চিকিৎসক রবীন্দ্রনাথ ও রোগী রবীন্দ্রনাথের শেষ দিনগুলো

ডা. প্রবীর কুমার দাশ | বৃহস্পতিবার , ২৪ আগস্ট, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, ও জীবনবোধের রূপকার। তার মানস গঠনের প্রাণপুরুষ। কবিতা, গান, গল্প, ছড়া, উপন্যাস, নাটক, চিত্রকলা, তথা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর সৃষ্টির সুমহান স্পর্শ লেগেছে। চিকিৎসা জগতেও তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল। মানবদেহের গঠন ও কার্যপ্রণালী ছাড়াও রোগের উৎপত্তি, তার প্রতিকার ও প্রতিরোধ উল্লেখিত আছে তার বিভিন্ন লেখায়। তিনি রোগ চিকিৎসায়ও নিয়োজিত করেছেন নিজেকে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯১৩ সালের ১৩ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিতে ভূষিত করে। তার অব্যবহিত পর কবির রামগড় নামক স্থানে অবস্থান কালে সেই ঠিকানায় আসা সব চিঠির খামে ‘ডক্টর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ লেখা থাকত। তা দেখে পোস্টমাস্টার চারিদিকে প্রচার করে দেয় কলকাতা থেকে এক বিখ্যাত ডাক্তার এসেছেন এই অঞ্চলে। রবীন্দ্রনাথের কাছে রোগী আসতে শুরু করে এই সংবাদে। তিনি তাদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন সানন্দে এবং বিনামূল্যে। উল্লেখ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হোমিওপ্যাথি ও বায়োকেমিতে হাতযশ ছিল। এই ব্যাপারে তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘তবু তোমরা আমাকে ডাক্তার বলে মানবে না, আমি ফি নেই না তাই ডাক্তার নই। যদি মোটা ফি নিতাম তাহলে সবাই বলত একজন মস্তবড় ডাক্তার।’ রবীন্দ্রনাথ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দিলেও তাঁর এই বিষয়ে কোনো ডাক্তারী সনদ ছিল না। তবে তাঁর ছিল চিকিৎসকসুলভ এক সহজাত প্রবৃত্তি। যাকে তিনি বলেছিলেন instinct । তিনি বলেছিলেন, ‘ডাক্তারদের একটা ডাক্তারী instinct থাকা চাই। শুধু জানা আর experience নয়, instinct। ডাক্তারী পেশাকে তিনি এতটাই পছন্দ করতেন যে তা প্রকাশ করেছেন এভাবে– ‘এক সময় আমার মনে হয় আমি যদি ইচ্ছা করতুম তাহলে ভালো ডাক্তার হতে পারতুম। কারণ চিকিৎসক হতে হলে যে instinct থাকা দরকার তা আমার আছে।’ এই ডাক্তারী instinct হচ্ছে একজন চিকিৎসকের সহজাত মানবিক প্রবৃত্তি যা তাকে মানব সেবায় নিবেদিত করে তোলে। এইভাবে তিনি চিকিৎসা পেশার মহত্ত্বের দিকগুলো তুলে ধরেছেন। স্বাস্থ্য সচেতনতা ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পারিবারিক শিক্ষার অংশ। শরীরচর্চা, পরিমিত ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার, পরিমিত বিশ্রাম ছিল তার অন্যতম। তিনি ছিলেন বরাবরই নিরোগ, সুঠাম দেহের অধিকারী। তিনি নিয়মিত কুস্তি করতেন, সাতার কাটতেন ও ঘোড়া দৌড়াতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে যেমন স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন তেমন তিনি অন্যদেরও স্বাস্থ্য সচেতন করতে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাই তিনি বলেছেন, ‘যে সমস্ত রোগের সাথে আামাদের প্রতিনিয়ত ঘর করতে হচ্ছে তার জন্য অসহায় অজ্ঞতা দিয়ে একমাত্র ডাক্তারের দিকে থাকিয়ে থাকলে চলবে না। অন্তত কিছু পরিমাণ ডাক্তারের সহযোগিতা না করতে পারলে বাঁচাও নেই। এদেশে রোগ যত সুলভ ডাক্তার তত সুলভ নয়।’

রোগের প্রতিরোধ তার প্রতিকার অপেক্ষা শ্রেয়তর। তাই একজন চিকিৎসকের দায়িত্ব কেবল রোগের প্রতিকারে সীমাবদ্ধ নহে। তার প্রতিরোধও জরুরি। এই ধরনের রোগ ব্যাধির প্রতিরোধেও রবীন্দ্রনাথ একজন দায়িত্বশীল ও প্রাজ্ঞ চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তিনি বিশেষভাবে ভাবিত হয়েছিলেন গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন ‘গ্রামের মানুষের মরণ বাচন তো হাতুড়েদের হাতেই। আমরা চাই বা না চাই ওরাইতো গ্রামের মানুষের শিবরাত্রির সল্‌তে। যতদিন না গ্রামে পাশ করা ডাক্তার পাওয়া যাচ্ছে ততদিন তো তাহলে আরোগ্যের চেয়ে রোগ প্রতিরোধই গ্রামের মানুষের একমাত্র হাতিয়ার। বিবিধ উপায়ে ঘরে ঘরে এদেশের মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হবে কিভাবে রোগকে ঠেকানো যায়।’ সে সময়ে ম্যালেরিয়া মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ এই মহামারী মোকাবেলায় এন্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটি গঠন করেছিলেন। ম্যালেরিয়া জীবাণুর উদ্ভাবক রোনাল্ড রসের সহকারী শ্রী গোপাল চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে এই সংগঠন গঠন করেন। সোসাইটির অন্যান্য পৃষ্ঠপোষকগণ ছিলেন কবিবন্ধু বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র এবং প্রখ্যাত চিকিৎসক নীল রতন সরকার। সোসাইটির সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ম্যালেরিয়ার ইনজেকশন জানি না, কী পরিমাণ কুনাইন দিতে হয় জানি না। কিন্তু এটা জানি এবং এই জন্য বহুকাল অরণ্যে রোদন করেছি কারো মুখাপেক্ষী হবো না। তাতে ভগবান প্রসন্ন হয় না। আমাদের অন্তরের মধ্যে যে অনন্ত শক্তি থাকে তাকে জাগাতে হবে। তিনি জাগলে সব দূর হবে। দেশে মশা আছে এটা বড় সমস্যা নয়, বড় সমস্যা হলো এদেশের লোকের মনে জড়তা আছে। সেটা আমাদের দোষ, বড় রকম দুঃখ বিপদের কারণ।’ এভাবে তিনি পল্লী শক্তির জাগরণ ঘটিয়েছিলেন।

মেদবাহুল্য হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস সহ নানা প্রাণঘাতি স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ। এসবের প্রতিরোধে কবি মেদবাহুল্য পরিহারের কথা বলেছেন।‘ভারতী’তে প্রকাশিত ‘মেদবাহুল্য’ সম্পর্কে কবি লিখেছেন, ‘অনেক বড়ো বড়ো মানুষ দেখা যায় তারা ক্রমাগত আপনাদের চারিদিকে বিপুল মাংসরাশি সঞ্চয় করিয়া থাকে। অতিশয় স্ফীত হইয়া সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে। আমারতো মনে হয় এইরূপ প্রচুর মাংসস্তূপ প্রকাণ্ড জড়তা ও অসারতা এখনকার দিনের উপযোগী নহে। এককালে ম্যামথ, ম্যাস্টডান, হস্তিকায় ভেক, প্রকাণ্ডকায় সরীসৃপগণ পৃথিবীর জলস্থল অধিকার করিয়াছিল। এখন সে সকল মাংসপিণ্ডের লোপ হইয়া গিয়াছে ও যাইতেছে। এখন পরিমিত দেহ ও সুক্ষ্মস্নায়ু জীবদিগের রাজত্ব। এমন সুমহান জড় পদার্থেরা অন্তর্ধান করিলেই পৃথিবীর ভার লাঘব হয়।’ মেদবাহুল্য সম্পর্কে কবির এই ধারণা অধুনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।

গ্রামীণ জনপদের রোগাক্রান্তদের তিনি হোমিওপ্যাথি আর বায়োকেমি ওষুধ দিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন। তবে তিনি কঠিন কোন রোগের চিকিৎসায় এক্সপেরিমেন্ট চালাতেন না। গুরুতর পীড়িতদের চিকিৎসায় ভরসা রেখেছেন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর। তিনি কখনও নিজের চিকিৎসা নিজে করেননি। আস্থা রেখেছেন পশ্চিম বঙ্গের প্রখ্যাত চিকিৎসক কবিবন্ধু ডা. নীল রতন সরকার,বিখ্যাত চিকিৎসক ডা. বিধান চন্দ্র রায় ও অন্যান্য প্রথিতযশা চিকিৎসকদের উপর। একবার জ্বরে আক্রান্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ডা. নীল রতন সরকার ব্যবস্থা করলেন মিক্সার। তার মাত্রা শিশির গায়ে কাগজ দিয়ে দাগ কাঁটা। শিশিতে পড়ে থাকা ওষুধ দেখে পুত্রবধূ প্রশ্ন করলে হাসতে হাসতে তিনি বললেন, ‘যে ওষুধ ডা. নীল রতন বাবু খেতে দিলেন তাতো তিনি আর নিজে খেয়ে দেখেন না। এত বিস্বাদ ওষুধ মানুষ খেতে পারে?’

শৈশব থেকে সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের ৭৬ বছর বয়সে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগ ক্রমে কবিকে আক্রান্ত করতে আরম্ভ করে। রোগী রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি ‘মুক্তি’ কবিতায় তিনি এভাবে তিনি তুলে ধরেছেন, ‘ডাক্তার যা বলে বলুক নাকো/ রাখো রাখো খুলে রাখো/ শিয়রের ওই জানালা দুটোগায়ে লাগুক হাওয়া/ তিতো কড়া কত ওষুধ/ খেলেম এ জীবনে/ দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে/ বেঁচে থাকা সে যেন এক রোগ/কত কবিরাজি কত মুক্তিযোগ/ একটুখানি অসাবধানেই বিষমকর্ম ভোগ।’ ১৯৩৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি অসুস্থ হয়ে জ্ঞান হারান। তখনই কিডনী ও প্রোস্টেট এর স্ফীতিজনিত সমস্যা ধরা পড়ে। সাথে জ্বর, মাথা ব্যথা, ক্ষুধা মন্দা ভাব। ডা. নীল রতন সরকারের নেতৃত্বে একদল চিকিৎসক শান্তি নিকেতনে তার চিকিৎসা দেন। তিনি সেবার সেরে উঠেন। তবে প্রোস্টেটের সমস্যা রয়েই যায় এবং তা আরো বেড়ে যায়। অধুনা শল্য চিকিৎসকগণ মূত্রনালীর ভিতর দিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে এই স্ফীত গ্রন্থি অনায়াসে কেটে বের করে নিয়ে আসেন। কিন্তু সে সময়ে এই অপারেশন চালু হয়নি। মূত্রথলির সংক্রমণ চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিকও তেমন ছিল না। তলপেট কেটে প্রোস্টেট অপারেশন ছিল ভাগ্যনির্ভর। তাই অপারেশন করা না করা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে দেখা দেয় মতান্তর। ১৯৪০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর কবি প্রকৃতির কোলে সময় কাটাতে কালিম্পং যাত্রা করেন। তার সপ্তাহ পরে মূত্র থলির সংক্রমণে তিনি আবার জ্ঞান হারান। কলকাতা থেকে ছুটে এলেন ডা. বিধান চন্দ্র রায় সহ বিচক্ষণ চিকিৎসকগণ। তাকে জোড়াসাকো নিয়ে আসা হয়। ওষুধে সেরে উঠে তিনি শান্তি নিকেতন যাত্রা করেন এবং তথায় ডিসেম্বরের পৌষ সংক্রান্তি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ১৯৪১ সালের ১৬ জুলাই তাঁর চিকিৎসক ডা. প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবীশ ও অন্যান্যরা প্রোস্টেট অপারেশনের পক্ষে মত দেন। কলকাতা মেইল ট্রেনের বিশেষ কেবিনে কবিকে নিয়ে আসা হলো কলকাতায়। একরাত ট্রেনে ভ্রমণে তিনি আরো ক্লান্ত ও পীড়িত হয়ে পড়েন। কলকাতার সার্জন জেনারেল উনাকে দেখে অভিমত ব্যক্ত করেন তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। ডা. বিধান রায় প্রমুখ চিকিৎসকগণ সম্মতি দিলেন শল্য চিকিৎসার। ডা. নীল রতন সরকার বিচলিত বোধ করলেন। ৩০ জুলাই অপারেশনের দিন ধার্য হলো। কিন্তু তা কবিকে তখনও জানানো হয়নি। জীবন সায়াহ্নে উপনীত কবি রয়েছেন আচ্ছন্ন অবস্থায়। তিনি রচনা করলেন তার শেষ কবিতা। তিনি বলে গেলেন আর তা লিখে নিলেন রাণী চন্দ– ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনা জালে হে ছলনাময়ী/মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে/ এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত. … ’

জোড়াসাকোর বাড়ির বারান্দায় বিশেষ ব্যবস্থায় অপারেশন থিয়েটার তৈরী করে কবির অপারেশন করলেন প্রখ্যাত সার্জন ললিত মোহন বন্দোপাধ্যায়। তলপেঠে মূত্রথলি ছিদ্র করে অপারেশন করা হলো। অপারেশনের পর ৪ আগষ্ট প্রস্রাব বন্ধ হয়ে পড়ে। কবি জ্ঞান হারান। ডা. নীলরতন সরকার, ডা. বিধান চন্দ্র রায়, ডা. ললিত মোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ চিকিৎসকগণ শেষ বারের মতো কবিকে দেখে গেলেন। ৭ আগষ্ট, বাংলা ২২ শ্রাবণ দুপুর ১২.১০ ঘটিকায় কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাজার হাজার শোকার্ত মানুষ ছুটে এলো জোড়াসাকোয় তাদের শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। কবি চেয়েছিলেন শান্ত, মুক্ত প্রকৃতির নিচে চিরবিদায়। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি। অগণিত ভক্ত তাঁর শবযাত্রায় মুহুর্মুহু ধ্বনি দিতে লাগল। ‘জয় বিশ্বকবি, জয় রবীন্দ্রনাথ, বন্দে মাতরম্‌।’ কবি তার লেখা শেষ কবিতার চরণের মতো সৃষ্টির বিচিত্র ছলনার জাল ছিন্ন করে তার মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ মুক্ত হয়ে অমৃতলোকে যাত্রা করেন। বৃটিশ জার্নাল অব ইউরোলজি ইন্টারন্যাশনাল তাদের সম্পাদকীয় কলামে শিরোনাম করে, “Tagor’s last days the title prostate ends a big legend”.

লেখক: সেক্রেটারী জেনারেল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন, সাবেক বিভাগীয় প্রধান,

হৃদরোগ বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম: সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জ
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল