ডেঙ্গু পরিস্থিতি এতোটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যা নিয়ে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে সমাজে। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আর এই রোগের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার পরেও সেদিকে নজর না দেয়ায় এই বছরে ডেঙ্গু মারাত্মক হয়ে উঠেছে বলে বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যবিদরা মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, এক সময়ে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগটি মৌসুমি রোগ বলে মনে করা হলেও, গত কয়েক বছর ধরে সারা বছর জুড়ে প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। এর ফলে এই রোগের চার ধরনের ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং রোগটি দেশের সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে এই বছরে মৌসুমের আগে আগে সেটা প্রকট হয়ে উঠেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। আসলে গত কয়েক বছর ধরে ডেঙ্গুর এরকম সংক্রমণ চলার পরেও সেটা ঠেকাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। যে ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, সেটা অনেকটা গতানুগতিক ব্যবস্থা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এটা হয়তো সাময়িক একটা রোগ, কিছুদিন পরেই চলে যাবে। ফলে কার্যকর বা দীর্ঘমেয়াদি কোন ব্যবস্থা কোথাও নেয়া হচ্ছে না। ফলে ডেঙ্গু রোগটা একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। যে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার, সেটা হচ্ছে না। এটা যে একটা মহামারি, সেরকম করে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
স্বাস্থ্যখাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগটি নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা, নজরদারি নেই। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে আসছে। কিন্তু এর বাইরেও যে বিপুল মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য কোথাও নেই। মশা দমনেও দেশ জুড়ে বড় ধরনের কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি এখন মশা দমনে যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কার্যকারিতা আছে কিনা, তাও কারও জানা নেই। তাঁরা বলছেন, ‘সেই সঙ্গে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়ে গেছে। শহরে গ্রামে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, পানি জমে যাওয়া, নগরায়ণের ফলে পানি আটকে থাকার কারণে ডেঙ্গু মশা বেড়েছে, ফলে রোগীও বেড়ে গেছে।’ এটা মোকাবেলায় গতানুগতিক পদক্ষেপ বাদ দিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া দরকার বলে তাঁরা মনে করছেন। না হলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। তবে সুখের বিষয়, দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রতিটি হাসপাতালেই এখন ডেঙ্গু কর্নার স্থাপিত হয়েছে। প্রতিটি হাসপাতালেই পর্যাপ্ত শয্যা প্রস্তুত রয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লেও চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিতে প্রস্তুত আছেন। চমেক হাসপাতালে অবশেষে প্রস্তুত করা হলো আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড। দৈনিক আজাদীর ১ আগস্ট প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড স্থাপনে তোড়জোড় শুরুর কথা জানা গেছে আগেই। এ নিয়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি বৈঠকও করে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এরপরও আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড হয়নি এতদিন। অবশেষে আলাদা ডেঙ্গু ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে চমেক হাসপাতালে। হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি ভবনের ৮ম তলায় অর্ধশত শয্যার এ ওয়ার্ড প্রস্তুত করে তোলা হয়েছে। চিকিৎসক–নার্স, কর্মচারির বিষয়টিও এরইমাঝে চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে শয্যা সংখ্যা কম হওয়ায় আলাদা এ ওয়ার্ডে সব রোগীর সংস্থান করা যাবে না। যার কারণে কেবল পুরুষ অথবা কেবল নারী রোগীদের আলাদা এ ওয়ার্ডে চিকিৎসা সেবা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, বর্তমানে সবমিলিয়ে ৮০ জনের মতো ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে হাসপাতালে। কয়েকদিন এ সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীদের জন্য আলাদা যে ওয়ার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে তাতে ৫০/৬০ টি শয্যা রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই সব রোগীর সংস্থান ওখানে হবে না। তাই আলাদা ওয়ার্ডে হয় পুরুষ নয়তো কেবল নারী রোগীদের রাখার বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে। এখনই হাসপাতালে জায়গা নেই। পরিস্থিতি যদি আরো খারাপ হয় তখন অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? প্রাথমিক অবস্থায় রোগীকে বাসায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া যায়; কিন্তু এক সময় রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়, রক্ত দিতে হয়, স্যালাইন দিতে হয়। ভবিষ্যতে সরকার ও কর্তৃপক্ষ কীভাবে পরিস্থিতির সামাল দেবে, বুঝে উঠতে পারছি না। মৃতের সংখ্যা বাড়ুক, সেটা কারো কাম্য হতে পারে না।