পরিবহন মালিক–শ্রমিকদের চাপের মুখে পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেছে সরকার। ফলে ২০ বছরের পুরোনো বাস এবং ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক অবাধে চলতে পারবে সড়কে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনা ও পরিবেশ দূষণের বড় কারণ পুরোনো যানবাহন–এই বিবেচনায় ২০ বছরের পুরোনো বাস ও ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে গত ১৭ মে প্রজ্ঞাপন জারি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। পাশাপাশি একটি নীতিমালা করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়, যেখানে যানবাহনগুলো কী প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করা হবে (স্ক্র্যাপ), তা ঠিক করার কথা ছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ও ট্রাক–কাভার্ড ভ্যান পরিচালনায় যুক্ত একাধিক মালিক সমিতি পুরোনো যানবাহন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। সংগঠনগুলো পুরোনো যানবাহন তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে চিঠি দেয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয় আগের প্রজ্ঞাপন স্থগিত করে।
প্রকাশিত খবরে বলা হয়, বাস ও ট্রাকের চলাচলের বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার পর বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) একটি তালিকা করেছে। এতে দেখা গেছে, ২০ বছরের সীমা নির্ধারণ করা হলে ৩৩ হাজার ১৭৪টি বাস–মিনিবাস রাস্তা থেকে উঠে যাবে। আর ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাকের সংখ্যা ৩০ হাজার ৬২৩টি।
বিআরটিএর তথ্যমতে, সারা দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখের কাছাকাছি। এর মধ্যে বাস–মিনিবাসের সংখ্যা ৮১ হাজার ৮৪৭। হিসাব করে দেখা যায়, বাস–মিনিবাসের প্রায় ৪১ শতাংশই ২০ বছরের পুরোনো। অন্যদিকে দেশে নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরির সংখ্যা ২ লাখ ২ হাজার ৭৭২। এর মধ্যে ২৫ বছরের পুরোনো ট্রাক ১৫ শতাংশের মতো।
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের মতো সংগঠিত শক্তিকে রুষ্ট করতে চায়নি সরকার। এ কারণে তাদের দাবি মেনে পুরোনো যানবাহন তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সড়ক–মহাসড়কে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তার অন্যতম কারণ পুরোনো ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন। সড়ক–মহাসড়কগুলো মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়ার অন্যতম কারণও এসব যানবাহন এবং চালকদের অদক্ষতা। কর্তৃপক্ষের তরফে একদিকে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটছে না।
তাঁরা বলেন, বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে পুরোনো যানবাহনের দায় অনেক বেশি। সেগুলো উঠিয়ে দিতে হবেই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের কথা ভাবা হয় না। তাঁরা বলেন, সিদ্ধান্তগুলো যাঁরা নেন, তাঁরা নিজেরাও বায়ুদূষণের ভুক্তভোগী, তাঁদের বয়স্ক মা–বাবা ভুক্তভোগী, তাঁদের শিশুসন্তানেরা ভুক্তভোগী।
বলা বাহুল্য, গাড়ির কালো ধোঁয়া বের হয়ে বাতাসের ধুলোবালিসহ অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশে বিষাক্ত রাসায়নিক বস্তুতে পরিণত হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যানবাহনের কালো ধোঁয়ার সঙ্গে বস্তুকণা, সালফার ডাই–অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড, সিসাসহ অন্যান্য ক্ষতিকর উপাদান বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে দ্রুত দূষিত হয় বাতাস। কালো ধোঁয়ায় থাকা বস্তুকণা ও সালফার ডাই–অক্সাইডের প্রভাবে ফুসফুস, কিডনি জটিলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি রয়েছে। এছাড়া নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড ও সিসার কারণে শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, ব্রঙ্কাইটিস ও শিশুদের বুদ্ধিবৃত্তি ব্যাহত হয়। বায়ুদূষণের ফলে এমন নানা রোগব্যাধি বাসা বাধে শরীরে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, জনগণের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যের দিকটি আমলে না নেওয়া অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। স্বার্থান্বেষী মহলের চাপে সরকার একের পর এক ভালো সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসায় জনগণই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পুরোনো যানবাহন চলাচলে কেবল জনস্বাস্থ্যই হুমকির মুখে পড়ছে না, দুর্ঘটনার মাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন দাপিয়ে বেড়ায় প্রায় আড়াই লাখ ভিন্ন–ভিন্ন যানবাহন। মেয়াদ নেই যার এক–তৃতীয়াংশেরই। এসব দেখা যাদের দায়িত্ব, তারা দায় চাপাচ্ছেন একে অন্যের ঘাড়ে। এভাবে চলছে বছরের পর বছর। তাই আইনের কঠোর প্রয়োগ ও জনসচেতনতায় জোর দিতে হবে। সরকার কঠোর না হলে এই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটবে বলেও মনে হয় না।