
আইসিইউ’র চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত সাইফুরের জ্বর ১১/১২ দিনেও ছেড়ে যায়নি। তার উপর শরীরে রক্তশূন্যতা। তার চোখ–মুখ অনেকটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কয়েকদিন আগে তার হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ ৫ এর নিচে ছিল। গতকাল সোমবার তাও ৫–এর উপরে উঠেছে। পিআইসিইউ’র দায়িত্বে থাকা শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. ধীমান চৌধুরী জানান, ক্রিটিক্যাল অবস্থার রোগীকেই আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়ে থাকে। তাই শিশুটির অবস্থা ‘ভালো’ বলা যাবেনা। তার রক্তশূন্যতা রয়েছে। এর মধ্যে তার শরীরে এক ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে। আরো রক্ত দিতে হতে পারে। রক্ত প্রস্তুত রাখতে শিশুর বাবাকে বলে দেয়া হয়েছে বলেও জানান ডা. ধীমান চৌধুরী।
পিআইসিইউ’র ২নং শয্যায় চিকিৎসাধীন থাকা সাইফুর তার বাবা–মায়ের একমাত্র ছেলে। সাইফুরের বাবা শাহীন এলাকায় কসমেটিকসের ব্যবসা করেন। মা রীমা বেগম গৃহিনী। গত বছরের আগস্ট মাসে এই দম্পতির ঘরে আরো একটি সন্তান আসে। তবে চার দিন বয়সে ওই সন্তান না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়। তাই সাইফুরই এখন একমাত্র বুকের ধন এই দম্পতির। সে বুকের ধনটিও ৮ দিন ধরে হাসপাতালের আইসিইউতে। বাবা–মায়ের রাত কাটছে নির্ঘুম। পাগল প্রায় এই দম্পতি বর্তমানে নাওয়া–খাওয়া ভুলে একমাত্র বুকের ধনের চিকিৎসায় ছুটোছুটিতে ব্যস্ত। মা রীমা বেগম কিছু সময় সন্তানের শয্যার কাছে থাকার সুযোগ পেলেও বাবার ঠাঁই পিআইসিইউ’র বাইরে। হঠাৎ ডাক্তার খুঁজতে পারে, কোনো ওষুধের কথা বলতে পারে, এর জন্যই ঠায় অপেক্ষা বাবা শাহীনের। গতকাল সোমবার দুপুরে পিআইসিইউর বাইরে অপেক্ষারত বাবা শাহীনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। সবকিছুর বিনিময়ে নিজের একমাত্র বুকের ধন যেন সুস্থ হয়ে উঠে, সে আকুতিই ঝরছিল এই অসহায় বাবার কন্ঠে।
সাইফুরের পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো তিন শিশুর ঠাঁই হয়েছে শিশু আইসিইউতে। এর মাঝে ১নং শয্যায় থাকা নুহানের বয়স ৩ বছর ৯ মাস। ২২ আগস্ট হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য ওয়ার্ডে ভর্তির পর ২৪ আগস্ট আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয় তাকে।
পিআইসিইউ’র ৪নং শয্যায় রয়েছে দেড় বছর বয়সী নূর হালিমা। কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এই শিশুর জ্বর দেখা দেয় গত ২০ আগস্ট। ২৪ আগস্ট পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু ধরা পড়ে। এরপর কঙবাজার হাসপাতাল হয়ে ২৭ আগস্ট তাকে নিয়ে আসা হয়েছে চমেক হাসপাতালে। ওইদিন রাতেই শিশুটিকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। শিশু নূর হালিমার বাবা হেফজু রহমান আর মা জান্নাত আরা। দুজনই আছেন হাসপাতালে। সন্তানের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র যা লাগছে, তা এনজিও প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে বলে জানান নূর হালিমার বাবা হেফজু রহমান।
১১ বছর বয়সী শাহদাত হোসাইন চিকিৎসাধীন পিআইসিইউ’র ৭নং শয্যায়। ডেঙ্গু আক্রান্তের পর ফেনীর ফুলগাজী থেকে গত ২১ আগস্ট এই শিশুকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। পরদিন ২২ আগস্ট শিশুটিকে পিআইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়।
পিআইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা সব শিশুরই অবস্থা ক্রিটিক্যাল বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এরপরও তারা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। ডেঙ্গুতে শিশুর ঝুঁকি বেশি জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলছেন, কিছু বুঝে উঠার আগেই আক্রান্ত শিশুর অবস্থা ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। এরকম ঘটনা বেশি ঘটছে। তাই শিশু যাতে ডেঙ্গু আক্রান্ত না হয়, মশা যাতে না কামড়াতে পারে, মা–বাবা ও পরিবারের সে বিষয়ে আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন হাসপাতাল পরিচালক।