নির্বাচন এলেই দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি যেমন অন্যরূপ ধারণ করে। উৎসবমুখর পরিবেশের বদলে একটা থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। সরকারি দল ও বিরোধী দলের সমর্থকদের কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়। কর্মীরা রাজনীতির নিয়ম ভেঙে বিভিন্ন উস্কানিমূলক কার্যক্রম করে থাকে। যার ফলে দেশের ভেতর সৃষ্টি হয় বিশৃঙ্খলা ও সংঘাত। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সর্বস্তরের মানুষ।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচির কয়েকদিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ও সংঘর্ষ হয়েছে। এর আগে ঢাকা–১৭ আসনের উপ নির্বাচনেও এক স্বতন্ত্র প্রার্থী হামলার শিকার হন, যা ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সমালোচনার মুখে পড়েছে। রাজনীতিতে ‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশ’ বজায় রাখার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির পক্ষ থেকে পশ্চিমা কূটনীতিকদের আশ্বস্ত করার পরেও রাজনীতি সংঘাতময় হয়ে ওঠার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বিএনপি নেতাদের দাবি – সরকার পরিকল্পিতভাবে তাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সহিংস হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দাবি করছে বিএনপি নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির নামে নিজেরাই সহিংস হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে দুই দলের মধ্যে কোনো আপস, মীমাংসার সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। বরং সামনে সংঘাত আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ রক্ষায় আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও কি বাংলাদেশের রাজনীতি আবার সহিংস রূপ নিচ্ছে?
বলা যেতে পারে, সংঘাতের আশঙ্কা, নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ ও উৎকণ্ঠা, সংলাপ নিয়ে বিতর্ক এখন সবার আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভাবনার মধ্যে এমনই প্রশ্ন রয়েছে, যদি নির্বাচন হয় তা হলে তা সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য হবে তো? বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘যদিও টাকা, পেশি শক্তি, প্রচার মাধ্যম, সামপ্রদায়িক শক্তিকে কাজে লাগানো, আঞ্চলিকতা নিয়ে আবেগের ব্যবহার নির্বাচনের গণতান্ত্রিক চরিত্রকে নষ্ট করে, তারপরও জনগণের সরল প্রত্যাশা, একটা আপাত সুষ্ঠু নির্বাচন হোক, তর্ক–বিতর্ক হোক, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোট কেন্দ্রে যেতে পারুক এবং প্রত্যাশা পূরণ না হলে প্রতিবাদ করার পরিবেশ থাকুক। কিন্তু এই সরল চাওয়াটাও কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে।’
নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই সময়ে রাজনীতির মাঠ ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন গবেষক ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা। বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে তাঁদের একজনের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জানান, বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না এবং এই এক দফা দাবিতে তারা মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। যত আন্দোলন করার হয় তারা করবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। এই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচির কারণে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হতে পারে বলে তিনি মনে করছেন। তিনি বলেন, হামলা, সংঘর্ষ চলতেই থাকবে – যদি না এক পক্ষ নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু এখানে কোনো পক্ষই নিজেদেরকে নিবৃত্ত করবে বলে মনে হয় না। বিএনপিকে দমন করতে সরকার কঠোর অবস্থানে গেলেও বিএনপির এখন পর্যন্ত সংঘাতে না জড়ানোকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন তিনি। দুই পক্ষই যদি মারমুখী হয়ে যায় তাহলে সামনের দিনগুলোয় পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। দুই পক্ষের মধ্যে কোন ধরনের আপস বা মীমাংসার রাস্তা দেখছেন না তিনি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসতে চাইবে। আর ক্ষমতায় থাকতে হলে তাকে নির্বাচন ম্যানিপুলেট করতে হবে। সরকারের এই কর্মকাণ্ড যদি বিরোধীরা মেনে না নেয়, কঠোর অবস্থান নেয় তাহলে সংঘাত–সংঘর্ষ অনিবার্য।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, রাজনীতিতে বিতর্ক থাকবে, মতপার্থক্য থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য এখন নির্বাসিত বলে রাজনীতিতে আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। সংলাপ হলে কি সমাধানে আসা যাবে আবার সংলাপ নয়, কথার যুদ্ধ কি সংঘাত অনিবার্য করে তুলবে? পরিস্থিতি দেখে দ্রব্যমূল্য, বেকারত্ব, শিক্ষা চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধিতে নাকাল মানুষেরা রাজনীতিতে সংঘাত আর জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংকটের আশঙ্কা করছে। তাই নির্বাচনী সহিংসতা বন্ধে সব মহলের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রয়োজন।