যা কখনো ঘটেনি এই দীর্ঘ ৩২ বছর হল্যান্ড অবস্থানে এবার তাই ঘটলো। এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দেব, দুয়ারে গড়ি দাঁড়ায়ে। সব প্রস্তুত। দোতালার বেডরুম থেকে বের হবার মুখে রাখা সবকটি বড় লাগেজ। সেগুলি পাশ কেটে নিচে ড্রয়িং রুমে যাবার সিঁড়ি। সিঁড়িতে কার্পেট। হঠাৎ পা গেল পিছলে। পতন তো না, একেবারে অধঃপতন। গড়িয়ে একেবারে নিচ তক। ড্রয়িং রুমে ছিল অতীশ, সে দৌড়ে আসে। উঠে দাঁড়িয়েছি। মনে হলো তেমন কিছু হয়নি। অগস্ত্য যাত্রা নয় তো? মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে দেশের উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট যাবো। উদ্দেশ্য আমেরিকা থেকে আসা মেজদার একমাত্র ছেলে অভির ঢাকায় বিয়ে এবং চাটগাঁয় সমপ্রতি প্রকাশিত ‘হল্যান্ড থেকে’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। যাত্রার শুরুতেই এমন দুর্ঘটনা কোন অশনি সংকেত নয়তো? বাবা এই সমস্ত কুসংস্কার খুব বিশ্বাস করতেন। বাসা থেকে বের হবার সময় কেউ যদি হাঁচি দিত কিংবা পেছন থেকে কেউ যদি ডাকতো, তিনি ভীষণ রেগে যেতেন। মন্দ কিছু ঘটবে তেমনই ছিল তার বিশ্বাস। ঐসব কুসংস্কারে বিশ্বাস নেই, তারপরও মনের মধ্যে খচখচ করতে থাকে। ঢাউস সাইজের টেক্সী। লিমোজিনের মত ভেতরে মুখোমুখি বসার সিট। পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে শিফল এয়ারপোর্টে আমাদের নামিয়ে দেয় সুরিনামী ড্রাইভার। হেগ শহর থেকে আমস্টারডাম শিফল এয়ারপোর্টের দূরত্ব ৪৫ কিলোমিটার। আগ বাড়িয়ে অন–লাইন চেকইন করা ছিল। এয়ারপোর্টে আমাদের সাথে যোগ দিল সপ্তর্ষি। সে থাকে উত্রেক নামে ভিন্ন এক শহরে। দেশে যাবার আনন্দ তো আছে, কিন্তু এবার আমার বিশেষ ভালো লাগা, সবাইকে একসাথে নিয়ে যাওয়া। ছেলে–মেয়েদের ব্যস্ততা আমাদের চাইতেও বেশি। তার উপর দেশ তো তাদের আমার মত টানেনা। কিন্তু দেশের প্রতি তাদের আকর্ষণ কোন অংশেই কম না। তাদের আগ্রহে কোন ঘাটতি ছিলনা, বরঞ্চ বেশি, বিশেষ করে অভির বিয়ের কারণে।
নির্দিষ্ট সময়ে এমিরেটস এয়ারলাইনসসের বিশাল উড়োজাহাজ প্রচন্ড শব্দে উড়াল দেয়। আমাদের ট্রানজিট দুবাই। সেখানে চার ঘন্টা অবসর। তারপর আবারো প্লেনে চড়তে হবে, দুবাই টু ঢাকা, ঘন্টা সাড়ে–পাঁচেকের আকাশপথে উড়াল দেয়ার কথা। কিন্তু ওই যে ‘বিরাট শিশু’ যিনি কবি নজরুলের কথায় আনমনে আমাদের নিয়ে অবিরত খেলে চলেছেন, (খেলিছ এ বিশ্বলয়ে বিরাট শিশু আনমনে/প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা নিরজনে প্রভু, নিরজনে খেলিছ) হয়তো তিনি ভেবে রেখেছিলেন ভিন্ন। কেননা সবকিছু ঠিকঠাক। প্লেনে চড়ে বসেছি। খানিক বাদে ঘোষণা দেয়া হলো সিট বেল্ট বাঁধার। ধীর গতিতে রানওয়ে ধরে বিশাল জাহাজটি কেবল চলা শুরু করেছে। কিছুদূর যেতেই থেমে গেল। ভাবলাম হয়তো কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে ফাইনাল ক্লিয়ারেন্সের জন্যে অপেক্ষা করছে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, আমাদের অপেক্ষার সময় কাটেনা। এমন সময় ককপিট থেকে ঘোষণা এলো, টেকনিক্যাল কারণে যাত্রা বিলম্বিত হচ্ছে। একটা সময় ঘন্টা পেরিয়ে যায়। আর কোন ঘোষণা আসে না। