নবী রাসূলগণের পর পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি খলীফাতু রাসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহ আনহু
হযরত আবু বকর (রা.)’র নাম ও বংশ পরিচয়: হযরত আবু বকর (রা.)’র নাম আবদুল্লাহ, তাঁর উপনাম আবু বকর, উপাধি: সিদ্দিক ও আতীক। তাঁর পিতার নাম: উসমান, পিতার উপনাম, আবু কুহাফা, মহিয়সী মাতার নাম: উম্মুল খায়র সালমা, তাঁর বংশ পরিক্রমা সপ্তম পুরুষ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে মিলিত হয়েছে, তিনি আবরাহা কর্তৃক মক্কা আক্রমণের প্রায় আড়াই বছর পর মক্কা মুকাররমায় জন্ম গ্রহণ করেন। (তারীখুল খুলাফা, পৃ: ২১)
ইসলাম গ্রহণ: অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈনদের বর্ণনামতে হযরত আবু বকর সিদ্দিক সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস হযরত মাইমুন বিন মিহরান বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর (রা.) বুহাইরা পাদ্রীর যুগে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ইবনে আসাকির হযরত মওলা আলী (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, পুরুষদের মধ্যে হযরত আবু বকর (রা.) সর্ব প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছেন। (তারীখুল খুলাফা, পৃ: ২৩)
আল কুরআনে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র মর্যাদার বর্ণনা: হযরত আবু বকর সিদ্দিক সাহাবী হওয়া কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবার ৪০ নং আয়াতে হযরত আবু বকর (রা.) কে নবীজির সাহাবী বলে আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এরশাদ হয়েছে, “তিনি ছিলেন দুজনের একজন, (অপর জন ছিলেন আবু বকর (রা.)। যখন তাঁরা সওর গুহার মধ্যে ছিলেন তখন তিনি তাঁর সঙ্গীকে বললেন চিন্তিত হয়োনা নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। ”(সূরা: তাওবা, আয়াত: ৪০)
হযরত আবু বকর সাহাবী হওয়া অকাট্য কুরআনের আয়াত দ্বারা প্রমাণিত। তাঁর সাহাবী হওয়া অস্বীকার করা কুরআনের আয়াতকে অস্বীকার করা, কুরআন অস্বীকারকারী কাফির। অত্রএব পথভ্রষ্ট শিয়া, রাফেযী সম্প্রদায় যারা হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র সাহাবী হওয়া স্বীকার করেনা তাঁকে কটূক্তি করে, সমালোচনা ও গালমন্দ করে তারা প্রকৃত পক্ষে কুরআন অস্বীকারকারী নিকৃষ্ট কাফির। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ২, পৃ: ১৫৬)
হাদীস শরীফের আলোকে হযরত সিদ্দিক আকবর (রা.) মর্যাদা: হযরত আবুদ দারদা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে আবু বকরের আগে চলতে দেখে বলেছেন হে আবুদ দারদা! তুমি কি এমন ব্যক্তির আগে আগে চলছো, যিনি ইহকালে ও পরকালে তোমার চেয়ে উত্তম। নবী–রাসূলগনের পর আবু বকর অপেক্ষা অন্য কোনো শ্রেষ্ঠ মানুষের ওপর সূর্য উদিতও হয়নি অস্তও যায়নি। (আহমদ, ফাদায়িলুস সাহাবাহ, খন্ড: ১, পৃ: ১৫৩, হাদীস: ১৩৫)
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে কেউ আমাদের উপর উপকার করেছে আমরা তার প্রতিদান পরিশোধ করেছি আবু বকরে এহসান ছাড়া, তিনি আমাদের প্রতি যে এহসান করেছেন কিয়ামতের দিন আল্লাহই তাঁকে তাঁর প্রতিদান দিবেন। আর কারো সম্পদ আমাকে ততখানি উপকৃত করতে পারেনি আবু বকরের সম্পদ আমাকে যতখানি উপকৃত করেছে। (তিরমিযী, হাদীস: ৫৬৪৯)
