কেবল আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও বাড়ছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। আমাদের দেশে দিন দিন বেড়েই চলেছে এর ভয়াবহতা। কাজেই এর প্রতিরোধে এখনই জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বস্তুত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অতিবর্ষণজনিত কারণে সৃষ্ট বন্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তার। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবার্তা প্রণিধানযোগ্য। সমপ্রতি সংস্থাটি বলেছে, আক্রান্ত রোগীর হিসাবে চলতি বছরই বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গু রেকর্ড করতে যাচ্ছে। গত দুই দশক ধরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা যে হারে বেড়েছে, তা বিবেচনায় নিয়েই এর প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, এডিসের বিস্তার রোধ করা না গেলে চলতি বছরই রেকর্ডসংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এবং সামনের দিনগুলোতে হয়তো ডেঙ্গুকে মহামারি ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ পত্রিকান্তরে এ সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস হচ্ছে গৃহপালিত মশা। এটি দালানকোঠায় থাকতে ও বংশবিস্তার করতে পছন্দ করে। তাই যত নগরায়ণ হবে, তত বেশি ডেঙ্গুর ঝুঁকি বাড়বে। শুধু আমাদের দেশে নয়; সিঙ্গাপুর– থাইল্যান্ডেও নগরায়ণের ফলে একই অবস্থা হয়েছে। কোথাও পানি জমে যেন এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে, সে জন্য প্রজনন স্থান ধ্বংস করতে হবে। এর পাশাপাশি উড়ন্ত মশাও নিধন করতে হবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কিন্তু এখন আর ঢাকা শহরে সীমাবদ্ধ নেই; মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ মফস্বলেও দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে। গণপরিবহনের মাধ্যমে এটি শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়েছে। মৌসুমি তৎপরতা নয়; বছরজুড়ে সক্রিয়তা জরুরি। শুধু সিটি করপোরেশন বা পৌরসভাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সমন্বিত পদক্ষেপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে হবে। পাড়া–মহল্লায় সব শ্রেণিপেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করে এডিস মশার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাসাবাড়ি নিয়মিত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। এডিস মশার লার্ভা যেন না থাকে, নিতে হবে সে পদক্ষেপও। প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।
অন্যদিকে, কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মো. গোলাম ছারোয়ার বলেছেন, আমাদের দেশে এডিস মশার দুই প্রজাতির মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়ায় বলে আমরা জানি। এরা এডিস এজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটস। এরা ছাড়াও অন্য কোনো প্রজাতি এই ভাইরাস বহন করছে কিনা তা–ও গবেষণার দাবি রাখে। স্ত্রী এডিস মশা যখন আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত পান করে, তখন ভাইরাস তার নিজের শরীরে গ্রহণ করে তার পর এই ভাইরাসের একটি নির্দিষ্ট সময় মশকের শরীর অতিবাহিত করে, যাকে আমরা ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলে থাকি। ঠিক এই সময় ভাইরাসটি মশকের শরীরের সকল শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রম ব্যবহার করে নিজেকে শক্তিশালী করে। এখন প্রশ্ন হলো– পরিবেশের দূষণ বা পরিবর্তনের ফলে অথবা উপর্যুপরি কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মশকই যখন তার শরীরবৃত্তীয় কার্যক্রমের পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে; ঠিক তখন তার মধ্যে বেড়ে ওঠা ভাইরাসটির কী মাত্রায় পরিবর্তন হচ্ছে তা পরিমাপ করতে পারলেই আমরা ব্যবস্থাপনার ধরন ও প্রয়োগনীতি যথাযথ করতে পারব। মেডিক্যাল এন্টোমোলোজিস্ট গড়ে তোলা ছাড়া এই কাজগুলো কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, ডেঙ্গুসহ অন্যান্য ভেকটরবাহিত রোগ আজ জাতীয় চরম বিপর্যয়ের মুখে আমাদের দাঁড় করিয়েছে। জানিনা প্রয়োজনীয় ঢাল–তলোয়ার ছাড়া কীভাবে সম্ভব এই যুদ্ধাংশী আক্রমণ মোকাবিলা করা। এই অপরিণামদর্শী প্রবল শত্রুর বিরুদ্ধে ঝটিকা অভিযানের জন্য যেমন প্রয়োজন অস্ত্রাগার ও প্রশিক্ষিত সৈন্য বাহিনী, তেমনি প্রয়োজন সময়মতো আক্রমণ। অর্থাৎ উন্নতমানের ল্যাব, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গবেষক ও বিজ্ঞানী এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা সর্বপরি সাধারণ জনগণের নিবিড় সম্পৃক্ততা।
আসলে ঘরের বাইরে মশা নিয়ন্ত্রণ করা সিটি করপোরেশনের কাজ। আর ঘরের ভেতরের মশা নিজেদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সিটি করপোরেশন ঘরে ঘরে গিয়ে মশা মারতে পারবে না। তাই নিজের ঘরের পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা নিজেকেই করতে হবে। ঘরে বা ছাদে রাখা গাছের টব, এসির নিচে, ফ্রিজের নিচে তিন থেকে পাঁচ দিনের বেশি জমা পানি রাখা যাবে না। এগুলো নিজেদেরই মেনে চলতে হবে। জনগণের সচেতনতা জরুরি।