চট্টগ্রামের মনীষীদের কীর্তি ও কৃতি তুলে ধরা হোক : তৈরি হোক ইতিহাস সচেতন প্রজন্ম

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ১৮ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রাজনীতিবিদ এটিএম পেয়ারুল ইসলামকে অভিনন্দন জানাই চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সংরক্ষণে সুন্দর উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। এ ধরনের উদ্যোগ সত্যি প্রশংসার দাবিদার। এর মাধ্যমে আগ্রহী যে কেউ চট্টগ্রামের হাজার বছরের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবেন। গত ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত এক সভায় জানানো হয়েছে, চিরন্তন চট্টগ্রামকে তুলে ধরবে ‘চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের ঐতিহ্য কর্নার’। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের ১৮ তলা বিশিষ্ট নতুন ভবনের ৮ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরে এই ঐতিহ্য কর্নার স্থাপন করা হবে। যাতে চট্টগ্রামের বীরত্ব, ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হবে। নগরীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সভায় উপস্থিত ছিলেন এবং তাঁদের মতামত ব্যক্ত করেন।

পত্রিকায় সংবাদটি পাওয়ার পর প্রথমেই কিছুটা খটকা লাগে। এতো বড় চট্টগ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি সংগ্রামের চিত্র কীভাবে আট হাজার বর্গফুটের একটা ফ্লোরের মধ্যে তুলে ধরা সম্ভব! পরে চট্টগ্রাম একাডেমির একটা অনুষ্ঠানে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম যখন বলেন, ‘এটা একটা সূচনামাত্র। প্রতীকী হিসেবে প্রদর্শন। আমরা সরকারের কাছে ৫ একর জায়গা চেয়েছি। সেটা পেয়ে গেলে আমরা স্বপ্নের চট্টগ্রাম ঐতিহ্য কর্নার স্থাপন করতে পারবো’, তখন আমাদের কাছে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য কর্নার স্থাপনে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগকে আমরা চট্টগ্রামের সমস্ত সাহিত্যকর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীর পক্ষ থেকে স্বাগত জানাই।

আমাদের চট্টগ্রামের রয়েছে সমৃদ্ধ অতীত। আমরা জানি, ১৮৫৭ সালে হাবিলদার রজব আলী তার সহযোগীদের নিয়ে কারাগার আক্রমণ, অস্ত্রাগার দখল করে জানান দেন সিপাহী বিদ্রোহে চট্টগ্রামের অবস্থান। এরই ধারাবাহিকতায় গত শতকের প্রথমার্ধে চট্টগ্রামের মাটিতেই জ্বলতে থাকে বিপ্লবের আগুন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক সূর্যসেন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রাণের বিনিময়ে এগিয়ে যায় মুক্তি সংগ্রাম। সেই চট্টগ্রাম বিপ্লবের সূতিকাগার। বিপ্লবের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন ও বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের বাড়ি যথাক্রমে রাউজান ও পটিয়া হলেও একসময় তাঁরা বাস করতেন চট্টগ্রাম শহরের জামালখান ওয়ার্ডে। জানা যায়, দেওয়ানজী পুকুরের পূর্ব পাড়ে অনুশীলন সমিতির চারু বাবুসহ মেস করে থাকতেন মাস্টারদা। বীরকন্যা প্রীতিলতার পৈতৃক বাসভবন ছিল আসকর দীঘির দক্ষিণে। কিন্তু মাস্টারদার স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য কোথাও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। জেএমসেন হলের মাঠে তাঁর একটি আবক্ষ ভাস্কর্য আছে বটে, নগরের কোথাও তাঁর স্ট্যাচু নেই। একইভাবে বলা যায়, বীরকন্যারও নেই কোনো স্মৃতিফলক। সাংবাদিক নাসিরুদ্দিন চৌধুরী এজন্য বুকভরা ক্ষোভ নিয়ে লিখেছিলেন, ‘এত বড় মহানগর চট্টগ্রাম, পরাধীনতার দাসত্বের শৃঙ্খল ছিন্ন করে যার বুকে একদিন তিনি স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়েছিলেন, সেই চট্টগ্রামে মাস্টারদার নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ বা কোনো উদ্যানের নামকরণ, নিদেনপক্ষে একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের জন্য তিল পরিমাণ জায়গা ছেড়ে দিতেও আমরা কত কুণ্ঠিত!’