বর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বারা সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবী, আশরা মুবাশশারা তথা বেহেশতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবাদের প্রধান সাহাবী খলিফাতু রাসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর সিদ্দিক রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর সুমহান মর্যাদা, তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব, ইসলামে তাঁর বহুমাত্রিক অবদানের বর্ণনা ও নবী মোস্তফার নুরানী জবানে নবী রাসূলগণের পর উম্মতের মধ্যে তাঁর অতুলনীয় শান–মান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা আলোকপাত হয়েছে।
হযরত আবু বকর (রা.)’র শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে হযরত ওমর (রা.)’র অভিমত: আমিরুল মু’মিনীন হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত আবু বকর (রা.) আমাদের সরদার, আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম এবং আমাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নিকট সর্বাধিক প্রিয় ছিলেন। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ৫৬৫০)
হযরত আলী (রা.)’র অভিমত: খলিফাতু রাসূলিল্লাহ হযরত আবু বকর (রা.) ও আমিরুল মু’মিনীন হযরত ওমর (রা.)’র মর্যাদা বর্ণনা করতে হযরত মাওলা আলী (রা.) এরশাদ করেন, এই উম্মতের মধ্যে নবীর পর সর্বোত্তম ব্যক্তি হলেন, হযরত আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)। (তারীখুল খুলাফা, পৃ: ৩১)
হাউজে কাউসারে নবীজির সাথী: আম্বিয়ায়ে কেরামের পর উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তি হলেন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্বজন স্বীকৃত ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত। তিনি জীবদ্দশায় সর্বদা নবীজির সাথে ছিলেন, বিদায়ের পরও নবীজির পাশে আছেন। নবীজি তাঁর অনন্য মর্যাদা বর্ণনা প্রসঙ্গে এরশাদ করেছেন, তুমি হাউজে কাউসারের নিকট আমার সাথী হবে যেমন সওর পর্বতের গুহায় আমার সাথী ছিলে। (সুনানে তিরমিযী, হাদীস: ৩৬০৩)
হযরত আবু বকর (রা.)’র আমল অতুলনীয়: সততা, ন্যায়পরায়ণতা, বদান্যতা, দানশীলতা আমলে আখলাকে ধ্যানে জ্ঞানে চিন্তা চেতনায় স্মরণে জাগরনে অকৃত্রিম নবী প্রেমের অবগাহনে উৎসর্গীত আত্না, নিবেদিত প্রাণ এক পবিত্র সত্তার নাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)। নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান সাদকা, মানব সেবা, সমাজ সেবা, রাষ্ট্র পরিচালনা, সুশাসন প্রশাসন, সাম্য মৈত্রী আদর্শ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বোপরি মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণ যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, ভন্ড নবীদের মূলোৎপাটন, ধর্মত্যাগীদের কঠোর হস্তে দমন, পবিত্র কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণ প্রতিটি কাজে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তাঁর আমলের সাথে উম্মতের আমল তুলনা করা অজ্ঞতা ও মূর্খতার নামান্তর। যেখানে তাঁর আমলের সাথে অন্য কোনো সাহাবীর আমলের তুলনা করা চলেনা সেখানে উম্মতের কোনো সাধারণ মোল্লা মৌলভী তাঁর আমল অপেক্ষা নিজের আমল বেশি দাবী করা চরম ধৃষ্টতা বৈ কিছুই নয়। হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আবু বকর (রা.) এবং ওমর ফারুক (রা.) অপেক্ষা আমাকে যে প্রাধান্য দেবে আমি তাকে আশিটি চাবুকাঘাত করব। (ইবনে আসাকির, তারীখুল খুলাফা, পৃ: ৪৩)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী : হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র অসংখ্য গুণাবলীও বৈশিষ্ট্য সমূহের আংশিক উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি:
১. তিনি সর্বপ্রথম মুসলমান, ২. তিনি রাসূলুল্লাহর সাথে সর্বপ্রথম নামায আদায় করেছেন, ৩.তিনি সর্বপ্রথম কুরআন সংকলন করেন, ৪. তিনি কাফিরদের সাথে সর্বপ্রথম যুদ্ধ করেন, ৫. তিনি সর্বপ্রথম রাসূলুল্লাহর খলীফা হয়েছেন, ৬. তিনি উম্মতের সর্বপ্রথম ইমাম হয়েছেন, ৭. সর্বপ্রথম তাঁর নাম সিদ্দিক হয়েছে, ইতোপূর্বে কারো নাম সিদ্দিক ছিলনা, ৮. উম্মতের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম মসজিদ নির্মাণ করেন, ৯. উম্মতের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম জান্নাতে প্রবেশ করবেন। (তারীখুল খুলাফা, পৃ: ১৩৭)
১০. উম্মতের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন, ১১. ইসলাম গ্রহণের পর তিনিই সর্বপ্রথম চল্লিশ হাজার দিরহাম সহ সমুদয় সম্পদ ইসলামের জন্য উৎসর্গ করেছেন, ১২. ৯ম হিজরিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আমীরুল হুজ্জাজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, ১৩. রাসূলুল্লাহর জীবদ্দশায় উম্মতের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম নবীজির স্থলাভিষিক্ত হয়ে ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন, ১৪.রাসূলুল্লাহ তাঁকে সর্বপ্রথম আতীক জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ দেন, ১৫. তিনিই সর্বপ্রথম রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য বার্ষিক রাষ্ট্রীয় ভাতার ব্যবস্থা করেন, ১৬.তিনিই ইসলামে সর্বপ্রথম বায়তুলমাল প্রতিষ্ঠা করেন, ১৭. রাসূলুল্লাহ নিজেও তাঁর পিছনে নামায আদায় করেছেন, ১৮. কুরআন মজীদের নাম তিনি সর্বপ্রথম মুসহাফ রেখেছেন, ১৯. তিনিই সর্বপ্রথম ইসলামী শরীয়তের চারটি উসূল বা মূলনীতি নির্ধারন করেন, ২০. তিনি প্রথম খলিফা যিনি তাঁর পিতা আবু কুহাফার জীবদ্দশায় খিলাফত লাভ করেন, ২১.তিনি সর্বপ্রথম খলীফা যার ভাতা রাষ্ট্রের জনগন নির্ধারণ করেন। (আনোয়ারুল বায়ান, তারীখুল খুলাফা, খালীফাতু রাসূলুল্লাহ আবু বকর আছ ছিদ্দিক রাদ্বিআল্লাহু আনহু, ড. আহমদ আলী)
খিলাফত ও ওফাত: তিনি দুই বৎসর তিন মাসের কাছাকাছি খিলাফতের গুরুদায়িত্ব পালন করে ১৩ হিজরির ২২ জমাদিউস সানি মঙ্গলবার রাতে মওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে গমন করেন, রওজায়ে আকদাসে নবীজির পাশে চির নিদ্রায় শায়িত আছেন।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ শফিউল আজম
হাটহাজারী, বাস ষ্টেশন, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কোনো ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কটূক্তি করলে গালমন্দ করলে ইসলামে তার শাস্তি কি?
প্রশ্নের উত্তর: ইসলামী শরীয়তে যে ব্যক্তি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গালমন্দ করল তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। তাফসীরে “ছাবী” তে উল্লেখ রয়েছে যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর শানে সামান্যতম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করল সে ইহকাল ও পরকালে কাফির ও অভিশপ্ত। প্রসিদ্ধ ফাতওয়া গ্রন্থ ‘দুররুল মোখতার’ কিতাবের ৩৪–৩৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রেরিত নবীদের থেকে যে কোনো নবীকে গালমন্দ করল তার তাওবা কবুল হবে না। যে ব্যক্তি তার কাফির হওয়া ও শাস্তি যোগ্য হওয়া সম্পর্কে সন্দেহ করল সেও কুফরী করল। বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’ কিতাবের ১২তম খন্ডের ২৩৬ পৃষ্ঠায় উল্লেখ রয়েছে, ইসলামে মুজতাহিদ ওলামাদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হলো, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গালমন্দ করবে তাকে হত্যা করতে হবে।