প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জিয়া পরিবারকে ‘খুনি পরিবার’ আখ্যায়িত করে বলেছেন, এদেশে খুনিদের রাজত্ব আর চলবে না। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে মানুষ হত্যায় জড়িত থাকায় জিয়া পরিবারকে খুনি পরিবার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পাশাপাশি গ্রেনেড হামলা মামলার রায় দ্রুত কার্যকরেরও দাবি জানান তিনি।
গতকাল ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ১৯তম বার্ষিকীতে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে যেখানে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলা চালানো হয় সেখানেই আওয়ামী লীগ এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলায় নিজের বেঁচে যাওয়াকে ‘অবাক বিস্ময়’ বলে মনে করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এছাড়া তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সঙ্গে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান জড়িত ছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মানুষ তাদের ছাড়বে না বলেও জানান তিনি। খবর বাসস, বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৪ সালে আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটা র্যালি করছিলাম ব্রিটিশ হাইকমিশনারের উপর সিলেটে হামলা এবং বিএনপি সন্ত্রাসীদের হাতে আমাদের অগণিত নেতাকর্মীদের মারধর ও হত্যার প্রতিবাদে। প্রকাশ্য দিবালোকে, যেখানে হাজার হাজার মানুষ, সেখানে আর্জেস গ্রেনেড ছোড়া হলো। আর্জেস গ্রেনেড সাধারণত রণক্ষেত্রে ব্যবহার হয়, যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। আর সেটা ব্যবহার হলো আওয়ামী লীগের ওপর, আর সেটা ব্যবহার হলো আমরা যখন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিছিল করছি, সেই র্যালির ওপর আক্রমণ। একটা দুইটা নয়, ১৩টা গ্রেনেড, আর কত তাদের হাতে ছিল কে জানে। সেদিন যে বেঁচে গিয়েছিলাম, সেটাই অবাক বিস্ময়।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিক সামনেই রাস্তার ওপর একটি ট্রাকে অস্থায়ী মঞ্চ তেরি করা হয়েছিল সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের জন্য। হামলার মূল লক্ষ্য ছিলেন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নেতাকর্মীদের তৈরি মানবঢালে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা।
সেই ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, তখন ট্রাকের উপর দাঁড়িয়ে আছেন নেতারা, আর নেতাকর্মীরা সামনে। আমি যখন বক্তব্য শেষ করে নিচে নামব, তখন গোর্কি বলল, ছবি নিতে পারিনি, আপা একটু দাঁড়ান। অন্য ফটোগ্রাফাররা বলল, আপা একটু দাঁড়ান। এই কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার, সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল গ্রেনেড হামলা। হানিফ ভাইসহ নেতারা আমার চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলল। তিনটা গ্রেনেড, আবার কিছুক্ষণ বিরতির পরে একটার পরে একটা মারতে শুরু করল।
এ মামলায় দণ্ডিত তারেক রহমানের দিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রায় দ্রুত কার্যকর হওয়া উচিত। ২১ আগস্টের কিছু আছে কারাগারে। কিন্তু এর মূল হোতা তো বাইরে। সে তো মুচলেকা দিয়ে বাইরে চলে গেছে। ওর সাহস থাকলে আসে না কেন বাংলাদেশে? আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, সেই সুবিধা নিয়ে লম্বা লম্বা কথা বলে। আর কত হাজার হাজার কোটি টাকা চুরি করে চলে গেছে। সাহস থাকলে বাংলাদেশে আসুক। বাংলাদেশের মানুষ এই খুনিদের ছাড়বে না। বাংলাদেশের মানুষ ওদেরকে ছাড়বে না।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, কিছু লোক হয়, তাই নিয়ে ওদের লম্ফঝম্প। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে চেনে নাই। মানুষের কাছ থেকে জাতির পিতাকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল, জয় বাংলা মুছে ফেলেছিল, ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিল; কিন্তু পারেনি। আবার ফিরে এসেছে। কাজেই এই বাংলাদেশে খুনিদের রাজত্ব আর চলবে না। জিয়া পরিবার মানে খুনি পরিবার।
