ফরাসি দৈনিক ল্য মন্দে কুন্ডেরার এই গদ্যটি ছাপা হয় ২০০৭–এর ২৪ মে, পরে ২০০৯–এ প্যারিসের প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা গালিমার থেকে উন রকন্ত্র (মুখোমুখি সংঘাত) নামে যে গদ্যের বইটি বের হয়, তাতে এই লেখাটি স্থান পায়। ২০১০–এ বইটি ইংল্যান্ডের ব্লুমসবারি হাউজের ফেবার এন্ড ফেবার থেকে এনকাউন্টার নামে বের হয় লিন্দা আশেরের ইংরেজি অনুবাদে। ১৯২৯ সালে জন্ম নেওয়া চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা ৯৪ বছর বয়সে গত ১১ জুলাই প্যারিসে মারা গেছেন। দ্য জোক, দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিং, লাইফ ইজ এলসোহয়্যার, দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং, ইমমর্টালিটি, স্লোনেস ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, বিশ্বের চল্লিশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত। দি আর্ট অফ দ্য নভেল, দ্য কার্টেইন, টেস্টামেন্ট বিট্রেইড ইত্যাদি কুন্ডেরার গদ্যলেখার সংকলন। লেখালেখির আশ্চর্য ক্ষমতার জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিশ শতকের অন্যতম প্রভাবশালী ঔপন্যাসিক।
শত বছরের একাকীত্ব ফিরে পড়ছিলাম যখন, পড়তে পড়তেই মাথায় একটি অদ্ভুত চিন্তা এসেছিল : মহৎ উপন্যাসগুলোর বেশিরভাগ নায়কই নিঃসন্তান। বিশ্বের জনসংখ্যার খুব কমই ুবড় জোর ১ শতাংশ নিঃসন্তান; আর, অন্তত ৫০ শতাংশ মহান সাহিত্যিক চরিত্র পুনরুৎপাদন না করেই উপন্যাস–মঞ্চ থেকে বিদায় নেন। পন্তাগ্রুয়েল, পানুর্জ, বা দন কিহোতে’র বংশধর নেই।
ভালমন্তে নয়, মার্কুই দ্য মেরতুই নয়, এমন কি ‘বিপজ্জনক লিয়াজোঁ’র সেই রাষ্ট্রপতিও নয়। ফিল্ডিংস–এর সবচে জনপ্রিয় নায়ক টম জোনসও নয়। ওয়ার্থার নয়। কেউই সন্তানের জনক নন। স্তাঁদালের সকল নায়ক নিঃসন্তান, ঠিক যেমন বালজাকের বহু নায়ক; এবং দস্তইভস্কির। এবং যে–শতাব্দী মাত্র আমরা পার হয়ে এলাম, সেই সময়ের মার্সেল প্রুস্তু– ইন সার্চ অফ লস্ট টাইমসের কাহিনিকথক প্রুস্তু, তাঁর নায়করাও; এবং অবশ্যই মুজিলের প্রায় সমস্ত প্রধান চরিত্ররা– উলরিখ, তার বোন আগাথি, ওয়াল্টার, তার স্ত্রী ক্ল্যারিজ এবং দিওতিমা; এবং কাফকা্থর নায়করা; ব্যতিক্রম শুধু সেই তরুণ কার্ল রোজম্যান যিনি তার পরিচারিকাকে অন্তঃসত্ত্বা করেছিলেন কিন্তু সন্তানটিকে তিনি জীবন থেকে মুছে ফেলেছিলেন, তারপর পালিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকায় এবং উপন্যাসের জন্ম হয়।
এই বন্ধ্যাত্ব কিংবা অনুর্বরতা ঔপন্যাসিকদের কোনও সচেতন উদ্দেশ্য সাধনের জন্য হয় বরং এটিই হচ্ছে উপন্যাসের শৈলী (কিংবা উপন্যাসের সাব–কনশাস, দি আর্ট অফ নভেল) যা প্রজননকে প্রত্যাখ্যান করে।
উপন্যাস আধুনিককালে জন্মগ্রহণ করেছিল, জন্মে সে মানুষকে তৈরি করেছিল, হাইডেগারকে উদ্ধৃত করে বলতে হয়– ব্যক্তি যা ‘একমাত্র বাস্তব বিষয়’ এবং সবকিছুর মূল ভিত্তি।
মূলত উপন্যাসের মাধ্যমেই ইউরোপের মানুষ ‘ব্যক্তি’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
উপন্যাসের বাইরে, আমাদের বাস্তব জীবনে, আমাদের জন্মের আগে আমরা আমাদের পিতামাতাদের সম্পর্কে খুব কমই জানতে পারি; আমাদের কাছের মানুষদের সম্পর্কে আমাদের অল্পবিস্তর জানাশোনা থাকে– আমরা কেবল তাদের আসা–যাওয়া দেখতে পাই, এবং তাদের তারা আমাদের থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যান তখন তাদের জায়গায় অন্য মানুষরা চলে আসেন; এভাবে চাপা পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া মানুষরা একটা দীর্ঘ লাইন তৈরি করেন। এক্ষেত্রে উপন্যাস ব্যতিক্রম– উপন্যাস ব্যক্তিকে আলাদা করে।
শুধুমাত্র উপন্যাস একজন ব্যক্তিকে আলাদা করে, তার জীবনস্মৃতি, তার ধ্যান–ধারণা, তার অনুভূতি– সমস্তকিছুর উপর আলো ফেলে, তাকে অমোঘ, অপরিবর্তনীয় করে তোলে: তাকে সবকিছুর কেন্দ্র করে তোলে।
সার্ভেন্তেসের দন কিহোতো মারা যান এবং উপন্যাসটি শেষ হয়; কিহোতো নিঃসন্তান বলেই এই সমাপ্তি পুরোপুরি নিশ্চিত; সন্তান থাকলে কিহোতোর জীবন নিশ্চিত দীর্ঘায়িত হবে, অনুকরণ করা হবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে, রক্ষা করা হবে কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে; বাবার মৃত্যু বহু দরোজা খুলে রেখে দেয়; আমাদের শৈশবে এই কথা বলা হয়েছিল– তোমার জীবন অবিরাম চলতে থাকবে তোমার সন্তানদের মধ্যে, সন্তানরাই তোমার প্রকৃত অমরত্ব।
কিন্তু আমার গল্প যদি আমার নিজের জীবনকে ছাপিয়ে অন্য জীবনকেও স্পর্শ করে, এর মানে তো এই– আমার জীবন স্বাধীন বা স্বতন্ত্র সত্তা নয়; তার মানে– এ জীবন অসম্পূর্ণ, জীবন অপূর্ণ; এবং এর মানে হলো সম্পূর্ণরূপে বাস্তব, সুনির্দিষ্ট এবং পার্থিব এমন কিছু আছে যার মধ্যে ‘ব্যক্তি’ মিশে যায়, মিশে যেতে সম্মত হয়, এর মধ্যে হারিয়ে যেতে সম্মত হয়: পরিবার, বংশধর, উত্তরসূরি, গোষ্ঠী, জাতি। এর মানে হল যে স্বতন্ত্র ব্যক্তি যা ‘সবকিছুর মূল ভিত্তি’ হলো এক বিভ্রম, এক জুয়া, মাত্র কয়েক ইউরোপীয় শতাব্দীর স্বপ্ন।
গার্সিয়া মার্কেজের ‘শত বছরের একাকীত্ব’ উপন্যাসে উপন্যাসের শিল্প (কিংবা– শৈলী) সেই স্বপ্ন থেকে উদ্ভুত বলে মনে হয়; সমস্ত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু তখন আর একজন ব্যক্তি (ইন্ডিভিজ্যুয়াল) নয় বরং ব্যক্তি–সমবায় যেন এক বিরাট মিছিল; প্রত্যেকেই তারা অরিজিনাল, অনবদ্য, অননুকরণীয় এবং শেষ পর্যন্ত তারা সকলেই এক একজন নদীবক্ষে সূর্যকিরণের সংক্ষিপ্ত ঝলকানি মাত্র; প্রত্যেকেই তারা তাদের তার ভবিষ্যৎ–বিস্মৃত ‘আত্ম’কে নিজেদের সঙ্গে বহন করে, এবং প্রত্যেকেই তারা এ সম্পর্কে সচেতন, তারা কেউই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের মঞ্চে থাকে না; পুরো জনগোষ্ঠীর জননী বয়োবৃদ্ধা উরসুলা, তিনি যখন মারা যান তার বয়স তখন একশ বিশ বছর, এবং এটা হয় উপন্যাস সমাপ্ত হওয়ার বহু বছর আগে; এবং উপন্যাসে সমস্ত চরিত্রের একই নাম– হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া, হোসে আর্কাদিও, দ্বিতীয় হোসে আর্কাদিও, আউরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়া, দ্বিতীয় আউরেলিয়ানো– নামগুলো এইরকম যে তাদের সক্রিয়–অবস্থানগুলো ঝাপসা হয়ে যায় এবং পাঠক তাদের বিভ্রান্ত করে।
চরিত্রদের উপস্থিতির কাছে ইউরোপীয় ব্যক্তিবাদের যুগ কিছুতেই আর তাদের যুগ থাকে না।
কিন্তু, তাদের যুগ কোনটি– যা আমেরিকার ইন্ডিয়ানদের অতীত থেকেও পেছনে ফিরে যায়? নাকি ভবিষ্যতের কোনও যুগ যখন ব্যক্তি মানুষ ‘মানবের’ (মানব–সমাজ) সঙ্গে মিশে যাবে? ‘শত বছরের একাকীত্ব’ সম্পর্কে আমার অনুভূতিটি এমন যে এই উপন্যাসটি ‘উপন্যাসের শৈলী’র একটি আপথিওসিস (বা শৈলীর– সর্বোচ্চ শৃঙ্গ বা মহিমান্বিতকরণ) এবং, একই সঙ্গে উপন্যাসের যুগের সমাপ্তিকেও চিহ্নিত করে।