মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতির কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ। অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। বেঁচে যাওয়াদের সুস্থ হতে তিন সপ্তাহ থেকে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসরা বলছেন, মোট সড়ক দুর্ঘটনায় চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় ৪২ শতাংশই মোটরসাইকেলের। অনেকের হাত–পা কেটে ফেলতে হয়। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অত্যাধুনিক মোটরসাইকেল বাজারে আসছে। মুহূর্তেই গতি ওঠা মোটরসাইকেলগুলো সহজে দুর্ঘটনায় পড়ে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জানিয়েছেন, গতির নেশার লাগাম ঘর–পরিবার থেকেই টানতে হবে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৭০ শতাংশ। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ থেকে ৬ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঈদুল ফিতরে ১৬৫টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৬৭ জন নিহত ও ১২০ জন আহত হয়েছেন, যা মোট দুর্ঘটনার ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ, নিহতের সংখ্যা ৫১ শতাংশ ও আহতের সংখ্যা ২১ দশমিক ৩ শতাংশ। তাছাড়া গত জুন মাসে ১৬০ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৭৬ জন নিহত, ১১৭ জন আহত হয়েছেন। যা মোট দুর্ঘটনার ৩৩.৬৮ শতাংশ, নিহতের ৩৭.০৫ শতাংশ ও আহতের ২৪.৬৩ শতাংশ।
অন্যদিকে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ‘ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঈদুল আজহার আগে–পরে ১৫ দিনে (২৩ জুন থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত) দেশে ১১৭টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০৬ জন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষে আক্রান্ত হয়েছেন ২০.৪৮ শতাংশ, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৬.৫০ শতাংশ, মোটরসাইকেল বা অন্য যানবাহন দ্বারা ধাক্কা / চাপায় আক্রান্ত হয়েছেন ৩৯.৭৫ শতাংশ, মোটরসাইকেল পথচারীকে ধাক্কা / চাপা দিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে ৮.৪৩ শতাংশ এবং সড়কের গর্ত ও স্পিড ব্রেকারের কারণে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪.৮১ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার ১০টি কারণ আমরা চিহ্নিত করেছি। সেগুলো হলো– কিশোর–যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, দেশে অতি উচ্চগতির মোটরসাইকেল ক্রয় ও ব্যবহারে বাধাহীন সংস্কৃতি ও সহজলভ্যতা, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির শিথিলতা, চালকদের অদক্ষতা ও অস্থিরতা, সড়ক–মহাসড়কে ডিভাইডার না থাকা, সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণা না থাকা, পারিবারিকভাবে সন্তানদের বেপরোয়া আচরণকে প্রশ্রয় দেওয়া এবং উচ্ছৃঙ্খল যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর ক্ষেত্রে কলুষিত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা।
দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনতে কয়েকটি প্রস্তাব করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। সেগুলো হলো– কিশোর–যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো বন্ধে নিতে হবে কঠোর পদক্ষেপ। উচ্চ গতিসম্পন্ন মোটরসাইকেল উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ। বেশি বেশি দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ। সড়ক পরিবহন আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ। মহাসড়কে মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন তৈরি এবং স্বল্পগতির স্থানীয় যানবাহন বন্ধের উদ্যোগ। সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে গণমাধ্যমে চালাতে হবে সচেতনতামূলক প্রচারণা।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সড়ক নিরাপত্তার কথা সরকার মুখে–মুখে বলছে, অন্যদিকে মোটরসাইকেলের সিসি বাড়ানো হচ্ছে। আমরা সড়ক দুর্ঘটনার যে রিপোর্টগুলো পড়ছি, সেখানে দেখা যাচ্ছে, ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেলই দায়ী।
গত ১৩ জুলাই রাউজানে আত্নীয়ের বিয়ের বাজার করতে শহরে যাওয়ার পথে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীসহ দুইজন প্রাণ হারিয়েছেন। বোয়ালখালীতে সিএনজিচালিত টেম্পুর সাথে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে ১২ জুলাই সকাল পৌনে ১০টার দিকে দুই আরোহী আহত হয়েছেন। ৯ জুলাই নগরের কোতোয়ালী থানা কদমতলী ফ্লাইওভার টিকটিকি (টেম্পু) গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে মো. মুজিবুল হক (৬৫) নামে এক মোটরসাইকেল চালক নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় মো. জসিম উদ্দিন (৪৫) নামে অপর এক মোটরসাইকেল আরোহীও আহত হন। চট্টগ্রামের কল্পলোক আবাসিক তুলাতুলি এলাকায় ৯ জুলাই সন্ধ্যায় মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় বাঁশখালীর ইমন দাশ রাসেল (২৬) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এ সময় তার সাথে অপর যুবক নাজিম উদ্দিন গুরুতর আহত হন। বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়া সড়কে মাইক্রোবাসের ধাক্কায় এক মোটরসাইকেল চালকের মৃত্যু হয়েছে। ওই ব্যক্তির নাম মো. সুমন (২৮)। তিনমাস আগে বিয়ে করেছেন সুমন। ২৮ জুন সন্ধ্যা ৭টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তার পেছনে বসা যাত্রী সামান্য আহত হয়েছেন। ১৮ মার্চ নগরের পাহাড়তলী থানাধীন এ কে খান মোড় এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত ও চালক আহত হয়েছেন। ১৮ মার্চ দুপুর সাড়ে বারটার দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ১৪ মার্চ প্রাইভেট কারের ধাক্কায় মোহাম্মদ মোজাহিদ (৩২) নামে মোটরসাইকেল আরোহী এক পুলিশ সার্জেন্ট নগরের হালিশহর থানাধীন বন্দর টোল রোড়ে নিহত হয়েছেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে তেলবাহী ট্যাংকারের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী মাহবুবুল আলম নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু হয়েছে। ১ জানুয়ারি চট্টগ্রামে সড়ক দুর্ঘটনায় মোমিন (১৭) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু হয়েছে।












