চীন থেকে পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরে পরিবারের সঙ্গে মাত্র ছয় দিন ছিলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার প্রকৌশলী মেহেদী হাসান ওরফে মুন্না। তারপর হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন তিনি। পরে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ‘জঙ্গি আস্তানা’ থেকে ২৩ বছর বয়সী মেহেদীকে গ্রেপ্তারের খবরে অবাক ও হতবাক হয় তার পরিবার ও এলাকাবাসী। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছেন না মেধাবী ছাত্রটি ‘জঙ্গি দলের’ সদস্য। খবর বিডিনিউজের।
মেহেদীর বাবা রেজাউল করিম মাদারীপুর জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয়ের গাড়ি চালক। চাকরির সুবাদে রেজাউল তার স্ত্রী দিনারা মমতাজকে নিয়ে থাকেন শহরের ইটেরপুল এলাকায়। এ দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে মেহেদী বড়। ছোট ছেলে রাজধানীর একটি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। মেহেদীর ‘দেশবিরোধী’ এমন কর্মকাণ্ডে দিশেহারা রেজাউল–মমতাজ দম্পতি। দুজনই তাদের সন্তানকে আর ফেরত চান না। গত শুক্রবার শহরের ইটেরপুল এলাকায় রেজাউলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মেহেদীর মা দিনারা মমতাজ ঘরে শয্যাশায়ী। বাবা সোফায় বসে দুঃশ্চিন্তায় মগ্ন। ছোট্ট ঘরে চারপাশে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে রয়েছে মেহেদীর শিক্ষা জীবনের সাফল্যের সব স্মৃতি। ছেলে মেহেদীর কথা জিজ্ঞাসা করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা মমতাজ। বলতে থাকেন তাদের কষ্টের হাজারো কথা। তিনি বলেন, আমার ছেলেটা চীন থেকে দেশে আসছে, বিয়া করামু। মেয়েও দেখেছি। কত স্বপ্ন আর আশা ছিল বুকে। সব শ্যাষ হইয়া গেল। ও যে কাজটা করেছে, তার জন্যে কারো কাছে মুখ দেখানোর জায়গা নাই। আমার ছেলেডা আমাদের অপরাধী বানাইয়া দিছে। হায় আল্লাহ্, এমন ছেলে যেন আর কোনো মায়ের পেটে জন্ম না হয়। সারাজীবন টিভিতে জঙ্গি দেখেছি। এখন আমার পেটেই হইছে জঙ্গি। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করে না। মেহেদীর পরিবার সূত্রে জানা গেছে, বাবা রেজাউল চাকরি জীবনের বড় একটি সময় ঢাকায় কাটিয়েছেন। মেহেদীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ২০১৫ সালে খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে জিপিএ–৫ পান মেহেদী। ২০১৭ সালে ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজ থেকে জিপিএ–৪ দশমিক ৯২ নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তিনি। এরপর বৃত্তি নিয়ে চীনের ইয়াংজু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মেহেদী। সেখান থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভালো ফল নিয়ে স্নাতক পাস করেন। পড়ালেখা শেষে চলতি বছরের ৬ জুলাই চীন থেকে দেশে ফেরেন মেহেদী। বিমানবন্দর থেকে নেমে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে খিলগাঁও যান। সেখান থেকে মেহেদী কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে চলে যান পাবনায়। পরে ১১ জুলাই মেহেদী তার নিজ এলাকা মাদারীপুরে তার মা–বাবার কাছে যান। পাঁচদিন মেহেদী তার মা–বাবার সঙ্গে কাটালেও ১৭ জুলাই বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন। এরপর ঢাকাসহ নানা স্থানে খোঁজ–খবর নেওয়া হলেও মেহেদীর বাবা তার ছেলের কোনো সন্ধান পায়নি। এক পার্যায় ছেলের সন্ধান চেয়ে ১০ অগাস্ট মাদারীপুর সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন রেজাউল। মেহেদী ‘জঙ্গি দলের সদস্য’ হিসেবে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের খবরে হতাশ হয়ে পড়েছেন বাবা রেজাউল।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, অল্প টাকার বেতনের চাকরি করি। নিজের রক্ত পানি কইরা বড় ছেলেডারে মানুষ করতে চেষ্টা করছি। বড় ছেলেডা পড়ালেখায় ভাল দেইখা, রাতদিন পরিশ্রম করে আয় করতাম। চীনে পাঠাইছি, পড়ালেখা শেষ কইরা দেশে আইসা ভাল চাকরি পাবে, আমাগো কষ্ট দূর হইবে। এমন কত আশা ছিল ওরে নিয়া। সব শ্যাষ কইরা দিল। রেজাউল করিম আরও বলেন, ছেলের সাফল্যে প্রতিটি বাবা গর্ব করে। আমার ছেলে যখন ভাল ফল করত তখন সবাই ওর প্রশংসা করত। আমিও তখন আমার ছেলের জন্য গর্ববোধ করতাম। আনন্দে চোখের পানি ফেলতাম। আর এখন আমার ছেলেকে আমি মৃত মনে করি। যে ছেলে দেশের জন্য ক্ষতিকর, খারাপ পথে চলে যায় তাকে আর ফেরাতে চাই না। আইন ওর সর্বোচ্চ শাস্তি দেউক, সেটাই চাই।
গত ১২ অগাস্ট সকালে কুলাউড়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকায় একটি বাড়িতে ‘জঙ্গি আস্তানায়’ অভিযান চালিয়ে ছয় নারীসহ ১০ জনকে আটক করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। আটকদের মধ্যে তিন শিশু ছিল। এর মধ্যে প্রকৌশলী মেহেদী হাসান একজন। তারা ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে নতুন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বলে জানিয়েছে সিটিটিসি। এ ঘটনার পর ১৪ অগাস্ট একই এলাকা থেকে জঙ্গি সন্দেহে আরও ১৭ জনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন এলাকাবাসী।