বহমান সময়

ফজলুল হক | সোমবার , ১৪ আগস্ট, ২০২৩ at ৭:৩৭ পূর্বাহ্ণ

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আমি বঙ্গবন্ধুকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। সে সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর সাথে চট্টগ্রামের একটি গভীর রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়। ১৯৬৬ সালে লাহোরে ছয় দফা প্রস্তাব উত্থাপন করার পর বঙ্গবন্ধু এবং তার সাথে থাকা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মীরা ভীষণ বিপদে পড়ে যায়। তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার ছয় দফা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তিনি এবং তাঁর সঙ্গীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় কোনও রকমে ফিরে আসেন। ঢাকায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা ছয় দফার পক্ষাবলম্বন করেননি। আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটিতে ছয় দফাকে সমর্থন প্রদানের ব্যাপারে যে সকল নেতা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কাজ করছিলেন তার মধ্যে প্রধান শক্তির সঞ্চার করেছিলেন চট্টগ্রামের নেতারা।

মুসলিম লীগের সমর্থক পরিবারের সংখ্যা চট্টগ্রামে অনেক বেশি ছিল। ধনী পরিবারের প্রায় সকল মানুষ মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। তখন আমাদের পতেঙ্গা হালিশহর এলাকায় এম এ আজিজের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কিছু সমর্থক সংগঠিত হয়। তারা সকলেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি অনুগত ছিলেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় পতেঙ্গা হালিশহরের মানুষ আওয়ামী লীগের পক্ষে বিপুল সমর্থন প্রদর্শন করেছিল। পতেঙ্গা হালিশহর এলাকায় লেখালেখির সাথে যুক্ত মানুষের সংখ্যা নগণ্য ছিল। শরিফ রাজা এবং মাত্র দুই একজন মানুষ ছাড়া, সাংবাদিকতা পেশার সাথে বা লেখালেখির সাথে যুক্ত মানুষ কম থাকায়, সেই সময়ের ইতিহাস ঠিকমতো রচিত হয়নি এবং তা সংরক্ষণও করা হয়নি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠনের পর, এম এ আজিজ এবং তাঁর অনুগত কর্মীরা পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন, আরমানিটোলা এবং মোগলটুলি এলাকায় আওয়ামী লীগের জন্য প্রচুর কাজকর্ম করছেন। আমি দেখেছি বঙ্গবন্ধু ঘনঘন চট্টগ্রামে আসতেন। তখন তিনি শাহজাহান হোটেলে থাকতেন। অনেকবার উনার পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে হালিশহরে এম এ আজিজের বাড়িতে আসতেন। ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুর্গে পরিণত হতে থাকে। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুর বড় ভাই বশিরুজ্জামান একজন বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। তার সাথে এম এ আজিজের গভীর সম্পর্ক ছিল। জুপিটার হাউস নামে ফিরিঙ্গিবাজারে তাঁদের একটি বাড়ি ছিল। এ বাড়িতে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের আসা যাওয়া ছিল। ১২০ নম্বর আন্দরকিল্লায় দোতলা ভবনে তৎকালীন সময়ে এম এ আজিজ আওয়ামী লীগের অফিস চালু করেন।

৬ দফা আন্দোলনের আগে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বেসিক ডেমোক্রেসি নির্বাচন ঘোষণা করেন। বেসিক ডেমোক্র্যাসি বা মৌলিক গণতন্ত্র নামক ব্যবস্থার মূল কথা ছিল, সারা পাকিস্তানে ‘বিডি মেম্বার’ নামে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করা হয়। তাদের ভোটে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথা চালু করা হয়। সেই নির্বাচনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কৌশলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের আরও কিছু স্বৈরশাসক বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, জিন্নাহর বোন মাদারে মিল্লাত ফাতেমা জিন্নাহকে আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এবং জেনারেল আজম খান ফাতেমা জিন্নাহকে চট্টগ্রামে এনেছিলেন। চট্টগ্রামে লালদিঘি ময়দানে স্মরণাতীত কালের বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এবং ফাতেমা জিন্নাহকে বহনকারী ট্রেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছাতে ৩ দিন সময় লেগেছিল। ঢাকা চট্টগ্রাম রেলপথ জুড়ে লক্ষ লক্ষ জনতা বঙ্গবন্ধু এবং ফাতেমা জিন্নাহকে দেখার জন্য ট্রেনটিকে ঘিরে ধরেছিল। লালদিঘির ময়দানে জনসভা আয়োজনের নেতৃত্বে ছিলেন এম এ আজিজ। সে জনসভায় চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে অসংখ্য মানুষ যোগ দিয়েছিল। সকাল ১০টার দিকে বঙ্গবন্ধু এবং ফাতেমা জিন্নাহকে বহনকারী ট্‌্েরন চট্টগ্রামের বটতলী রেল স্টেশনে পৌঁছালে আগ্রাবাদ থেকে রেল স্টেশন পর্যন্ত ভিড় পরিলক্ষিত হয়। এত বড় জনসভা ওই সময় লালদিঘির ময়দানে আর কেউ দেখেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বেসিক ডেমোক্রেসি নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহ পরাজিত হয়েছিলেন।

