ইসলামে অমুসলিমদের অধিকার
অমুসলিম’র পরিচয়:
আল্লাহ তা’আলার একত্ববাদ ও প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতে যারা বিশ্বাস করেনি, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র খতমে নবুওয়ত তথা সর্বশেষ নবী হওয়াকে যারা মনে প্রাণে আক্বিদা বিশ্বাসে মেনে নেয়নি উপরন্ত কুরআন ও সুন্নাহর শাশ্বত বিধানকে যারা মেনে নেয়নি অস্বীকার করেছে তারা অমুসলিম হিসেবে গণ্য।
মানুষ হিসেবে মুসলিম অমুসলিম সকলের সমান অধিকার রয়েছে:
একটি রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে। বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র হলেও এতে রয়েছে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী মানুষের বসবাস। সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে কথায় কাজে ব্যবহারে আচরণে লেন দেন পারস্পরিক সহযোগিতা সম্পৃক্ততা ও বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রমে মুসলিম অমুসলিম সকলের সমান অধিকার রয়েছে। ব্যক্তি মালিকানা ও ভূমি মালিকানা সূত্রে রাষ্ট্রে বসবাস করার অধিকার থেকে কোনো অমুসলিম নাগরিককে তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত করা যাবেনা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে মানব মন্ডলী! আমি তোমাদেরকে এক পূরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন, নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ সম্যক অবহিত। (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১৩)
মুসলিম রাষ্ট্রে কোন অমুসলিমকে ধর্ম ত্যাগে বাধ্য করা যাবেনা:
ইসলামী জীবন বিধান ও রাষ্ট্রীয় সংবিধানে ধর্মীয় স্বাধীনতা স্বীকৃত। মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারী কোনো অমুসলিমকে তার ধর্ম ত্যাগ ও জোরপূর্বক ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবেনা। কারো ধর্মীয় গুরু, ধর্মের প্রচারক, ধর্ম গ্রন্থ ও ধর্মীয় স্থাপনার বিরুদ্ধে কটূক্তি ও অশালীন ও অরুচিকর আপত্তিকর মন্তব্য করা যাবেনা, এ কথা স্বীকার্য যে, ইসলামই একমাত্র আল্লাহর মনোনীত সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ পবিত্র ধর্ম। সকলের মাঝে ইসলামের আদর্শ শিক্ষা মাহাত্ন, ও ধর্ম দর্শন প্রচার করা যাবে। তবে দ্বীন তথা ইসলাম গ্রহণে কোনো অমুসলিমকে বাধ্য করা যাবেনা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, দ্বীন গ্রহণের ব্যাপারে কোনে জবরদস্তি নেই, (সূরা: বাকারা, আয়াত: ২৫৬)
মহান প্রভূর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সত্য বিধান, সত্য পয়গাম, ইসলামের মর্মবাণী প্রচার প্রসারে মানব জাতিকে অগ্রনী ভূমিকা পালন করতে হবে, মুক্তিকামী সত্যান্বেষী মানুষগুলো অন্তর চাইলে ঈমান গ্রহণ করবে। যাদের ইচ্ছা কুফরী করবে মানুষকে ইচ্ছা শক্তি ও কর্মের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে, তার উপর কোনো বিধান চাপিয়ে দেয়া হয়নি। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, বলুন! সত্য তোমাদের প্রভূর পক্ষ থেকে সুতরাং যার ইচ্ছা সে যেন ঈমান আনে যার ইচ্ছা সে যেন কুফরী করে। (সূরা: কাহফ, ২৯)
অমুসলিমদের প্রয়োজনে আশ্রয় দেয়া ইসলামের অনুপম শিক্ষা:
অমুসলিম ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রয়োজনে আশ্রয় দান করা তাকে শংকামুক্ত ও নিরাপদ জীবন লাভে সহায়তা করা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। অমুসলিমকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা তাঁর ব্যবসা বাণিজ্য ও তাদের ধন সম্পদ ক্ষয় ক্ষতি করা তাদের প্রতি উগ্রতা, অমানবিকতা প্রদর্শন করা ইসলাম আদৌ সমর্থন ও অনুমোদন করেনা। অমুসলিম কাফির মুশরিককে আশ্রয় দান করা, ব্যবহারিক জীবনের আদর্শ দিয়ে অমুসলিমদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা ইসলামের কালোত্তীর্ণ জীবন দর্শন অমুসলিমদের মধ্যে তুলে ধরা মুসলমানদের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আর যদি মুশরিকদের কেউ আপনার কাছে আশ্রয় চায় তাহলে তাঁকে আশ্রয় দান করুন। অমুসলিমদের দেবদেবী প্রতিমা নিয়ে গালমন্দ ও তাঁদের সম্পর্কে অশালীন মন্তব্য করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। মুসলমানরা অমুুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে মুসলমানরা শংকামুক্ত থাকবে অন্যথায় অমুসলিমরা আমাদের প্রতিপালক মহান প্রভূর বিরুদ্ধে গালমন্দ করবে ধৃষ্টতা প্রদর্শন করবে। ধর্ম অবমাননার পথ সুগম হবে সুতরাং নিজেদের ধর্মের পবিত্রতা রক্ষার স্বার্থে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারে সংযত আচরণ করা ইসলামের সুমহান আদর্শ ও রাসূলুল্লাহর শিক্ষা। