বঙ্গবন্ধু : ইতিহাসের মহানায়ক

নেছার আহমদ | বুধবার , ৯ আগস্ট, ২০২৩ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের একমাত্র বাঙালি যিনি বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা, বাংলা ভাষার অধিকার আদায়, বাঙালির নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র গড়ে তোলা এবং বাংলাদেশের স্বাধীন অভ্যুদয়কে অনিবার্য করে তোলার প্রাণপুরুষ। এ কারণেই তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, ইতিহাসের মহানায়ক।

১৯৩৮ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জে মিশন স্কুল (যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন শেখ মুজিব) পরিদর্শনের সময় স্কুল ভবনের সংস্কারের দাবি জানাতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাৎ ও পরিচয় ঘটে। ১৯৩৯ সালে শেখ মুজিব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতা বেড়াতে যান। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘১৯৩৯ সালে কলকাতা যাই বেড়াতে। শহীদ সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। আবদুল ওয়াসেক সাহেব আমাদের ছাত্রদের নেতা ছিলেন। তাঁর সাথেও আলাপ করে তাঁকে গোপালগঞ্জ আসতে অনুরোধ করি। শহীদ সাহেবকে বললাম, গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করব এবং মুসলিম লীগও গঠন করব। খন্দকার শামসুদ্দীন সাহেব এমএলএ তখন মুসলিম লীগে যোগদান করেছেন। তিনি সভাপতি হলেন ছাত্রলীগের। আমি হলাম সম্পাদক। মুসলিম লীগ গঠন হল। একজন মোক্তার সাহেব সেক্রেটারি হলেন, অবশ্য আমিই কাজ করতাম। মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটি গঠন করা হল। আমি আস্তে আস্তে রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করলাম।’

এভাবে কলকাতাতেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়।

কলকাতায় এসে শেখ মুজিব মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হন, এবং এক পর্যায়ে ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই’ তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে, তখনও কিন্তু তাঁর মধ্যে অসাম্প্রদায়িক মানবিক চিন্তাচেতনা প্রবলভাবে কাজ করেছে। পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা এবং বাংলার মুসলিম লীগের প্রধান নেতাদের একজন হওয়া সত্ত্বেও শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবই ছিলেন মূলত উদার গণতন্ত্রী এবং অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের মানুষ।

যার কারণে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু। এ ছাড়া দুজন খ্যাতিমান বাঙালি নেতা চিত্তরঞ্জন দাশ (দেশবন্ধু সি আর দাশ) এবং নেতাজি সুভাষ বসুকে তিনি ‘আইডল’ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন হিন্দুমুসলমানের মিলনের দূত। তাঁর ইতিহাসখ্যাত বই ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ (১৯২৪) সামগ্রিকভাবে পরাধীন ভারতের রাজনীতিতে এক অবিস্মরণীয় মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী মুসলমান ও হিন্দুদের সমাজ মর্যাদা, অধিকার ও সুযোগসুবিধা দেওয়ার অঙ্গীকার সংবলিত ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ মুসলমান সমাজকে প্রবলভাবে আলোড়িত করেছিল। সিআর দাশের রাজনৈতিক চিন্তাধারা তৎকালীন কংগ্রেস দলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। সে কারণে ১৯২৩ সালে তিনি কংগ্রেস ত্যাগ করে স্বরাজ পার্টি গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর দীক্ষাগুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সিআর দাশের একান্ত প্রিয়ভাজন ও বিশ্বস্ত সহকর্মী। সিআর দাশের অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মুসলমানদের প্রতি সহানুভূতি সোহরাওয়ার্দীকে প্রবলভাবে প্রভাাবিত করেছিল। ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে স্বরাজ পার্টি জয়লাভ করে। দেশবন্ধু কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন এবং তিনি সোহরাওয়ার্দীকে ডেপুটি মেয়র করেন। এভাবেই হিন্দুমুসলমানের মধ্যে মিলনের একটা বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। সিআর দাশের প্রতি সোহরাওয়ার্দীর দৃষ্টিভঙ্গি বঙ্গবন্ধুকেও প্রভাবিত করে। গুরুশিষ্য দুজনেই তাঁর অনুরক্ত ছিলেন। সে সময়কালে প্রবেশিকা পরীক্ষা হতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতার বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে কলা বিভাগে ভর্তি হন। কলকাতার মুসলিম ছাত্রলীগ তখন দুই উপদলে বিভক্ত। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে দুইটা দল ছিল। চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরীও তখন ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছিলেন। ওয়াসেক সাহেব ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর সাথে গোলমাল লেগেই ছিল। ওয়াসেক সাহেব ছাত্রদের রাজনৈতিক পিতা ছিলেন বললে অন্যায় হবে না। বহুদিন তিনি ‘অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের’ সভাপতি ছিলেন। ছাত্র জীবন শেষ করেছেন বোধ হয় পনেরো বছর পূর্বে তবুও তিনি পদ ছাড়বেন না। কেউ তার মতের বিরুদ্ধে কথা বললেই তিনি বলতেন, ‘কে হে তুমি? তুমি তো ছাত্রলীগের সদস্য বা কাউন্সিলার নও; বের হয়ে যাও সভা থেকে।’ প্রথমে কেউই কিছু বলত না তাঁকে সম্মান করে। প্রথম গোলমাল হয় বোধ হয় ১৯৪১ বা ১৯৪২ চুঁচুঁড়া সম্মেলনে। ফজলুল কাদের চৌধুরী ও আমরা ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলাম। শেষ পর্যন্ত শহীদ সাহেবের হস্তক্ষেপে গোলমাল হল না।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)

ভারত ও অবিভক্ত বাংলার ছাত্র আন্দোলনের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল দীর্ঘ ইতিহাস। ঊনিশ শতকে বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম প্রতীক হচ্ছে ইয়ং বেঙ্গল বলে পরিচিত দ্রোহ চেতনার তরুণ শিক্ষার্থীগণ।

জিন্নাহর উদ্যোগে ১৯৩৭ সালে গঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্র ফেডারেশন ১৯৩৮ সালে নাম পরিবর্তন করে হয় অল ইন্ডিয়া মুসলিম ছাত্রলীগ। বাংলায় এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতাদের একজন ছিলেন আবদুল ওয়াসেক। এছাড়া যশোরের শামসুর রহমান, মাহমুদ নুরুল হুদা, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ বিভিন্ন সময়ে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। চল্লিশের দশকের শেষ দিকে খাজা গ্রুপের অনুসারী শাহ আজিজ এবং সোহরাওয়ার্দীআবু হাশিমের অনুসারী শেখ মুজিবুর রহমান, নূরউদ্দিন, জহিরুদ্দীন প্রমুখ মুসলিম ছাত্রলীগের দুই অংশের নেতৃত্বে ছিলেন। তবে দেশভাগের আগে দলাদলি থাকলেও মুসলিম ছাত্রলীগ অফিসিয়ালি এক সংগঠন ছিল। পূর্বেই সংগঠনটির প্রাণকেন্দ্র ছিল ইসলামিয়া কলেজ।

শেখ মুজিব যে ‘বঙ্গবন্ধু’ ও জাতির পিতা হয়ে উঠেছেন তথা বাঙালির অবিসংবাদিত মহানায়ক হয়ে উঠেছেন, তার পেছনে যেসব ঘটনা ও প্রসঙ্গ কাজ করেছে, তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলায় অবদান রেখেছে, তা উল্লেখযোগ্য। শেখ মুজিবের ‘দীক্ষা গুরু’ সোহরাওয়ার্দী যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন ‘শিষ্য মুজিব’ গুরুর প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য বজায় রেখেছেন। ১৯৩৯ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা হলে তিনি শেখ মুজিবকে গোপালগঞ্জে মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগ গঠনের দায়িত্ব দেন। কলকাতায় আসার আগেই তিনি গোপালগঞ্জে ছাত্রলীগ গঠন করেন। কলকাতায় পড়তে আসার পর তার ধ্যানজ্ঞানই হয়ে ওঠে কলকাতায় এবং বিশেষত পূর্ববঙ্গে ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের সংগঠন গড়ে তোলা। সকল স্তরে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলার শিক্ষাটি তিনি পেয়েছিলেন তার দীক্ষাগুরু সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে। মুসলিম লীগে পুরানো রক্ষণশীলদের কব্জা থেকে মুক্ত করাও ছিল প্রগতিকামী অংশের লক্ষ্য। তাঁর রাজনৈতিক দৃঢ়তা এবং সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে, ‘১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতাদের মধ্যে নিজের স্থান করে নিতে সফল হয়েছিলেন।’ এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আলাদা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সঠিক সময়ে সঠিক কাজের সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা গ্রহণ তাঁকে জাতির পিতার সম্মানে সম্মানিত করেছেন বাঙালি জাতি। তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মিলেছে বিভিন্ন সময়ে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, জাতির মুক্তির ম্যাগনাকাটা ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান প্রভৃতি।

১৯৬৯ সালের ৫ই মে সেপ্টেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের নাম রাখেন ‘বাংলাদেশ।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘একসময় এদেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই। জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছিআজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ এর পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।” (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ : ২৭৯)

যে ব্যক্তিটি জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত আপাদমস্তক একজন বাঙালি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন এবং বাঙালির জন্য রক্ত দিয়েছেন এরকম আর দ্বিতীয় কেউ আছে কিনা আমার জানা নেই। সেই কারণেই তিনি বাংলা ও বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক শিল্পশৈলী ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে নৌকাডুবি: ৩৬ ঘণ্টা পর ব্যবসায়ীর লাশ উদ্ধার