১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আইয়ুব খান পাকিস্তানকে একটি দুর্বিষহ রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখেও আইয়ুব খান গদি রক্ষা করতে পারেনি। ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাকে বিদায় নিতে হয়ে ছিল। পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে সেনাবাহিনী রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপরে সবসময় জবরদস্তি করে এসেছে। অসাংবিধানিক এবং অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের নির্মম শোষণকে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরে পরিপূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি করে এসেছিলেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠিত হওয়ার পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার চেষ্টা করেন। যুক্তফ্রন্টের সময় ২১ দফা দাবি উত্থাপন করেন। পাকিস্তানকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছিল। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠনের আগে দুই বছর মুসলিম লীগ অন্তর্কোন্দলের মধ্যে সময় পার করেছে। আওয়ামী লীগ গঠনের ব্যাপারে তরুণ বঙ্গবন্ধুর অনেক ভূমিকা ছিল। তখন চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু সমর্থক নেতারা সক্রিয়ভাবে মানুষকে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। ৬ দফা আন্দোলন শুরু হওয়ার পর আওয়ামী লীগের উপরে অত্যাচার শুরু হয়। ৬ দফা প্রস্তাব ঘোষণা করার জন্য চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠকে বেছে নেওয়া হয়। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে আসেন। লালদিঘি মাঠের জনসভায় তিনি ৬ দফা ঘোষণা করেন। লালদিঘির মাঠে হাজার হাজার চট্টগ্রামবাসীর সামনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমরা আমাকে ২০০০ কর্মী দাও, আমি তোমাদের ৬ দফা বাস্তবায়ন করে দেব। ৬ দফার মূল বক্তব্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তান, পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করছে এবং বাঙালিদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের ব্যাপক বৈষম্য সৃষ্টি করছে। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তান নানা দিক থেকে প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল মরুভূমির মতো। এই বৈষম্যের বিষয়টি তৎকালীন মুসলিম লিগ পরিবারগুলিকে প্রভাবিত করতে না পারলেও তরুণ এবং যুবকদের মধ্যে আওয়ামী লীগের এই বক্তব্য ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে।

চট্টগ্রামের কলেজগুলিতে তখন নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতো। সেই নির্বাচনে কয়েকটি ছাত্র সংগঠন সক্রিয়ভাবে অংশ নিত। যার মধ্যে প্রধান দল ছিল ছাত্রলীগ এবং অন্যতম প্রধান দল ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। তারা বিভিন্ন ছদ্মনামে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতো। সরাসরি ছাত্রলীগ বা ছাত্র ইউনিয়নের নামে রাজনীতি করা তখন কঠিন ছিল এবং স্বনামে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে গেলে বড়লোকের ছেলেরা আসত না। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। তারা ছয় দফার বিরোধিতা করতো। কিন্তু চট্টগ্রামের প্রায় সকল কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিজয়ী হতো। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে দ্রুত ৬ দফার দাবি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল জেলায় ৬ দফার বক্তব্য নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। কিন্তু অল্প সময় পরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। এবং ১৯৬৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে আসলে হালিশহরে এম এ আজিজের বাড়িতে আসতেন। চট্টগ্রামে ইউসুফ মিয়া, সুলতান কনট্রাক্টরসহ বঙ্গবন্ধুর অনেক একান্ত আপনজন ছিল। চট্টগ্রামের আরেক আওয়ামী লীগ নেতা এবং শ্রমিক ফ্রন্টের একজন। ১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু একটানা কারাগারে বন্দি ছিলেন। তখন তাঁর পরিবারের এবং দলের কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ করা একটি কঠিন ব্যাপার ছিল। তহবিল সংগ্রহের জন্য চট্টগ্রামে ছয় দফা কুপন চালু করা হয়। চট্টগ্রামের মানুষ বিপুল আগ্রহ সহকারে এই কুপন ক্রয় করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে আর্থিকভাবে সহায়তা করে। পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন চিত্রকর্ম ছাপিয়ে মানুষের কাছে বিলি করা হয়। শিল্পী সাবিহ উল আলম এবং এম এ হান্নান এই কাজে মনোযোগী ছিলেন। এম এ আজিজের পরামর্শে, বন্দি শেখ মুজিবকে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য এম এ আজিজ মুজিব দিবস ঘোষণা করেন। তখন লালদিঘির মাঠের নাম পরিবর্তন করে মুজিব পার্ক রাখা হয়েছিলো। বাস কন্ট্রাক্টাররা যাত্রী নামানোর সময় ‘মুজিব পার্ক’ বলে ডাক দিতো।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করতে গেলে এই লেখা কখনও শেষ হবে না। ১৯৭১ সালের ১১ই জানুয়ারি এম এ আজিজের মৃত্যু হলে বঙ্গবন্ধু হেলিকপ্টারে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। মুজিব তখন কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। মুজিবের বন্দি অবস্থায় এম এ ওয়াজেদ এর সাথে শেখ হাসিনার বিবাহের পর অনুষ্ঠান হয়েছিল চট্টগ্রামের রাইফেল ক্লাবে। নবদম্পতিকে ১টি গাড়ি উপহার দেওয়া হয়েছিল। আমার এখনও মনে আছে, এম এ আজিজের মৃত্যুবার্ষিকীতে হালিশহরের বাড়ির সামনে মুজিব কোট পরা বঙ্গবন্ধু এবং এম এ হান্নান হেলিকপ্টার থেকে নামছেন। চট্টগ্রামের মানুষের সাথে বঙ্গবন্ধুর সেই ঘনিষ্ঠতার কথা আমরা কখনও ভুলতে পারি না।

লেখক: শিক্ষাবিদ, কলাম লেখক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ,

সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম,

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা-মানবিক ও বিজ্ঞান
পরবর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ এর অন্ত্যমিল