ইসলাম ও মানবাধিকার মানবাধিকার অর্থ:
মানবাধিকার অর্থ মানুষের অধিকার, পৃথিবীর সব দেশের সকল মানুষের ন্যূনতম যে অধিকারগুলো সর্বজনস্বীকৃত তারই নাম মানবাধিকার। আরবি ভাষায় এটাকে “আল হুকুকুল ইনসানিয়্যাহ” বলা হয়। মানবাধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার, মানুষের জন্মগত অধিকার, এটি নির্দিষ্ট কোন দেশ জাতি গোষ্ঠী শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের অধিকার নয়। এ অধিকার সকল মানুষের জন্য সমান ভাবে প্রাপ্য। ইসলামের মানবাধিকার জাতীয় আন্তর্জাতিক কোন ঘোষণা পত্র ও দলীলের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়নি, ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা স্বীকৃতি লাভের প্রায় তেরশত বৎসর পূর্বে সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ঐশীগ্রন্থ মহাগ্রন্থ আল কুরআন ও বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী বিশ্বশান্তির অগ্রদূত রাহমাতুল্লীল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বমানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তা বিশ্ব ইতিহাসে অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে ও থাকবে।
আল কুরআনে মানবাধিকার:
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন দর্শন, ইসলামে মানবাধিকার ধারণা ব্যাপক, বিস্তৃত ও পূর্ণাঙ্গ। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশনা সুস্পষ্ট। একই সাথে এ অধিকার মানুষের আইনগত অধিকার হিসেবেও সুপ্রতিষ্ঠিত। আজকের আলোচনায় কুরআন ও হাদীসের আলোকে মানবাধিকারের মৌলিক বিষয়াদির আংশিক আলোচনার প্রয়াস পাচ্ছি।
মানুষ জন্ম গতভাবে সমান:
ইসলাম প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা ও অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে, একই ভাবে মানুুষের জাতীয় পরিচয়কে তুলে ধরেছে, পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে মানবমন্ডলী! আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের কে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সেই অধিক মর্যাদা সম্পন্ন যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়া সম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহ তো সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১৩)
ইসলামে বেঁচে থাকার অধিকার:
ইসলাম মানব হত্যাকে নিষিদ্ধ করেছে। খুন–খারাবী, রক্তপাত, হত্যাকান্ডকে জঘন্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ইসলামে ইচ্ছাকৃত হত্যাকারীকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করার বিধান দেয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মু’মিন ব্যক্তিকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। যেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন এবং তাকে লানত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন। (সূরা: নিসা, আয়াত: ৯৩)
অন্য আয়াতে করীমায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল, আর যে তাকে বাঁচাল সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল। (সূরা: আল মায়িদা, আয়াত: ৩২)
মান সম্মান রক্ষার অধিকার:
মানব জাতির মান সম্মান ইজ্জত আবরুর সংরক্ষণ করা প্রতিটি নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। ইসলাম অন্যজনকে অন্যায়ভাবে কটুক্তি করা অসম্মান করা, কারো প্রতি অশালীন আচরণ করা কাউকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, কারো গীবত সমালোচনা করা, কারো গোপনীয়তা ফাঁস করা, কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা ইত্যাদি গর্হিত আচরণকে অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করেছে, এ ধরনের নিকৃষ্ট আচরণকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে ঈমানদারগণ! কোন পূরুষ যেন অপর কোন পূরুষকে উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে এবং কোন নারী অপর কোন নারীকেও যেন উপহাস না করে কেননা যাকে উপহাস করা হয় সে উপহাসকারিনী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ করোনা এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ নামে ডেকোনা। (সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১১)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেছে, “তোমরা একে অপরের অনুপস্থিতিতে নিন্দা করনা। তোমরা বহুবিধ অনুমান থেকে দূরে থাক, কেননা অনুমান কোন কোন ক্ষেত্রে পাপ।” সূরা: হুজরাত, আয়াত: ১২)
নৈতিকতার অবক্ষয়ের এ নাজুক সন্ধিক্ষণে বর্ণিত আয়াতে মানব জাতির জন্য পারিবারিক সামাজিক রাজনৈতিক ও জাতীয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সুশৃঙ্খল পরিবেশ, সুন্দর ব্যবস্থা পারস্পরিক সৌহার্দ্য সম্প্রীতি শান্তি আদর্শ পরিবার, সমাজ জাতি ও দেশ গঠনের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। আজকে ব্যক্তি পর্যায়ে ও সমাজ জীবনে পারস্পরিক দোষারোপ সংস্কৃতি, যে কোনো বিষয়ে সন্দেহ প্রবণ হওয়া, দ্বিধা দ্বন্দ্ব সংশয় পোষণ করা, এক পর্যায়ে সন্দেহ প্রবণতা থেকে সম্পর্কের অবনতি ও দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া, পর্যায়ক্রমে পারস্পরিক ঘৃণা ক্ষোভ থেকে অপরের মান সম্মান জান মালের ক্ষতি সাধন করা ইত্যাদি অসৎ চরিত্র ধারণ ও লালন করা, নিকৃষ্ট চরিত্রের পরিচায়ক। যা মানুষকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করে। ইসলাম এমন নিন্দনীয় অপকর্ম সর্বাত্নকভাবে পরিহার করার নির্দেশ করেছে।
সুবিচার প্রাপ্তির অধিকার:
সমাজে শান্তি সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যেখানে ন্যায় নীতি ও ইনসাফ নেই সেখানে শান্তি নেই। ইসলামে আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা ফরজ। কথা বার্তা কাজ–কর্ম আচার আচরণ লেন দেন প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায় নীতি অনুসরন করা, সীমা লংঘন না করা, কাউকে তার ন্যায্য হক থেকে বঞ্চিত না করা পবিত্র কুরআনের নির্দেশ ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহান আদর্শ ও শিক্ষা। বিচার কার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে দূর্নীতির আশ্রয় নেওয়া, স্বজন প্রীতি করা, পক্ষপাতিত্ব করা মারাত্মক গর্হিত অপরাধ যা ইসলামে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’লালা এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা তোমাদের কে আদেশ দিচ্ছেন আমানত সমূহ তার হকদারের কাছে পৌছে দিতে আর যখন মানুষের মধ্যে বিচার কার্য ফায়সালা করবে তখন ন্যায় ভিত্তিক বিচার কার্য পরিচালনা করবে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের কতই না সুন্দর উপদেশ দিচ্ছেন নিশ্চয় আল্লাহ সর্ব শ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা, নিসা, আয়াত: ৫৮)
রাগান্বিত অবস্থায় সুবিচার বাধাগ্রস্ত হয়:
ক্ষোভ ও ক্রোধের বশীভূত হয়ে বিচার কার্য সম্পাদন করা হলে, ন্যায় বিচার আশায় করা যায় না। এতে সুবিচার থেকে এক পক্ষ বঞ্চিত হবে। ইসলাম রাগান্বিত অবস্থায় বিচার কার্যকর করা সমর্থন করা অনুমোদন করেনা, বরং রাগের অবস্থায় বিচার করা কবীরা গুনাহ ও হারাম। হাদীস শরীফে এ বিষয়ে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবু বকরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু বাকরাহ তাঁর পুত্রকে লিখে পাঠালেন তখন তিনি সিজিস্তানে অবস্থান করছিলেন তুমি রাগান্বিত অবস্থায় দুব্যক্তির মাঝে বিচার কার্য ফায়সালা করাবেনা। কেননা আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে কোনো বিচারক যেন রাগান্বিত অবস্থায় দুব্যক্তির মধ্যে বিচার মীমাংসা না করে। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৭১৫৮)
মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সুবিচার কায়েম করা:
যেখানে সুবিচার প্রতিষ্ঠা হবেনা সেখানে মানুষ শোষণ ও বঞ্চণার শিকার হবে। ন্যায় পরায়ন শান্তিকামী মানুষ গুলো জুলুম নির্যাতনের শিকার হবে। নিজের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হবে। সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হলে পরিবার ও সমাজে আদর্শ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা পাবে। শ্রদ্ধা সম্মান ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পাবে। সমাজ আলোকিত হবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন নিশ্চয়ই যারা ইনসাফ ও ন্যায় বিচার করে আল্লাহর নিকট তারা নূরের মিম্বরে আসন গ্রহন করবে। এরা হচ্ছে এমন সব লোক যারা তাদের বিচার কার্য মীমাংসার ক্ষেত্রে পরিবার পরিজনের ব্যাপারে এবং যে সব দায় দায়িত্ব তাদের উপর অর্পিত হয় সে সব বিষয়ে ন্যায় পরায়নতা ও সুবিচার করে। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস: ৫৩৭৯)
ইসলাম শিক্ষার অধিকার, নারীর অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, পারিবারিক অধিকার, সামাজিক অধিকার, রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক অধিকার, প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় যে অবদান ও ভূমিকা রেখেছে তা এক গৌরবোজ্জ্বল সোনালী অধ্যায় রচনা করেছে।
আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কুরআন সুন্নাহর শিক্ষা অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
ওবায়দুল করিম
বাহুলী, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: শোকাহত অবস্থায় নিজে ও পরিবারের জন্য কোন দুআটি পড়া উত্তম।
উত্তর: প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থ গুলোতে শোকাহত অবস্থায় নিম্নোক্ত দুআ পড়ার কথা উল্লেখ রয়েছে, “ইন্না লিল্লাহি মা আখাযা, ওয়া লাহু মা আতা ওয়া কুললু শাইয়্যিন ইন্দাহু বি আজলিন মুসাম্মা।” (বুখারী শরীফ, হাদীস : ১২০৩)
অর্থ: আল্লাহ যা নিয়ে গেছেন তা তাঁরই এবং যা কিছু দিয়েছেন তাও তাঁর নিকট, প্রতিটি বস্তুর সুনিদ্দিষ্ট সময় রয়েছে। শোকাহত ব্যক্তিকে ধৈর্য ধারণের জন্য নিম্নবর্ণিত দুআ পাঠ করবে। “উচ্চারণ: আ’যামাল্লাহু আজরাকা, ওয়া আহসানা জাযাআকা ওয়া গাফারা লি মাইয়্যিতিকা।” (ইমাম নাবভী)
আল্লাহ তোমাকে অনেক প্রতিদান নসীব করুন। তোমাকে উত্তম ধৈর্য্য শক্তি দান করুন। তোমার মৃত ব্যক্তিকে তিনি মাগফিরাত দান করুক।