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, আর তোমরা তাদেরকে গালমন্দ করোনা আল্লাহ ছাড়া যাদেরকে তারা ডাকে ফলে তারা গালমন্দ করবে আল্লাহকে। (সূরা: আনআম: আয়াত: ১০৮)
অমুসলিমদের প্রতি উত্তম পন্থায় ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেওয়া:
দুনিয়া সৃষ্টির সূচনা থেকে সম্মানিত নবী রাসূলগন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন তবে তাবেঈন, আউলিয়ায়ে কামেলীন, সূফীয়ায়ে কেরামদের ব্যবহারিক জীবনের উত্তম আদর্শ চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও মহান ত্যাগের বদৌলতে বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসার ঘটেছে কোন মুসলিম বা ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের প্রতি বল প্রয়োগ ও জোর জবরদস্তি করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে কখনো কাউকে বাধ্য করা হয়নি। বিশ্ব মানবতার অগ্রদূত শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মূর্ত প্রতীক মুক্তির দিশারী মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে সকল ধর্মাবলম্বীদের প্রতি কল্যাণকামিতার এক নজীর বিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উগ্রতা ও অহেতুক বিতর্ক নয় উত্তম পন্থা কৌশল ও পদ্ধতি অবলম্বন ছিল ইসলাম ধর্ম প্রচারের এক অনুসরনীয় নীতি। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “আপন পালনকর্তার পথের দিকে আহবান করুন, জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়, নিশ্চয় আপনার পালন কর্তা ওই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তার পথ থেকে বিচ্যূত হয়ে পড়েছে এবং তিনি ভালো জানেন তাদের যারা সঠিক পথে আছে।” (সূরা: আন নাহল, আয়াত: ১২৫)
অমুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নবীজির সতর্কবাণী:
অমুসলিম নাগরিকদের অধিকার সুরক্ষায় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও ভূমিকা ইলামের ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। রাসূূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মনে রেখো! যদি কোনো মুসলমান কোনো অমুসলিম নাগরিকের ওপর নিপীড়ন চালায় তার অধিকার খর্ব করে তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব। (আবু দাউদ, হাদীস: ৩০৫২)
ইসলামের শত্রুরা যুদ্ধ ময়দানে মুসলমানদের কে পরাস্ত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুসলিম বীর যোদ্ধারা প্রতিপক্ষ শত্রুদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করার পরও যুদ্ধ বন্দীদের প্রতি মানবতা ও উদারতার যে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা ছিল অনন্য। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত মুসয়াব ইবনে উমাইর রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বদর যুদ্ধে বন্দীদের অন্তভূক্ত ছিলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বন্দীদের ভালো ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন, আমি একজন আনসারীর অধীনে ছিলাম যখন তারা দুপুর ও রাতের খাবার সামনে আনতেন তখন তারা নিজেরা খেজুর খেতেন এবং আমাকে রুটি খেতে দিতেন। এটা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপদেশের ফল। (মুজামুস সগীর, হাদীস: ৪০৯)
কথায় ও কাজে একজন মুসলিমকে কষ্ট দেয়া যেভাবে হারাম তেমনিভাবে একজন অমুসলিমকেও কষ্ট দেয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। একজন মুসলিমের যেমন কোনো প্রকার ক্ষতি সাধনের চিন্তা করা যাবেনা তেমনিভাবে অমুসলিমের ক্ষেত্রে ও ক্ষতি সাধনের চিন্তা করা নিষিদ্ধ। আল্লাহ তা’আলা অমুসলিমদের অধিকার সুরক্ষায় ইসলামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী);
খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।