একুশে আগস্টের হামলায় যারা আহত হয়েছেন, তাদের মানুষের কাছে গিয়ে বিএনপি ‘খুনের আর ষড়যন্ত্রের রাজনীতি এবং লুটপাটের বিষয়ে’ বলতে আহ্বান জানান শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে খালেদা জিয়ার স্বামী, সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ‘ওতপ্রোতভাবে জড়িত’ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, খুনি রশিদ–ফারুকের বিবিসিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সব বেরিয়ে এসেছে। জিয়াউর রহমান সবাইকে শেষ করতে চেয়েছিল, তারও তো দায়িত্ব ছিল, সে তো উপ সেনাপ্রধান ছিল। সে তো তার ভূমিকা রাখেনি। বরং খন্দকার মোশতাক বাংলার আরেক মীর জাফর ক্ষমতা নিয়ে জিয়াকে সেনাপ্রধান করে। কি সখ্যতা ছিল, যেহেতু এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জিয়া জড়িত ছিল, এজন্য তাকে পুরস্কৃত করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া বক্তব্য দিল, প্রধানমন্ত্রী দূরের কথা বিরোধী দলীয় নেত্রীও কখনো হতে পারব না। এ কথা কীভাবে বলেছিল? এই হত্যা ষড়যন্ত্র করেছিল, ধারণা ছিল নিশ্চয় আমি মরে যাব। এইভাবে তারা হত্যার ষড়যন্ত্র করেছে, চক্রান্ত করেছে। যে দলের উত্থানই হয়েছে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে তাদের মিথ্যাচার মানুষকে বিভ্রান্তি করার জন্য।
তাদের মানবাধিকার কোথায়? : আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে যারা অভিযোগ করেন, মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, অনুষ্ঠানে তাদেরও সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আজকে তারা (বিএনপি) ভোটের অধিকারের কথা বলে। আর কিছু আছে তাদের ভাড়া করা তারা মানবাধিকারের কথা বলে। যারা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আমরা যারা ১৫ আগস্ট আপনজন হারিয়েছি, ৩ নভেম্বর আপনজন হারিয়েছি, আওয়ামী লীগের হাজার নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে বিএনপি–জামায়াতের হাতে, তাদের মানবাধিকার কোথায়? আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থা মাঝে মাঝে মানবাধিকারের কথা বলেন। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, কাদের শেখানো বুলি তারা বলে। এদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বারবার হয়েছে, যার মূল হোতাই হচ্ছে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া।
২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার পর সরকারে থকো বিএনপি যে উল্টো আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর দমন–পীড়ন চালিয়েছিল, সে কথাও বলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, এমন একটা পরিবেশ, সেখানে কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। যারা উদ্ধার করতে এসেছিল, তাদের ওপর ঠিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ করা হয়। এখানেই প্রশ্ন, এগুলো কেন করল। আলামত মুছে ফেলতে চেয়েছিল। চিকিৎসার সরঞ্জামগুলো তালা দিয়ে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা চলে গেছে। তখন তো খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী। কী ভূমিকা পালন করেছিল সে সেটাই প্রশ্ন। সেখানেও বাধা দিল পুলিশকে। আলামত রক্ষা করতে কোনো ধরনের উদ্যোগ নিল না। এতে কি প্রমাণ হয়? গ্রেনেড হামলার সঙ্গে খালেদা–তারেক গংরা যে জড়িত, এতে কোনো সন্দেহ নেই এবং তদন্তে তা বেরিয়েছে।
ষড়যন্ত্র এখনো হচ্ছে : স্মরণ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। এই হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ইয়ার লতিফের উত্তরসূরি সেনাপতি জিয়াউর রহমান। ৩ নেভেম্বর বঙ্গবন্ধুর চারজন সহযোগী, যারা মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, (তাদের হত্যা করা হলো কারাগারে)। ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর। আর হাওয়া ভবন থেকে ২১ আগস্টের অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন যুবরাজ দুর্নীতির মামলায় পলাতক তারেক রহমান। কাপুরুষের মতো বিদেশে পালিয়ে আছে, মির্জা ফখরুল সাহেব, আপনাদের স্বপ্নের আগামীর প্রধানমন্ত্রী তারেক রহমান।
প্রসঙ্গত, ২০০৪ সালের হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান। প্রায় দেড় বছর পর মৃত্যু হয় ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের। সব মিলিয়ে নিহতের সংখ্যা হয় ২৪।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও গ্রেনেডের প্রচণ্ড শব্দে তার শ্রবণশক্তি নষ্ট হয়। তখনকার বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের সময় ওই ঘটনার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়। নানা নাটকীয়তার পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এ মামলার রায় দেয় ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, খালেদার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এছাড়া ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তার বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়।