বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়নে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অপরিসীম। একটি জাতির মন ও মানস গঠনে খেলাধুলার ভূমিকা যে কত ব্যাপক, তা তিনি বুঝতেন বলে ক্রীড়াক্ষেত্রের উন্নয়নে গ্রহণ করেছিলেন নানান অসামান্য উদ্যোগ। ক্রীড়াবিশ্লেষকরা বলেন, ‘ক্রীড়াবিশ্বে বাংলাদেশ আজ আপন দ্যুতিতে ভাস্বর। এর যাত্রাটি বঙ্গবন্ধুর আমলে শুরু হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবে না।’
ছোটোবেলা থেকেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন ক্রীড়াভক্ত, ছিলেন দুরন্ত–চঞ্চল। নিজেই লিখেছেন ‘ছোটোবেলায় আমি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম’। ফুটবল খেলতেন, খেলতেন ভলিবল। গান, কবিতা, চলচ্চিত্র যেমন ভালোবাসতেন, তেমনি ভালোবাসতেন খেলাধুলা। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখলেন : ‘আমি খেলাধুলা করতাম। ফুটবল, ভলিবল ও হকি খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না, তবুও টিমের মধ্যে ভালো অবস্থান ছিল। এই সময় আমার রাজনীতির খেয়াল তত ছিল না।’ তিনি জানালেন গোপালগঞ্জে তাঁর আব্বার দলের সঙ্গে তাঁর দলের ম্যাচ হতো। লিখেছেন : “লেখাপড়ায় আমার একটু আগ্রহও তখন হয়েছে। কারণ, কয়েক বৎসর অসুস্থতার জন্য নষ্ট করেছি। স্কুলেও আমি ক্যাপ্টেন ছিলাম। খেলাধুলার দিকে আমার ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিমে যখন খেলা হত তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভাল ছিল। মহকুমায় যারা ভাল খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম। ১৯৪০ সালে আব্বার টিমকে আমার স্কুল টিম প্রায় সকল খেলায় পরাজিত করল। অফিসার্স ক্লাবের টাকার অভাব ছিল না। খেলোয়াড়দের বাইরে থেকে আনত। সবই নামকরা খেলোয়াড়। বৎসরের শেষ খেলায় আব্বার টিমের সাথে আমার টিমের পাঁচ দিন ড্র হয়। আমরা তো ছাত্র; এগারজনই রোজ খেলতাম, আর অফিসার্স ক্লাব নতুন নতুন প্লেয়ার আনত। আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আব্বা বললেন, ‘কাল সকালেই খেলতে হবে। বাইরের খেলোয়াড়দের আর রাখা যাবে না, অনেক খরচ।’ আমি বললাম, ‘আগামীকাল সকালে আমরা খেলতে পারব না, আমাদের পরীক্ষা’। গোপালগঞ্জ ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারি একবার আমার আব্বার কাছে আর একবার আমার কাছে কয়েকবার হাঁটাহাঁটি করে বললেন, ‘তোমাদের বাপ ব্যাটার ব্যাপার, আমি বাবা আর হাঁটতে পারি না।’ আমাদের হেডমাস্টার তখন ছিলেন বাবু রসরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমাকে তিনি প্রাইভেটও পড়াতেন। আব্বা হেডমাস্টার বাবুকে খবর দিয়ে আনলেন। আমি আমার দলবল নিয়ে এক গোলপোস্টে আর আব্বা তার দলবল নিয়ে অন্য গোলপোস্টে। হেডমাস্টার বাবু বললেন, ‘মুজিব, তোমার বাবার কাছে হার মানো। আগামীকাল সকালে খেল, তাদের অসুবিধা হবে।’ আমি বললাম, ‘স্যার আমাদের সকলেই ক্লান্ত, এগারজনই সারা বছর খেলেছি। সকলের পায়ে ব্যথা, দুই–চার দিন বিশ্রাম দরকার। নতুবা হেরে যাব।’ এ বছর তো একটা খেলায়ও আমরা হারি নাই, আর ‘এ জেড খান শিল্ডের’ এই শেষ ফাইনাল খেলা। এ. জেড. খান এসডিও ছিলেন, গোপালগঞ্জেই মারা যান। তাঁর ছেলেদের মধ্যে আমির ও আহমদ আমার বাল্যবন্ধু ও সাথী। আমির ও আমি খুব বন্ধু ছিলাম। আমিরুজ্জামান খান এখন রেডিও পাকিস্তানে চাকরি করেন। ওর বাবা মারা যাবার পর যখন গোপালগঞ্জ থেকে চলে আসে তখন ওর জন্য আমি খুব আঘাত পেয়েছিলাম। হেডমাস্টার বাবুর কথা মানতে হল। পরের দিন সকালে খেলা হল। আমার টিম আব্বার টিমের কাছে এক গোলে পরাজিত হল।” বঙ্গবন্ধু যেমন একজন শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন, তেমনি ছিলেন বহুমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এক আরাধ্য পুরুষ। তাঁর ভেতরে ফুটে উঠতো ক্রীড়াপ্রেমীর উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী