চলতি বছর দেশে ডেঙ্গু যে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে তা ২০১৯ সালের ডেঙ্গু পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেছেন, এবার ডেঙ্গুর সংক্রমণ ২০১৯ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন রোগীর সংখ্যা ছিল এক লাখ ১৩৫৪ জন। এছাড়া ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন কিন্তু হাসপাতালে যাননি এমন আরো কয়েক লাখ রোগী ছিল বলে জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত ডেঙ্গু সম্পর্কিত দৈনিক তথ্যও অবশ্য একই আভাস দিচ্ছে। এই তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসেই মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালকে ছুঁইছুঁই করছে। এরই মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৭৬ জন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন। খবর বিবিসি বাংলার।
আক্রান্তের সংখ্যার হিসাব অনুযায়ী, ২৩ জুলাই দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ২২৯২ জন। সরকারি হিসাবে এটি এখনো পর্যন্ত ডেঙ্গুতে একদিনে হাসপাতালে সর্বোচ্চ রোগী ভর্তির রেকর্ড। এ বছর এখনো পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ।
অধ্যাপক আমিন বলেছেন, বর্তমানে ডেঙ্গু সংক্রমণ মৌসুমের পিক বা শীর্ষে রয়েছে। এই অবস্থা আগামী আগস্ট–সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতেই থাকবে। সুতরাং আমাদের রোগীর সংখ্যা বেশি হবে। রোগীর সংখ্যা বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। গত বছর ডেঙ্গুতে ২৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ বছর ১৭০ জনের বেশি মানুষ মারা গেছে। এই সংখ্যাটাও বেড়ে যেতে পারে, যদি আগামী দুই মাসে আক্রান্ত আরো বাড়ে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন স্থানে চেঞ্জ অব প্যাটার্ন অব দ্য ওয়ে লেংথে আমরা বিভিন্ন ধরনের রোগীর এঙপ্লোশন (বিস্ফোরণ) দেখতে পাচ্ছি। বিশেষ করে এ বছরটা তো সিরিয়াস ইস্যু সারা পৃথিবীতে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি মহামারি আকার ধারণ করতে পারে এমন শঙ্কা রয়েছে। এটা যদি এমন পর্যায়ে চলে যায় যে এটা একটা দেশের আগের দুই–তিন বছরের তুলনায় আক্রান্ত বেশি হয়ে যাচ্ছে এবং মৃত্যুও বেশি হচ্ছে তাহলে সেটা মহামারি হয়ে যাবে।
রোগতাত্ত্বিক সূত্র অনুযায়ী, চিকিৎসার ভাষায় কোনো রোগ জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছে কিনা তা নির্ণয় করার একটি সূত্র রয়েছে। এটিকে বলা হয় টিপিপি বা টাইম, পিপল এবং প্লেস বা জায়গা। এখানে টাইম বলতে অন্যান্য বছরের তুলনায় যদি আক্রান্ত অনেক বেশি হয়, সংখ্যাগত ও মানগত দিক দিয়ে যদি এটি ব্যাপক আকারে হয়। সেপ্টেম্বরেই ডেঙ্গু মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও গত বছর অক্টোবর–নভেম্বরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে।
প্লেস বা জায়গা বলতে যেখানে এটি হওয়ার কথা তার বাইরে যদি অন্যান্য জায়গায় হয় বা এটি আরো ছড়িয়ে পড়ে। যেমন ডেঙ্গু আগে শুধু শহরাঞ্চলে হতো, এখন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়েছ।
জনগণ বলতে যেকোনো বয়সের, যেকোনো লিঙ্গের, যেকোনো স্বাস্থ্য অবস্থায় মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি কোনো মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না। এই তিনটি দিকেই সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে ডেঙ্গুর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন বা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মাহফুজা রিফাত বলেন, ২০১৯ সালের পর এবারের ডেঙ্গু যেমন বাড়ছে তেমনি এতে আক্রান্ত হওয়ার সময় এবং মশার আচরণে পরিবর্তন এসেছে। এটা একটা লক্ষণীয় পরিবর্তন। এছাড়া পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ডেঙ্গুর উপসর্গেও।
এমন অবস্থায় ডেঙ্গুকে যথাযথভাবে ব্যবস্থাপনা করা না গেলে এটি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়েও গুরুত্ব দিয়ে এ ধরনের স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবেলায় এগিয়ে আসা দরকার।
কী ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেছেন, ডেঙ্গু মহামারির আকার ধারণ করার আগ পর্যন্ত হাসপাতালগুলোকে কীভাবে সর্বোচ্চ প্রস্তুত রাখা যায় তা নিয়ে সরকার কাজ করছে। হাসপাতালে রোগী ভর্তির সংখ্যা অনেক বেশি বেড়ে গেলে তখন গেটকিপিং বা বাছাই প্রক্রিয়ার দিকে যেতে হবে বলে জানান তিনি। অর্থাৎ যেসব রোগীর বিপদ চিহ্ন নেই বা যাদের অবস্থা গুরুতর নয় তাদের হাসপাতালে ভর্তি রাখা হবে না। একটা জায়গায় গেটকিপিং থাকবে যেটার মাধ্যমে আমাদের সংশ্লিষ্ট যেসব রোগীর ভর্তি হওয়ার দরকার তারাই যাতে ভর্তি হয়। এর বাইরে ভর্তি হলে তো সমস্যা।
হাসপাতালগুলোর ব্যবস্থাপনার জন্য যে পর্যাপ্ত পরিমাণ সরঞ্জাম, লোকবল এবং টেকনিকাল সাপোর্ট দরকার তা ব্যবস্থা করার জন্য কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এগুলো আমরা চেষ্টা করছি এদিক থেকে সেদিক থেকে ব্যবস্থা করার। হাসপাতালগুলোতে রোগীর বণ্টনে ভারসাম্য আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এক হাসপাতালে যাতে অনেক বেশি রোগী আর অন্যটিতে কম, এমন যাতে না হয় তা ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
ডেঙ্গুর বিপদ চিহ্ন কী : ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেই যে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে তেমনটা নয়। এজন্য যেসব রোগীর মধ্যে বিপদ চিহ্ন নেই বা আগে থেকে কোনো স্বাস্থ্য জটিলতা নেই তাদেরকে বাড়িতে থেতে চিকিৎসা নিতে বলা হবে, যাতে করে হাসপাতালের উপর চাপ কমে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর বিপদ চিহ্নগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রচণ্ড পেটে ব্যথা ও অত্যধিক পানি পিপাসা, ঘন ঘন বমি বা বমি বন্ধ না হলে বা রক্ত বমি বা কালো পায়খানা হলে, দাঁতের মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হলে, ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ধরে প্রস্রাব না হলে, প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হলে, ডায়রিয়া হলে এবং অত্যধিক শারীরিক দুর্বলতা অনুভব। এছাড়া রোগী যদি গর্ভবতী নারী, নবজাতক শিশু, বয়স্ক নাগরিক, ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগে আক্রান্ত হন, শরীরের তাপমাত্রা অত্যধিক কমে যায় বা শরীর বেশি ঠান্ডা হয়ে যায়, তাহলে তার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়া প্রয়োজন। বাড়িতে থাকলেও প্রচুর বিশ্রামে থাকতে হবে। মুখে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার খেতে হবে।.