টানা বৃষ্টিতে ডুবে যায় শহর। কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। তাতে নাকাল হচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরবাসী। চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে আসবে, কয়েক বছর ধরে সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে এমন আশ্বাস পেয়ে আসছিলাম আমরা নগরবাসী। তবে আশ্বাস শুধু মুখেই সীমাবদ্ধ, বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। ভারী বৃষ্টি হলেই ডুবছে পুরো নগরী।
জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দুঃখগাথা হয়ে আছে। বর্ষা মৌসুমে ভারী কিংবা অল্প বৃষ্টিতে নগরের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে, এই নিয়তি একপ্রকার মেনে নিয়েছে নগরবাসী। এমনকি বৃষ্টি না থাকলেও অনেক সময় জোয়ারের পানিতেও ভোগ্যপণ্যের বড় পাইকারি বাজার, হাসপাতালসহ বসতবাড়ি ডুবে যাওয়ার ঘটনা এখানে নৈমিত্তিক। দৈনিক আজাদীর প্রতিবেদনে দেখা যায়, পুরো বর্ষার শেষ সময়ে এসে গত চার দিনের বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার ভয়াবহ রূপ দেখছে চট্টগ্রামবাসী। খলিফাপট্টি থেকে শুরু করে শহরের মধ্যে উঁচু এলাকা হিসেবে পরিচিত নন্দনকাননের সড়কেও জমেছে পানি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীন পাহাড়তলীর ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের ঝর্নাপাড়ার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমরা তো গলা পর্যন্ত ডুবছি! আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কি মাথাসহ ডুবে যাবে?’ পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রবিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
বর্ষা মৌসুমের ভারী বর্ষণের প্রথম ধাক্কাটা এসেছিল গত ২ আগস্ট। এরপর থেমে থেমে বৃষ্টি। সর্বশেষ গত তিন দিন ধরে টানা বৃষ্টিতে নগরীর অধিকাংশ এলাকা হয়ে গেছে জলমগ্ন। খলিফাপট্টি, চকবাজার, দেওয়ান বাজার, মুরাদপুর, ষোলশহর ২ নম্বর গেইট, বহদ্দারহাট, বাদুরতলা, শুলকবহর, মোহাম্মদপুর, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়া, ফিরিঙ্গিবাজার, চান্দগাঁও, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, তিন পুলের মাথা, রিয়াজুদ্দিন বাজার, মুরাদপুর, চাক্তাই–খাতুনগঞ্জ, কালারপোল, বড়পোল, হালিশহরসহ বিভিন্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা।
চট্টগ্রাম নগরে ভারী বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার সময় প্রতিবছর মানুষের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে যায়। এতে নষ্ট হয় গৃহস্থালির জিনিসপত্র থেকে শুরু করে ব্যবসায়িক পণ্যসামগ্রী। জলাবদ্ধতায় প্রতিবছর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে সাম্প্রতিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতায় গত এক দশকে ২ হাজার ৫১৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, এই জলাবদ্ধতার দায় সেবাদানকারী সংস্থা কেউ নিচ্ছে না। অন্যদিকে, নগরের জলাবদ্ধতা এবং মানুষের ভোগান্তি ও দুর্ভোগের জন্য সিডিএকে দোষারোপ করলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। একইসঙ্গে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্পের কাজে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে সমন্বয় না করারও অভিযোগ করেন তিনি। জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএ’র চলমান মেগা প্রকল্পের প্রসঙ্গ টেনে মেয়র বলেন, যত দোষ নন্দ ঘোষ, সব মেয়রের দোষ। কিন্তু এ মেগা প্রকল্পে তো মেয়রের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এ প্রকল্পে কিছু করার মত ক্ষমতাও নেই মেয়রের।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, কী কারণে চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা হচ্ছে, সেটির কারণ বের করতে গত বছরের জুনে চার সদস্য নিয়ে ‘জলাবদ্ধতার কারণ অনুসন্ধান কমিটি’ গঠন করা হয়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে প্রধান করে করা এই কমিটি পাঁচটি কারণ চিহ্নিতের পাশাপাশি তা সমাধানে ছয়টি স্বল্পমেয়াদি ও ১১টি দীর্ঘমেয়াদি সুপারিশ করেছিল। এ ছাড়া চট্টগাম নগরের ৩২টি খালে কী কী সমস্যা রয়েছে, তার পরিদর্শন প্রতিবেদনও একসঙ্গে জমা দেয়া হয়েছিল তখন। সেই পাঁচ কারণ ছিল– অতিবর্ষণ ও একই সঙ্গে কর্ণফুলী নদীতে পূর্ণিমার সময় অতিরিক্ত জোয়ার, খালের সংস্কারকাজের চলমান অংশে মাটি থাকার ফলে খাল সংকোচন, নগরের খাল ও নালা–নর্দমা বেদখল, নাগরিকদের অসচেতনতার কারণে খাল–নালায় বর্জ্য ফেলা এবং নিয়মিত খাল–নালা থেকে মাটি উত্তোলন না করা। কমিটির দেয়া স্বল্পমেয়াদি ছয়টি সুপারিশের মধ্যে ছিল স্ব–স্ব সংস্থার উদ্যোগে চিহ্নিত সমস্যা দ্রুত সমাধান, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় বর্ষা মৌসুমে নিয়মিতভাবে খাল–নালার বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চালু রাখা প্রভৃতি।
জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতার বাইরের খাল–নালাগুলো সিটি করপোরেশনের মাধ্যমে নিয়মিত পরিষ্কার করাও ছিল অন্যতম কাজ। নগরীর ছোট–বড় নালাগুলোর আবর্জনা অপসারণ না করায় সামান্য বৃষ্টিতে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ নগরবাসীর। নালা পরিষ্কার না করার জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকে (চসিক) দায়ী করছেন তাঁরা। যদিও চসিক মেয়র এ দায় নিতে নারাজ। চট্টগ্রাম নগরীর জলাবদ্ধতা নিয়ে গণমাধ্যমে লেখালেখি কম হয়নি। সরকারের নানামুখী উদ্যোগ, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পরামর্শ কোনোটাই যেন কাজে আসছে না। আমরা মনে করি, জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রামের খালগুলো ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মেগা প্রকল্পে জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সুপরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, তার বাস্তবায়ন জরুরি।