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত সফট ড্রিংকস ও হালকা কোন খাবার/বাদাম সার্ভ করা হয়। কিন্তু না, তেমন কোন কিছু সার্ভ করা হয়না। আসেনা কোন ঘোষণা। প্লেনের ভেতর সবাই বসে, পাক্কা তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখার পর ঘোষণা দেয়া হলো, ‘টেকনিক্যাল সমস্যা দেখা দেয়ায় আপনাদের সবাইকে এখন প্লেন ত্যাগ করতে হবে, সাথে আপনাদের নিজ নিজ ব্যাগ নিয়ে যাবেন। দুপুরের খাবারের জন্যে কার্ড দেয়া হবে আপনাদের সবাইকে। কার্ডে কয়েকটি রেস্টুরেন্টের তালিকা আছে, তাতে আপনারা আপনাদের পছন্দ মাফিক রেস্তোরাঁতে গিয়ে খেতে পারবেন।’ মনের মধ্যে যাত্রার শুরু থেকে যে কাঁটা বেঁধেছিল তা যেন আবার খোঁচা দিল। বিরক্তি আর ক্লান্তি নিয়ে প্লেন থেকে বেরিয়ে গেইটে পৌঁছুতেই এমিরাটসসের এক কর্মী হাতে কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ৪৫ মিনিটের মধ্যে আপনারা এই গেইটে ফিরে আসবেন। খাবারের চাইতে আমার বিরক্তি ছিল বেশি। কিন্তু অন্য কোন পথও নেই। এই ভেবে মনে মনে সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করি যে, আরো বড় ধরনের বিপদও তো হতে পারতো। উড়াল দেবার আগেই টেকনিক্যাল প্রব্লেম দেখা গেছে। সেই প্রব্লেম এখন ঠিক করছে। শূন্যে এই সমস্যা হলে যে তার পরিণাম কী হতো তা বোধকরি একমাত্র সেই ‘বিরাট শিশু’ জানতেন। তাই সৃষ্টিকর্তা যা করেন তা মঙ্গলের জন্যে করেন– এই ভেবে মনের বিরক্তিকে একপাশে রাখার চেষ্টা করি। অতীশ সপ্তর্ষি বেছে নেয় এশীয় রেস্তোরাঁ। খাবার শেষে ফিরে আসি গেইটে, আবারো খানিক অপেক্ষার পালা। মোট ৪ ঘন্টা ট্রান্সজিট সহ আমাদের দুবাই অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘ নয় ঘন্টা। ইতিমধ্যে মেসেজ পাঠানো হলো ঢাকায়। সেখানে নিকটজনরা অপেক্ষা করছে অধীর আগ্রহে। ওরা আছে ভিন্ন উৎকণ্ঠা নিয়ে। আমেরিকা থেকে দেশে বিয়ে করতে আসা ভাইপো অভির ‘প্লাটিলেট’ আতঙ্কজনক হারে নিচে নেমে গেছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত সে। মাত্র দিন কয়েক বাকি। শেষ পর্যন্ত বিয়ে অনুষ্ঠান হবে তো? আমাদের দল বেঁধে দেশে যাবার মূল উদ্দেশ্য যে বিয়ে।
সন্ধ্যা সাতটা বিশে ঢাকা পৌঁছার কথা ছিল আমাদের। পৌঁছুলাম রাত এগারোটায়। লাগেজ পেতে খুব একটা দেরি হয়নি। কিন্তু দুটো গাড়ির বড়–সাইজের গাড়িটি তখনও এসে পৌঁছেনি। গেইটের বাইরে বের না হয়ে ভেতরে অপেক্ষা করছি গরম থেকে নিজেদের বাঁচাতে। তেষ্টা পেয়েছে। অবাক হবার পালা যে, লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে বিমান বন্দরের ভেতর যে স্পেস তাতে কোন স্টোর নেই, যেখানে খাবারের পানির বোতল পাওয়া যায় কিংবা চা–কফি। এয়ারপোর্টের ভেতর টয়লেট দেখে মনে হয় গুলিস্তানের পাবলিক টয়লেট। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ঢুকতে হয় এমন পরিস্থিতি। বুঝিনা বিমান কর্তৃপক্ষ এই দিকটা কেন এতো অবহেলা করে চলে, বছরের পর বছর। জানতে ইচ্ছে করে তাদের নিজস্ব বাসার টয়লেটের দশা কি এমন করুণ? অতীশ সপ্তর্ষি কাউন্টার থেকে বাংলাদেশী দুটি সিম কিনে নেয়। এই সার্ভিসটি ভালো লাগলো। অল্প সময়ে ওরা স্থানীয় ফোন নম্বর পেয়ে গেল। বাংলাদেশ এই দিকটায় বেশ এগিয়ে সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। ইমিগ্রেশনের–সার্ভিস অনেক উন্নত হয়েছে। এখন সময় লাগে কম। বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। যদিওবা দুর্নীতি বেড়ে চলেছে তার চাইতে দ্বিগুন গতিতে। একাত্তরে জন্ম নেয়া এই দেশটি বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে একটি ছিল। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ ২০১৫ সালে নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশগুলির (এলডিসি) তালিকা থেকে স্নাতক হওয়ার পথে রয়েছে। মানব উন্নয়ন অনেক মাত্রায় উন্নত হয়েছে। ঢাকায় আমার স্থায়ী অপেক্ষাকৃত তরুণ গাড়ি চালক সামাদ বলে, ‘স্যার, বাংলাদেশ আরো আগাইয়া যাইতো, যদি এই চুরি, দুর্নীতি না হইতো।’ বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ এখন অনেক সচেতন। তারাও টের পায় কে কী করে, দেশ কোনদিকে এগুচ্ছে।
যাই হোক, সব বাধা ডিঙিয়ে যখন মিরপুর রেস্ট হাউজে পৌঁছি তখন রাত এগার। মেজদা (অভির বাবা) সব ঠিক করে রেখেছিল, রাতের খাবারও। পরদিন ইউ এস বাংলায় চট্টগ্রাম। সপ্তর্ষি রয়ে গেল ঢাকায়। বিয়ে সেরে সে যাবে চাটগাঁ। ঢাকা তার ফেভারিট। ছোট ভাই অতীশকে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে গুলশান এলাকা। পছন্দের ক্যাফে–রেস্তোরাঁয় খাইয়েছে, উপভোগ করেছে দু–ভাই বোন। ওদের ভালো লাগছে দেখে আমার ভালো লাগে। ওরাই তো সব। ওদের জন্যেই তো বাকি জীবন বেঁচে থাকা। কিন্তু ঢাকায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। হাঁসফাঁস করতে থাকি কখন আমার প্রাণের শহর চাটগাঁ পৌছুবো। বড্ড অবহেলা আর অযত্নে বেড়ে উঠা চাটগাঁ। দেশের মোট জিডিপি–র ১২% চট্টগ্রামের অবদান, শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে ৪০% ভাগ, কর রাজস্বে ৫০% ভাগ, তারপরও রাজধানী ঢাকার সাথে তুলনা করলে মনে হয়, চট্টগ্রাম কত পিছিয়ে। কত অবহেলিত। সবকিছু বাদ দিলাম। কেবল ঢাকা শহরের সড়ক আর চট্টগ্রামের রাস্তাঘাট পাশাপাশি দাঁড় করালে এই দৈন্যদশা চোখে পড়ে। টেকসই উন্নয়ন বিষয়ক লেখক, হল্যান্ডে স্থায়ীভাবে বসবাসরত এক্সপেট ফয়েজ আহমদ তৈয়ব দিন কয়েক আগে প্রথম আলোয় লিখেছেন– “অর্থনীতির লাইফ লাইন বন্দর নগরী চট্টগ্রাম, কিন্তু এটা একটা শহর, যেখানে বর্ষাকালে অল্প কয়েকদিনের বৃষ্টিতে রাস্তায় নৌকা চলে। চট্টগ্রামের চিরস্থায়ী জলাবদ্ধতাকে আমি চিহ্নিত করি তিনটি বিশেষণে, ক) ভুলের বিপরীতে পাল্টা ভুল, (খ) দুর্নীতির বিপরীতে আরো বেপরোয়া দুর্নীতি এবং (গ) জ্ঞান ও গবেষণার বিপরীতে ক্রমাগত অজ্ঞতা। ফলে সাত মাসে চট্টগ্রাম ১০ বার ডুবে। আগে যেখানে জলাবদ্ধতায় হাঁটু থেকে কোমর–পানি হতো, এখন সেখানে বুক–পানি হয়। যেখানে জোয়ারের কয়েক ঘন্টা পর পানি চলে যেত, সেখানে টানা কয়েকদিন জলাবদ্ধতার কবলে থাকে অসহায় অভিভাবকহীন চট্টগ্রামবাসী।” সে যে কত সত্যি তা অতি কাছ থেকে দিন কয়েক আগে দেখলাম। একটানা বৃষ্টি পড়ে। সবাই দেখে বৃষ্টির জল, আমার মনে হয় যেন অবহেলিত চাটগাঁ কেঁদে চলেছে, অবিরাম ধারায়। আমারও প্রাণ কাঁদে চট্টগ্রামের জন্যে। এই শহরের সাথে যে আমার নাড়ির টান। এই শহরে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, লেখাপড়া এবং কর্মজীবনের কিছুটা সময়। এখানেই যে আমার সবকিছু। চাটগাঁর বিমানবন্দর থেকে কর্ণফুলিকে পাশে রেখে নতুন লিংক রোড ধরে এগিয়ে চলে আমাদের বাহন শহরের দিকে। প্রাণ খুলে নিঃস্বাস নেই। ভালো লাগে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট