সাহিত্যমেলা : ‘প্রান্ত ও কেন্দ্রের বন্ধন অচ্ছেদ্য করার কোনো বিকল্প নেই’

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ১ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৩৭ পূর্বাহ্ণ

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বাংলা একাডেমির উদ্যোগে জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় সম্প্রতি জেলা সাহিত্য মেলা শেষে শুরু হয়েছে ‘উপজেলা সাহিত্যমেলা’। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অবস্থানরত কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টিকর্ম জাতীয় পর্যায়ে তুলে ধরার লক্ষ্যে এই সাহিত্যমেলার আয়োজন। ২০২২ সালে একুশে বইমেলা উদ্বোধনের সময় জেলাউপজেলা পর্যায়ে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রত্যেক জেলায় বা মহকুমায় অতীতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো, সাহিত্যচর্চা হতো, সাহিত্য সম্মেলন হতো, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা হতো। এই চর্চাটা অনেকটা কমে গেছে। এটাকে আবার একটু চালু করা দরকার।’ প্রত্যেক জেলার পাশাপাশি এখন উপজেলা পর্যায়েও শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকেও আপনারা যদি একটু উদ্যোগ নেন তাহলে আপনারা দেখবেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অনেক মেধাবী কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী আমরা পাবো। এতে তাঁদের জ্ঞান ও মেধা বিকাশের যেমন সুযোগ আসবে তেমনি মানুষের হৃদয়ের খোরাকটাও তো দরকার। খাদ্য নিরাপত্তা আমরা করে দিয়েছি, এখন হৃদয়ের খোরাকটা জোগাতে হবে। আর তা সংস্কৃতিসেবীদের মধ্য থেকেই আসে। সাংস্কৃতিক জগৎ বা আমাদের শিল্প সাহিত্য জগৎ বা এই ধরনের মেলা যদি হয় বা অনুষ্ঠানগুলো যদি হয় তাহলে কিন্তু আমাদের যারা যুবসমাজ রয়েছে তারাও ভিন্ন পথে যাবে না। তারা বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য এবং বাংলা সংস্কৃতির প্রতিও আন্তরিক থাকবে।’ যতদূর জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীর সেই আগ্রহে তৃণমূল পর্যায়ে সাহিত্যমেলা আয়োজন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে বাংলা একাডেমি।

এ সাহিত্য মেলার মাধ্যমে জেলাউপজেলা পর্যায়ে সাহিত্যের প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি স্থানীয় সাহিত্যিকদের সাহিত্য কেন্দ্রীয় সাহিত্যে একীভূত করতে চায় বাংলা একাডেমি। যেসব সাহিত্যপ্রতিভা নানা জায়গায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন, তাঁদের সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়ন ও জাতীয় পর্যায়ে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়াই এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য।

জাতিসত্তার কবি’ হিসেবে খ্যাত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মূহম্মদ নূরুল হুদা গত ২৮ জুলাই তাঁর ফেসবুক টাইমলাইনে বলেছেন, ‘জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে জেলা সাহিত্যমেলার পর এখন চলছে উপজেলা স্তরে সাহিত্যমেলা। তারপর কি গ্রামসাহিত্যমেলা? অবশ্যই। কেননা সাহিত্যের শুরু তৃণমূল থেকে; ব্যক্তিপ্রতিভা ও তার সৃষ্টিশীলতার মূল উৎস থেকে। বাঙালির সৃষ্টিশীলতাকে সর্বব্যাপী করতে হলে প্রান্ত ও কেন্দ্রের বন্ধন অচ্ছেদ্য করার কোনো বিকল্প নেই।’ সাহিত্যমেলার মতো আয়োজন পাঠক ও লেখকদের মাঝে নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নতুন প্রজন্মের মাঝে বই পড়ার অভ্যাস তৈরির জন্য এ ধরনের আয়োজন ফলপ্রসূ হয়ে দাঁড়ায়। তাই নানা ত্রুটিবিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা বাংলা একাডেমি ও সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই, অভিনন্দন জানাই। কেননা আমরা জানি, যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে অনেক প্রতিভা আলোয় আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

