বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত এই নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের গবেষণার ফসল হলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। কোনো বাঙালি আর বাঙালিদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে পারেননি বিধায় তিনিই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এদেশের আপাময় জনসাধারণের মুক্তির যে কথা তিনি বলতেন তা শুধু রাজনৈতিক কোনো দৃষ্টিকোণ থেকে নয় বরং তা তিনি বলতেন তাঁর নিজস্ব গবেষণার আলোকে। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু যে ৬ দফা মুক্তির সনদ জাতির সামনে পেশ করেছিলেন সেখানেও তিনি যুক্ত করেছিলেন দেশ বরণ্যে গবেষকদের। সেই সাথে তাঁর প্রজ্ঞা মেধা মননের সমাহারে ৬ দফা হয়ে উঠেছিলো বাঙালির মুক্তির সনদ। যার পথ ধরে বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা। এই ৬ দফা প্রণয়নে দেশ বরেণ্য অনেক গবেষককে তিনি সম্পৃক্ত করেছিলেন এবং সাথে তিনি নিজেও যুক্ত থেকে প্রমাণ করছিলেন তিনি শুধু একজন রাজনীতিকই নন একজন গবেষকও বটে। গবেষণা ভিত্তিক জ্ঞানের সমন্বয়ের জন্য তাঁর এ প্রচেষ্টায় ৬ দফা পেয়েছিলো এক নতুন মাত্রা। একজন শিক্ষা গবেষকও তাঁর খ্যাতি হতে পারে পর্বত সমান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো গবেষণা কেন্দ্রে শুধু গবেষণার মত বিষয়টা গুটি কয়েক শিক্ষাবিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে না। একটি রাজনীতিকও তাঁর প্রজ্ঞা দূরদৃষ্টির সমন্বয়ে হয়ে উঠতে পারেন গবেষক। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পাশ কাটিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন। একটি অসামপ্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলন করতে তিনি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গঠন করেন ড. কুদরত–ই–খুদার নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন। স্বাধীনভাবে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকর্ম পরিচালনার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন অর্ডিন্যান্স ঘোষণা করেন। এইগুলো তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে একটি পরিশীলিত চিন্তা ভাবনারই ফসল। একটি শিক্ষাবিদ গবেষক যে কাজটি করেন তিনি যেন শিক্ষা ব্যবস্থার কাণ্ডারি হয়েই সে কাজটি করেছিলেন। একজন গবেষক শুধু সে গবেষণা সংক্রান্ত কাজগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। স্বাধীনতার পর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দেন উচ্চ শিক্ষাকে। বাংলাদেশ ছিলো বঙ্গবন্ধুর গবেষণার পাঠশালা, আর তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো বাংলার মানুষ এবং মানুষের অধিকার। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষা ও বিজ্ঞান বিষয়ক বহুমাত্রিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান। দেশে উচ্চ শিক্ষা এবং গবেষণা প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মহান জাতীয় সংসদে ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ (আইবিএস) নামক একটি বিল পাশ করেন। এটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র বিধিবদ্ধ গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং এটি বাংলাদেশ বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার একমাত্র কেন্দ্র। বাংলাদেশের ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, নৃ–তত্ত্ব, ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে এটি প্রতিষ্ঠিত। পোস্ট গ্রাজুয়েট মর্যাদার এই প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়–দফতর থেকে গবেষকগণ এই প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে গবেষণা করার সুযোগ পান। শেখ মুজিবুর রহমানের আইবিএস প্রতিষ্ঠা হলো একটি দূরদর্শী গবেষণাধর্মী চিন্তারই ফসল। বঙ্গবন্ধুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা দর্শনের প্রভাবে ১৯৭৫ সালে বেতবুনিয়া ভূ–উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়। প্রযুক্তির প্রসার এবং প্রযুক্তি নির্ভর উদীয়মান শিল্প বিপ্লবকে গ্রহণ করতে তাঁর পরিকল্পনার ধারাবাহিকতায় আজ মহাকাশে আমাদের ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট’। বঙ্গবন্ধু গবেষণামনস্ক ও উন্নত ধারণা দ্বারা প্রভাবিত শিক্ষানীতি প্রণয়নের উদ্যোক্তা। তিনি মনে করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শুধু শিক্ষাদানের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবেন না; বরং গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন। এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কর্মমুখী শিক্ষার উন্নয়নে গবেষণার ধারণাকে প্রাধান্য দিয়ে কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করেছেন। গবেষকদের কার্যক্রমের সাথে যুক্ত থেকে তিনিও হয়ে উঠেছিলেন মাঠের রাজনীতিক ও মাঠের গবেষক। বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞানী না হলেও বিজ্ঞান ও গবেষণার নতুন ধারণা সৃষ্টিতে যেমন নিজের ভাবনাকে কাজে লাগিয়েছেন, তেমনি তাঁর গবেষণার ভাবনা দ্বারা মানুষকে তাড়িত করে নতুন নতুন গবেষক তৈরিতে ভূমিকা রেখেছেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টা গবেষকদের চেয়ে নেহায়েত কম নয়। ১৯৭৩ সালে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন তাঁর হাতেই সৃষ্টি। বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতা ও গভীর দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সে সময় সাভারে ২৬৫ একর জমি পরমাণু গবেষণার জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হয়। এখন দেশের বৃহত্তর পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সগৌরবে আলো ছড়াচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃতেই বাংলাদেশে পরমাণু গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বঙ্গবন্ধুর গবেষণাসমৃদ্ধ এ স্বপ্নকে ধারণ করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রযাত্রা। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না; বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বোঝায়।’ তাঁর কৃষি গবেষণালব্ধ ধারণা থেকেই কৃষিবিষয়ক সব সংস্থার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল’ জন্ম লাভ করে। কৃষি গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ডসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। এ প্রতিষ্ঠানগুলো বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনা ও গবেষণাধর্মী কর্মেরই ফসল। দেশে ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে একটি আইন পাস করেন। এই আইনের মাধ্যমে ‘ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট’কে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। মূলত ধানের ওপর নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা তখন থেকেই শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর নিজস্ব ভাবনায় নতুন নতুন জাতের খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের যে প্রক্রিয়া শুরু করেন, তা আজও গবেষকদের নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস। পাটের ফাইবার বা আঁশ নিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে যে গবেষণা তা বঙ্গবন্ধুর চিন্তা চেতনারই ফসল। বঙ্গবন্ধুর গবেষণা ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সে সময়ে বিজ্ঞানীরা ও গবেষকরা দেশীয় উপাদানগুলোকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে নতুন ধারার পাট নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। মাঠের রাজনীতিক থেকে মাঠের গবেষক হিসাবে তাঁর অবদান কম নয়। কোনো পরীক্ষাগারের চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে গবেষণা করার মানুষ তিনি হয়তো ছিলেন না, কিন্তু তাঁর গবেষণালব্ধ চিন্তা চিন্তাচেতনাকে বাস্তবে রূপায়িত করতে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গবেষকদের সম্পৃক্ত করে তাঁদের সাথে হয়ে উঠেছিলেন নিজেও গবেষক। তাঁর গবেষণাধর্মী ভাবনার সুদূরপ্রসারী ফল জাতি হিসাবে আমরা ভোগ করছি এবং একজন গবেষক বঙ্গবন্ধু হিসাবে তাঁর জন্য আমরা গর্বিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, বি এম সি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।