এখানে বলে রাখা ভালো, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধানে দৈনিক আজাদীর পৃষ্ঠপোষকতায় জামাল খানের ওয়ার্ড কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন একটি প্রশংসনীয় কার্য সম্পাদন করেছেন। একটা দুর্দান্ত কর্মযজ্ঞের উদ্বোধন হলো ২০২১ সালের ডিসেম্বরে। চট্টগ্রাম মহসিন স্কুলের দেয়ালে চট্টগ্রামের ৩১ জন মনীষীর পোর্ট্রেট পরিচিতি লিপিবদ্ধ হলো, যা নির্মিত হয়েছে এমএস প্লাজমা কাচ দিয়ে। এর শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘চট্টল গৌরব’। ‘সবুজে সাজবে নগরী, নান্দনিকতায় সমৃদ্ধ হবে জামাল খান’ এ স্লোগানকে উপলক্ষ করে শৈবাল দাশ সুমনের প্রথম প্রয়াস ছিল ডা. আবুল হাসেম চত্বরে দৃষ্টি নন্দন ফোয়ারার ব্যবস্থা। এরপর খাস্তগীর স্কুলের সীমানা প্রাচীরে টেরাকোটায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে বায়ান্ন, ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত পুরো ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ‘বরেণ্য বাঙালি’ শিরোনামে বিশ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তির প্রতিকৃতি ও উদ্ধৃতি স্থান পেয়েছে সেন্ট মেরীস স্কুলের দেয়ালে। সেই ধারাবাহিকতায় ৩১ জন মনীষীর পোর্ট্রেট পরিচিতির সূচনা হলো।

আমরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে আরো কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরতে চাই। বীর চট্টগ্রামের প্রয়াত রাজনীতিবিদ স্বাধীনতা সংগ্রামী, সাহিত্যিকদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনসূচক কিছু প্রতীকী কর্ম সম্পাদন করা যায়। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে আছেন সূর্যসেনের সঙ্গে ফাঁসির কাষ্ঠে আত্মাহুতি প্রদানকারী বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার, বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, বিপ্লবী লোকনাথ বল, যাত্রামোহন সেন, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, কাজেম আলী মাস্টার, লোকমান খান শেরওয়ানী, কমরেড মোজাফর আহমদ, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, অধ্যাপক পুলিন দে প্রমুখ। তাঁদের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য তাঁদের জন্মভিটায় স্মৃতিফলক স্থাপন করতে পারে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ।এ কাজ শেষ হলে শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রে যাঁদের অবিস্মরণীয় অবদান রয়েছে, তাঁদের স্মৃতিরক্ষায় ভূমিকা পালন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কাকে কাকে এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, তাঁদের নাম নির্বাচনের জন্য একটা বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা যেতে পারে। কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত মনীষী যুক্ত হবেন এই তালিকায়। মোট কথা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবকটি প্রগতিশীল আন্দোলনে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের মধ্য থেকে প্রয়াত মনীষীদের উপস্থাপন করা দরকার। এছাড়া সাংবাদিকতাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ভূমিকা পালনকারীদেরও মূল্যায়ন করতে পারলে কার্যক্রমটি আরো বেশি সার্থক হবে। আপাতত ৮ হাজার বর্গফুটের এই ফ্লোরে এমন একটা মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা যায়, যেখানে দর্শনার্থী বা পর্যটকদের জন্য থাকবে চট্টগ্রামের ইতিহাসঐতিহ্য সংবলিত বই বা সংকলন। থাকতে পারে নানা অঙ্গনে বিখ্যাত ও গুণীদের জীবন কথা। চট্টগ্রামকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন প্রকাশনাও রাখা যেতে পারে।

যতটুকু জেনেছি, ‘চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের ঐতিহ্য কর্নার’ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলামের একটা স্বপ্ন। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি সাহিত্যানুরাগী ও ঐতিহ্যসন্ধানী হিসেবে খ্যাত। তাই তিনি এ কার্যক্রমে যুক্ত করেছেন দেশসেরা ব্যক্তিত্বদের। তবে এ কাজে আরো কিছু ক্রিয়েটিভ মানুষকে সঙ্গে রাখতে হবে কাজের সাফল্যের জন্য। ঐতিহ্যের এই চট্টগ্রামের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা এবং চট্টগ্রামের হারানো গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে হলে এ ধরনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান, বিশেষ করে চট্টগ্রামের মনীষীদের কীর্তি ও কৃতিকে এভাবে উপস্থাপন করা গেলে ইতিহাস সচেতন প্রজন্ম তৈরি হতে পারে।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবক্ষয়মুক্ত সমাজ গঠনে জনসচেতনতাকে প্রাধান্য দিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআল্লামা তৈয়্যব শাহ্‌ (রহ.) ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের পথপ্রদর্শক