গত ২৭ জুলাই পটিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘উপজেলা সাহিত্যমেলা’। উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে পটিয়ার সংসদ সদস্য, জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এমপি, পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী থেকে শুরু করে শিক্ষাবিদ, কবিসাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীরা অংশগ্রহণ করেন। ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) কবি মালেক মুস্তাকীম, একুশে পদকপ্রাপ্ত নাট্যজন আহমদ ইকবাল হায়দার, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক, কবিসাংবাদিক শিশির দত্ত, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল আলীম, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবু জাফর চৌধুরী প্রমুখ। সাহিত্য মেলায় পটিয়ার সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য রাজনীতি, সংগ্রাম ও শিক্ষা নিয়ে আলোকপাত করা হয়। সেমিনার, কবিতাছড়া পাঠ ও লেখালেখির প্রশিক্ষণ ছাড়াও মেলায় রাখা হয় বইয়ের স্টল। যা সাহিত্য মেলাকে সমৃদ্ধ করেছে। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সাহিত্যমেলার আয়োজন বলে পটিয়ার বাইরে অবস্থানরত কৃতীজনদের মেলায় সম্পৃক্ত করাতে আয়োজকদের বেগ পেতে হয়েছে। তবু সমস্ত আয়োজনের জন্য উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা আতিকুল মামুন, সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাকিবুল ইসলাম ও তাঁদের সহকর্মীরা প্রশংসার দাবিদার।

বলা হয়ে থাকে, পটিয়া চট্টগ্রামের সমৃদ্ধ জনপদ। এই জনপদের ইতিহাস হাজার বছরের। দেশের রাজনৈতিক ও সংগ্রামের ইতিহাসে পটিয়ার স্থান সর্বাগ্রে। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এ পটিয়া চট্টগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ। শিক্ষা, রাজনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসব দিক থেকে এ অঞ্চল অগ্রগামী। এখানে জন্ম নিয়েছেন অনেক জ্ঞানী গুণী। সাহিত্যসংস্কৃতি, বিপ্লবসংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ ও শিক্ষাদীক্ষায় যাঁরা রেখেছেন অনন্য সাধারণ অবদান। যাঁদের কৃতি ও কীর্তি স্থানীয় গণ্ডি পেরিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মণ্ডলে বিশেষভাবে সমাদৃত ও প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল এই পটিয়া। মাস্টারদা সূর্য সেনের সংগ্রামের বিচরণক্ষেত্র ছিল এই পটিয়ায়। তাঁর সহযোদ্ধা বীরকন্যা প্রীতিলতার জন্মভূমি এখানে। ১৯৩০এর দশকে এখানে ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী, বিশেষত যুগান্তর দল ও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল অভিযানের সাথে জড়িত বিপ্লবীরা এখানে সক্রিয় ছিলেন।

সাহিত্যগবেষণায় আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, শরৎচন্দ্রদাস, শশাঙ্কমোহন সেন, আহমদ শরীফের মতো গুণী ও কালজয়ী লেখকদের জন্ম এই পটিয়ায়। সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগেও আমরা পাই কোরেশী মাগন, সৈয়দ সোলতান, সফর আলী, জৈনুদ্দিন, শেখ ফয়জুল্লাহ, চম্পা গাজী, আসকর আলী পণ্ডিতকে।

পটিয়ার বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পটিয়ার গৌরব ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে পটিয়া থেকে নির্বাচিত সাংসদের নেতৃত্বে কাজ চলছে। অবকাঠমোগত উন্নয়ন যেভাবে আমরা প্রত্যক্ষ করি, ঠিক সেভাবে প্রত্যক্ষ করি শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠনের অগ্রগতি। অন্যদিকে সাহিত্যসংস্কৃতিরাজনীতিপ্রশাসন, শিল্পবাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁদের স্বীকৃতি প্রদান ও সাহিত্যসংস্কৃতি চর্চাকে বেগবান করতে গত ডিসেম্বরে উদযাপিত হয়েছে পটিয়া উৎসব। এ উৎসবের সবচেয়ে বড় দিক হলো এলাকার কীর্তিমান ব্যক্তিত্বদের সম্মাননা। মুজিবশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী মহান এই উদ্যোগ গ্রহণ করে আমাদের আবেগকে স্পর্শ করেছেন; প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী চিন্তা চেতনার প্রতিফলন ঘটে যাঁর ভেতরে।

পটিয়া উৎসব’ পটিয়ার মানুষকে যেমন চোখ দেখিয়েছে, তেমনি ‘পটিয়া উপজেলা সাহিত্যমেলা’ পটিয়ার সাহিত্যচর্চার ধারাকে বেগবান করবেসেই প্রত্যাশা আমরা রাখতে পারি। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ ও লালন করে যাঁরা জীবন অতিক্রম করছেন, তাঁদের সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। আমরা এগিয়ে যেতে চাই সামনে, অন্ধকারের পরিমণ্ডল ছেড়ে উজ্জ্বল আলোতে। আমাদের চলার পথে আমরা সবাইকে রাখতে চাই সশ্রদ্ধচিত্তে। বাংলা একাডেমির আয়োজনে সাহিত্যমেলা চলতে থাকুক। চলুক আলোর উৎসব।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো, বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর নীতি-আদর্শ ও নির্দেশনা
পরবর্তী নিবন্ধফজলুল গণি মাহমুদের মৃত্যুতে নাটাবের শোক প্রকাশ