বহমান সময়

পশ্চিমাদের টাকা নেওয়া যায়; উপদেশ নয়!

ফজলুল হক | সোমবার , ৩১ জুলাই, ২০২৩ at ৬:২২ পূর্বাহ্ণ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন বন্দুক হামলায় স্কুলের শিক্ষার্থী এবং তরুণ ব্যবসায়ী মারা যায়। সমপ্রতি দুইজন বাংলাদেশী’র মৃত্যু হয়েছে। যাদের মধ্যে একজনের বয়স ৪২ বছর আর একজনের বয়স ২২ বছর। এই দু’জন বাংলাদেশীর মধ্যে একজনের বাড়ি চট্টগ্রামে। তার বাবা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রেখেছিলেন। ১৫ বছর বয়সে তাঁর ছেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ছয় বছর পর, গত সপ্তাহে বন্দুক হামলায় সে মারা যায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে একটি ফিলিং স্টেশনে কাজ করত। রাত সাড়ে তিনটার সময় একদল যুবক ফিলিং স্টেশনে এসে তার গাড়ি নিয়ে যেতে চায়। সে বাধা দিলে ১৯ বছর বয়সী এক যুবক তাকে গুলি করে। সেই হত্যাকাণ্ডের খবর শোনার পরে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা এবং তাঁদের সন্তানেরা মর্মাহত হয়ে পড়ে। নিহত ছেলেটির পিতা সামসুদ্দিন একটি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। মিরসরাই উপজেলার করের হাটে তাদের বাড়ি। এই বাড়িটি সুধী মহলে বিশেষভাবে পরিচিত। গণমাধ্যমে এই দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক মৃত্যু সংবাদ শোনার পর আমি মিরসরাইর একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষককে ফোন করি। তাঁর কাছ থেকে প্রয়াত শামসুদ্দিনের পরিবারের খোঁজ খবর নেই।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন রাজ্যে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটছে। বন্দুক হামলার এই ঘটনা কানাডাসহ অন্যান্য উন্নত দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্পদশালী দেশ। পৃথিবীর সকল সম্পদের ৯৯ ভাগ মাত্র কয়েক লক্ষ ধনীর হাতে কেন্দ্রীভূত। বাকি এক ভাগ সম্পদের মালিক সাধারণ মানুষ। এই ধনী ব্যক্তিদের ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা, ডলারকে হার্ড কারেন্সি বলা হয়। সে তুলনায় বাংলাদেশের মুদ্রা টাকা, সফ্‌ট কারেন্সি হিসাবে বিবেচিত। আমরা নরম মুদ্রার দেশে বাস করি। আমাদের দেশের মানুষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের অন্য কোনও ধনী দেশে যাওয়ার সুযোগ পেলে আনন্দিত হয়। পৃথিবীর গরীব দেশগুলি থেকে ছোট ছোট বোটে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে অভিবাসন প্রার্থীরা সাগরে ডুবে যায়। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ডলারের প্রয়োজন হয়। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশ ডলারকে রিজার্ভ হিসাবে সংরক্ষণ করে। সেই দিক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা স্বর্ণের মত দামী। এই যখন অবস্থা, তখন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কীসের অভাব ঘটল যে তাদের তরুণ প্রজন্ম মানবতা বিনাশী হয়ে উঠেছে?

প্রায় দুই যুগ আগে যুক্তরাষ্ট্রের কিশোরদের মধ্যে সামাজিক সমস্যা বিষয়ে জেনারেশন মনোবিজ্ঞানীগণ “জেনারেশন এক্স” নামে একটি তথ্য উপস্থাপন করেছিল। এক্স বলতে ওনারা নেতিবাচক বিষয় বুঝিয়েছিলেন। মার্কিন কিশোরদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব কেন তৈরি হচ্ছে? তারা জবলেস ছিল না। তাদের কোনো আর্থিক সঙ্কট নাই। তাদের টাকাপয়সা, গাড়িঘোড়ার অভাব নাই। সে তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ অনেক বেশি অভাবগ্রস্ত। তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুবসমাজে মানসিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে কেন?

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংকট নিয়ে যক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ধনী দেশগুলি উচ্চৈঃকণ্ঠে কথা বলে। কিন্তু এসব দেশ নিজেদের সমাজে কি হচ্ছে সেদিকে তাকায় না। চট্টগ্রামের একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে হত্যার মধ্যে দিয়ে মার্কিন বন্দুকধারী তরুণ আমাদের মনে অনেক কষ্ট দিয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক সংকট অনুসন্ধান করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মনে করি, তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় কিছু গলদ আছে। যা সাধারণভাবে আমরা দেখতে পাই না। সুইজারল্যান্ড এর একটি বনেদি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই জন অধ্যাপক ৯০ এর দশকের শুরুতে আমাকে বলেছিলেন তারা অনেক আগে থেকে “নিড বেইসড শিক্ষা ব্যবস্থা” অনুসরণ করেন। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অধ্যাপকদ্বয় আমাকে বুঝিয়েছিলেন, যখন কোন দেশের প্রযুক্তি এবং শিল্পকারখানা সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত হয়, তখন শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হয়। এর অর্থ হলো, বিভিন্ন শিল্প ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলি কি ধরনের দক্ষ কর্মী চায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সেটা যাচাই করে দেখতে হবে। কমপক্ষে ২০ বছরের একটি পার্সপেক্টিভ প্ল্যান বানাতে হবে। শিল্প কারখানায় ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কি ধরনের ইঞ্জিনিয়ার লাগবে, কি ধরনের টেকনোলজিস্ট লাগবে, কি ধরনের ম্যানেজার লাগবে, কি ধরনের কেরানি লাগবে, কি ধরনের নিরাপত্তা কর্মী লাগবে, এ সকল হিউমেন রিসোর্সের একটি নিড বেইসড বা চাহিদা ভিত্তিক জরিপের মাধ্যমে তা নির্ণয় করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক স্কুল পর্যন্ত সকল কোর্স কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। প্রায় ৩৫ বছর পর, এখন আমাদের ব্যক্তি খাতের শিল্প মালিকদের মুখেও একই কথা শুনতে পাচ্ছি। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও ট্রেডবডি ইন্টারফেস চায় এবং নিড বেইসড এডুকেশন চায়। যেকোন উন্নত দেশে নিড বেইসড এডুকেশন দরকার এটা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে শিল্পসংস্কৃতি, সাহিত্য, গান, কবিতা, আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস ও নীতিনৈতিকতা সব কিছু শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বাদ দিয়ে শুধু মাত্র শিল্পকারখানার জনবল ও চাহিদা পূরণে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমার মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারিবারিক আবহ, শিক্ষার ধরন, পরিবেশ, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও সারা বিশ্বে খবরদারির পেছনে কেবল মাত্র সমৃদ্ধি এবং ব্যবসায়িক স্বার্থচিন্তা প্রাধান্য পায়। তারা গণতন্ত্রের কথা বলে, কিন্তু হিরোশিমানাগাসাকি, ইরাক, লিবিয়া, ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানের দিকে তাকালে তাদের গণতন্ত্র বিষয়ক বক্তব্য জটিল মনে হয়।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে সম্মানসূচক ডিলিট ডিগ্রি প্রদানের অনুষ্ঠানে আমি মঞ্চের খুব কাছাকাছি বসেছিলাম। রাষ্ট্রপতির বক্তব্য শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দফতরের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু আমি কখনো শিক্ষা মন্ত্রীর পদ পাই নাই। যখন আমি ভারতের রাষ্ট্রপতি হই, তখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর পদের দায়িত্ব আমার হাতে আসে। আমি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যাই। আমি মনোযোগ সহকারে সমাবর্তন বক্তার বক্তব্য শুনি। আমি উপাচার্যকে প্রশ্ন করি, বিশ্বের সর্বত্র এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম রয়েছে। এই সুনামের কারণ কি? উপাচার্য আমাকে বললেন, আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষায় পাস করার আগে আমেরিকার বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের চাকরি হয়ে যায়। পাস করার পর আমরা আমাদের ছাত্রদের দেখি সিলিকন ভ্যালিতে সিইও’র পদে তারা বসে আছে। পৃথিবীর এমন কোনও বড় টেকজায়ান্ট নাই যারা আমাদের কাছে এক্সপার্ট কর্মীর জন্য ধর্না দেয় না। প্রণববাবু বললেন, ভারতের খড়গপুর, হায়দরাবাদ, চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর সহ বড় বড় শহরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি নির্বাহী প্রস্তুত করে। ভারতের জন্য ডলার মেকিং প্রক্রিয়া তৈরি করে দিচ্ছে। কেরালার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির নামও উল্লেখ করা যায়। কিন্তু আমার মনে অন্য প্রশ্ন ছিল। আমি উপাচার্যকে বললাম, আপনার এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন? আপনি গবেষণার পেছনে কত রুপি খরচ করেন? কত জন গবেষককে আপনি গবেষণার কাজে উৎসাহিত করেন? এমনকি সারা ভারতে কতজন অধ্যাপক নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে? কেরানি বা নির্বাহী তৈরি করলে বিদেশে চাকরি পাওয়া যায়। ডলার আসে। কিন্তু সফল গবেষণার মাধ্যমে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করা যায়। মানবতাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়া যায়। প্রণববাবুর এই বক্তব্য শুনে পরেরদিন আমি একটি প্রবন্ধ পত্রিকায় পাঠিয়ে ছিলাম। সেটি পড়ে অনেক বিজ্ঞ মানুষ আমাকে ফোন করেছিল। আপনারা যারা আমার এই লেখা পড়বেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কী গবেষণার কাজে মনোযোগী রয়েছে?

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে তাঁর বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে গবেষণায় মনোযোগী হওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়ে থাকেন। এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কৃষি বিষয়ক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থ বরাদ্দ করেছেন। এটি একটি প্রশংসনীয় বিষয়। যদি বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি শুধুমাত্র শিল্প কারখানার জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে গবেষণার কাজ পিছিয়ে পড়তে পারে। তার সাথে সাথে সমাজ এবং উন্নয়ন দুটিই পিছিয়ে পড়বে। আমার মনে হয় পশ্চিমা দেশগুলির শিক্ষাব্যবস্থা ও সামাজিক বন্ধনের মধ্যে এমন ত্রুটি রয়েছে, যার কারণে সেই সব দেশে সহিংসতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। বন্দুক হামলার মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটছে। ভারতের একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘স্পিরিচুয়ালিটি ইন ওয়ার্ক প্লেইস’ নামে একটি ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠান করেছিল। এই বিষয়ে তাঁরা কয়েকটি প্রকাশনাও বের করেছিল। তাঁদের একজন অধ্যাপক আমাকে বলেছিলেন, শিল্পপ্রশাসন খবরদারির মাধ্যমে অধীনস্থ লোকের কাছ থেকে যেভাবে কাজ আদায় করে, সে ভাবে খবরদারির মাধ্যমে এখন কাজ আদায় করা সম্ভব নয়। তাদের মোটিভেশন দিতে হবে স্পিরিচুয়ালিটি এবং নৈতিকতার প্রশিক্ষণ দিয়ে। পৃথিবীর অনেক দেশ ব্যবস্থাপনাকে সহজ করে তুলেছে। মানুষ আনন্দের সাথে কাজ করে। জোর জবরদস্তি করতে হয় না। আমি কলেজে মাস্টার্স ক্লাসে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সাইকোলজি পড়াতাম। আমি মনে করি মানুষের মনস্তত্ত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন কিশোর এবং তরুণদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খবরদারি করতে যতটুকু দক্ষ, নিজ দেশের কিশোর মনস্তত্ত্ব বুঝতে ততটাই ব্যর্থ।

১৯১১ সালে ফ্রেডারিক উইন্সলো টেইলর একটি বই প্রকাশ করেন যা আজ থেকে ১১০ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপতিদের কাছে ভীষণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। বইটির নাম ছিল The Principles of Scientific Management মার্কিনিরা টেলরকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক নামে অভিহিত করেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, তখন শিল্প বিপ্লবের যুগ শুরু হয় নাই। টেইলর শ্রমিক এবং কর্মীদের মধ্যেকার বিশৃঙ্খলার পরিবর্তে শৃঙ্খলা আনার পদক্ষেপ সম্পর্কে লিখেছিলেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে শিল্প মালিকরা ৩৬০% উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর শ্রমিকদের শোষণ করে শিল্প মালিকদের মুনাফা বৃদ্ধির কাজকে সঠিক ব্যবস্থাপনা নয় বলে লেনিন মন্তব্য করেছিলেন। শোষণ ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় তরুণ বা বৃদ্ধ যে কেউ আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। আগ্রাসী মনোভাব হচ্ছে হতাশার বড় লক্ষণ। শোষকেরা বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্রের সবক দিতে পারে। কিন্তু নিজ দেশে হতাশায় নিমজ্জিত কিশোরদের পথ দেখাতে পারে না!

গ্রেট ব্রিটেনে এখনও রাজতন্ত্র বিদ্যমান। এই রাজপরিবার এশিয়া আফ্রিকার আরও অনেক দেশের রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে কাজ করে। কিন্তু আমরা জোর গলায় বলি যে আমাদের গণতন্ত্রের লাইটহাউস হচ্ছে ওয়েস্টমিনিস্টার গণতন্ত্র। তাহলে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র বহাল থাকা অবস্থায় সেটা কীভাবে গণতান্ত্রিক দেশ হতে পারে? আমাদের দেশের সকল শিক্ষিত মানুষ উচ্চশিক্ষার জন্য ব্রিটেন, সুইডেন, যুক্তরাষ্ট্রকে পছন্দ করে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এবং তাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষের সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে। আমাদের শিক্ষিত, এমনকি উচ্চশিক্ষিত লোকেরা যখন যুক্তরাষ্ট্রে বা ব্রিটেনে যায়, সেটাকে আমরা ব্রেন ড্রেন বলি না। কিন্তু এটি একটি বড় ধরণের মেধা পাচার যা টাকা পাচারের চাইতেও ভয়ঙ্কর। পশ্চিমা ভাবধারা, পশ্চিমা চিন্তাচেতনা, পশ্চিমা মূল্যবোধ আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুপ্রবেশ করেছে। আমরা স্বকীয় চিন্তা জগতের রাস্তা হারিয়ে অন্য দেশের চিন্তা ভাবনায় নিমজ্জিত। আমরা ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ব্যবসা বাণিজ্য করতে পারি। কিন্তু আমাদের নিজস্ব চিন্তা ভাবনাকে তাদের চিন্তাভাবনার সাথে বিলীন করতে পারি না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির কিছু নেতা যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনে পড়ে থাকে। এই সুযোগে ধনী দেশগুলি আমাদের রাজনীতিতে নাক গলায়। বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও সমমনা দল এবং বিএনপি ও তাদের সাথে আন্দোলনকারী দলগুলি নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভেদের এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা বিদেশিদের সুবিধা করে দিচ্ছে। সরকারি দল হিসাবে আওয়ামী লিগের প্রতি আমার পরামর্শ হল বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এই আস্থা ও বিশ্বাস বিরোধী দলগুলি যেন গ্রহণ করে সেই ব্যবস্থা করুন। আর বিএনপির প্রতি আমার পরামর্শ হলো আন্দোলনের মাধ্যমে আপনারা আওয়ামী লীগকে দুর্বল করতে পারবেন না। আপনাদের এই দুই শক্তির দ্বন্দ্বে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিদেশিদের সব ধরনের পরামর্শ ও হস্তক্ষেপ উভয় দলকে পরিহার করতে হবে।

আশির দশকে ইউরোপের একটি বিশেষজ্ঞ টিম বাংলাদেশে এসেছিল। এই টিমের সদস্যগণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তারা কেন এসেছিল সেই বিষয়ে জানতে পারি যে, বাংলাদেশের গ্রাম অঞ্চলে যে সকল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বছরের পর বছর ধরে ব্যবসা চালাচ্ছে, তাঁদের ধারণা সেই সব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দিলে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হবে। আমিও তাঁদের কথায় সম্মত হয়েছিলাম এবং তাঁদের কাগজপত্র তৈরিতে সাহায্য করেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল বাংলাদেশের মুদি দোকানদার, টিস্টল মালিক, জেলে, কামারকুমারদের একাউন্টিং, মার্কেটিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে ব্যবসার উন্নয়ন ঘটবে। তার এক বছর পর ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপকের সাথে দেখা হলে উনাকে বলেছিলাম পশ্চিমারা আমাদের গরিব ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে আইডিয়া এবং ফান্ড দেবে। উনি খুব তাচ্ছিল্যের সাথে আমাকে বললেন এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলবেন না। পরে আমার অনুরোধে উনি শুধু একটি মন্তব্য করলেন, “ডোন্ট টেক অ্যাডভাইস ফ্রম ওয়েস্টার্ন এক্সপার্টস”। “ইউ ক্যান টেক দেয়ার মানি, বাট নট অ্যাডভাইস”!

লেখক: প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম; শিক্ষাবিদ ও কলাম লেখক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিষ্ঠান, প্রশাসন ও দাপ্তরিক কাজের মেলবন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়া বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের নিন্দা