(পর্ব : ২)
ঐতিহ্যবাহী লালদিঘি–আবহমান বাংলা সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। অতি প্রাচীন ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাভাষী মানুষগুলোর প্রাণকেন্দ্র এই লালদিঘির মাঠ। অনেক বছর ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী বলি খেলা বাঙালীর ঋদ্ধ ইতিহাসকে ফুটিয়ে তুলেছে এক অনন্য সাজে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সে মাঠের আশেপাশেই চলছে অপেশাদারী চিকিৎসা–যার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে গ্রাম থেকে ছুটে আসা নিরীহ রোগী ও রোগীর স্বজনেরা–এমনকি বর্ণাঢ্য শহরের অনেক সাধারণ মানুষদেরও। কান থেকে ময়লা পরিষ্কার করার নামে কিছু অপেশাদার হাতুড়ে ডাক্তার নামধারী দীর্ঘদিন ধরে অপচিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এর শিকার হচ্ছে অসচেতন নাগরিকবৃন্দ। wax বা কানের খৈল বের করার নামে এক ধরনের সূচালো আংটা কানের external auditory canal – এ ঢুকিয়ে দেয়। ফলশ্রুতিতে ময়লা আসার সাথে সাথে কানের পর্দাও চলে আসে। আর এতে চিরদিনের জন্য বধির হয়ে যায় সংশ্লিষ্ট রোগী। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণও হয়। কানে প্রচন্ড ব্যথা হয়। ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো শব্দ হয়। সাথে সাথে মাথাটাও ভারী হয়ে আসে। রেজিষ্ট্র্রার্ড ইএনটি ডাক্তারের কাছে গেলে এই অপচিকিৎসা ধরা পড়ে। পরবর্তীতে কানের পর্দা বা tympanoplasty অথবা হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতে হয়। এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন অনেকটা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। শুধু লালদিঘির আশেপাশে নয়, চট্টগ্রামের অনেক অলিতে–গলিতেও এদের উৎপাত দেখা যায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষরা। কান থেকে ময়লা বের করার নামে কানের পর্দার যে মারাত্নক ক্ষতি হচ্ছে তা বন্ধ করার কি কেউ নেই? আবার এদিকে কিছু বেড়াইজ্জা মহিলা কান থেকে পোকা ফেলানোর নামে প্রতারণা চালিয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। এটি শুধু শহরে নয়, গ্রামাঞ্চলেও এদের উৎপাত দেখা যায়। এদের হাঁক–ডাক এই রকম যে, ‘পোক ফেলাই, জোঁক ফেলাই’। অনেক বয়স্ক মহিলারা–যারা কুসংস্কারে বেশি বিশ্বাস করে তারা এদের ফাঁদে পড়ে প্রতারণার শিকার হয়। পোকা ফেলানোর নামে এরাও কানের পর্দার ক্ষতি করে থাকে প্রায়শঃ। অথচ যে পোকাগুলো তারা প্রদর্শন করে এগুলো কানের পোকা নয়, বিশেষভাবে কটনের মধ্যে রাখা অন্য জায়গা থেকে সংগৃহীত পোকাগুলো প্রদর্শন করে থাকে। আর এই অপচিকিৎসা পেয়ে অজপাড়াগাঁয়ের অনেক মূর্খ মহিলারা স্বস্তি ফিরে পায়। আর এতেই তারা বেজায় খুশি। পরিবারের অন্য সদস্যরা যখন প্রতারণার শিকার এই মহিলাদের ইএনটি বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে আসেন তখন বিষয়টা খুব সহজেই ধরা পড়ে এবং তাদের প্রতারণার কৌশল উন্মোচিত হয়। আমরা ছোটবেলায় গ্রামের বাড়ীর আশেপাশে এদের উৎপাত দেখতাম বেশি। আমার মা, চাচীরাও এদের কথা বিশ্বাস করে প্রতারণার শিকার হতেন। এক্ষেত্রে একটি কথা বলে রাখা দরকার, যারা দীর্ঘদিন ধরে CSOM (chronic suppurative otitis media) নামক রোগে ভোগেন তাদের ক্ষেত্রে কিছু কিছু রোগীর কানের মধ্যে সাদা বর্ণের পোকা দেখা যায়। যাদেরকে বিজ্ঞানের ভাষায় maggot নামে অভিহিত করা হয়। terpenine কটনের মধ্যে soak করে external auditory canal এর মুখে দিতে হয়। আর এই তৈলের আকর্ষণে সধমমড়ঃগুলো কানের বাইরে চলে আসে। আর এটাই হচ্ছে এ যাবৎ কালের সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পোকাগুলো শুধুমাত্র যারা neglected case– তাদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। আবার নাকে Atrophic rhinitis নামক রোগটিতে crust জমা হয় বেশি। এটিকে autoimmune diseaseও বলা হয়। দীর্ঘদিন ধরে যারা এই রোগে ভোগেন তাদের ক্ষেত্রে maggotএর উৎপত্তি হয়। আর চিকিৎসা পদ্ধতি কানের maggot এর মতোই। সাধারণ রোগী সমাজ এই তথ্যগুলো জানেন না বলেই এই প্রতারকদের খপ্পরে পড়তে বাধ্য হয়। আর্থিক সংকটের কারণে যারা এই অপেশাদারী চিকিৎসা করে থাকেন তাদেরকে মোটিভেশন করে সামাজিকভাবে পুনর্বাসন এখন সময়ের দাবি। আর এতে দু’পক্ষেরই লাভ হয়। সাধারণ রোগীরা এই অপচিকিৎসা থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে, সমাজকেও বাঁচাতে পারে। আর কুপথে ধাবিত অপেশাদারী চিকিৎসায় জড়িতরা বেঁচে থাকার একটা উপায় খুঁজে নিতে পারে–যদি তারা প্রশাসনিক সার্বিক সহযোগিতা লাভে সক্ষম হয়।
এদিকে mumps বা acute parotitis নামে নাক, কান ও গলার রোগটি এখন যেন মহামারীতে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রেও রোগী বা রোগের স্বজনেরা parotid area তে চুন লাগিয়ে দেয়। এতে বলা হয়ে থাকে–swelling বা ফুলা কমে যাবে। অথবা একধরনের প্লাষ্টার parotid area তে লাগিয়ে দেওয়া হয় ফুলা কমানোর আশায়। অথচ একটি সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি–যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সমর্থন করে না। অথচ mumps রোগটি ভাইরাসজনিত। mumps নামক ভাইরাস দ্বারা সংঘটিত হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না করালে মারাত্নক বিপর্যয় ঘটতে পারে। যেমন চিরদিনের জন্য never deafness হয়ে যেতে পারে এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে অন্ডকোষ ফুলে যেতে পারে। আর যদি steroid coverge দেয়া হয় তাহলে এই দুটি complication এড়ানো যেতে পারে।
লেখক: সভাপতি, রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল