অবক্ষয়মুক্ত সমাজ গঠনে জনসচেতনতাকে প্রাধান্য দিতে হবে

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৮ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৩৬ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক বিশ্বের অসংগঠিত সমাজ ব্যবস্থায় দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়নের নেতিবাচক ফল হলো কিশোর অপরাধ। পরিবার কাঠামোর দ্রুত পরিবর্তন, শহর ও বস্তির ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ এবং সমাজ জীবনে বিরাজমান নৈরাজ্য ও হতাশা সহ বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধির কারণে বর্তমান সময়ে দেশে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে। অপ সংস্কৃতির বাঁধ ভাঙা জোয়ার ও নিয়ন্ত্রণহীন যত্রতত্র মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্মীয় অনুভূতির সুযোগে কোমলমতি শিশুদের রাজনৈতিক ধর্মীয় বিরোধীয় পক্ষকে গায়েল করার প্রবণতার ফলে দিন দিন অপরাধ প্রবণতা ও সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ এ সময়ে কফির কাপে তুফান তুলবে তরুণ প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা। সৃষ্টিশীল আড্ডায় তারা হবে সারথি। এটি না হয়ে ঘটছে অন্য কিছু। সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য ও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে বেড়েছে খুন, খারাবি। আর মাদক ব্যবসার কৌশল পরিবর্তন করে এখন নগরীর বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য এলাকার ফ্ল্যাট ও বাসাবাড়িতে চলছে বিকিকিনি ও সেবন। এছাড়া গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য চলে নগরীতে। গত ছয় মাসে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িত ৮০৭ জনকে গ্রেফতারের পর র‌্যাবের পর্যবেক্ষণেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। সামনে নির্বাচনের সময়। এ সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে কিশোরদের ব্যাপক ব্যবহারে সহিংসতা বৃদ্ধি পাবার শঙ্কা রয়েছে বিশেষজ্ঞ মহলের।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘তের চৌদ্দ বছরের মতো এমন বালাই আর নেই’।

কিশোর অপরাধের সবচেয়ে বড় কারণ হলো পারিবারিক অসচেতনতা। শিল্পোন্নত ও পুঁজিবাদী সমাজের মতো বর্তমানে স্বল্পোন্নত সমাজেও কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে কিশোর অপরাধের প্রবণতা বাড়লেও সাম্প্রতিককালে এ প্রবণতা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সমাজে বিদ্যমান হতাশা, নৈরাজ্য আর দারিদ্র কিশোর অপরাধ সৃষ্টির প্রদান কারণ। শহরের দূষিত পরিবেশ মানবেতর জীবনযাপন ও অশিক্ষা, ক্ষুধা, দারিদ্র্য কিশোরদের চুরি, ছিনতাই, পকেটমারের মতো অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করে। মূলত সামগ্রিকভাবে কিশোর অপরাধের প্রধান কারণগুলো হলো, () ভগ্ন পরিবার ও পিতামাতার দাম্পত্য কলহ যেখানে আবেগ, ভালোবাসা ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে, () চরম দারিদ্র্য ও পিতামাতার অবহেলা শিশুশ্রম ও জোরপূর্বক শিশুকে কাজে বাধ্য করা, () খারাপ সঙ্গীর সাথে চলাফেরা করা পারিবারিক অস্থিতিশীলতা ও অসম্প্রীতি, () পিতা বা মাতার পুনর্বিবাহ, () মা কর্মজীবী হওয়ায় পর্যাপ্ত শিশুযত্নের অভাব, () অতিরিক্ত শাসন, রক্ষণশীলতা ও বাবামার পরস্পরবিরোধী মানসিকতা, স্বার্থপর ও ফন্দিবাজ রাজনীতিবিদ কর্তৃক কিশোরদের পিকেটিং এ ব্যবহার, সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অভাব এবং অপসংস্কৃতির অনুপ্রবেশ। এসব কারণে সমাজ কলুষিত হচ্ছে, পরিবেশ হচ্ছে দূষিত।

আজকের কিশোর কিশোরীরা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তাই কিশোর অপরাধের প্রবণতা দেশ, জাতি ও সমাজের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দেয়। কিশোর অপরাধের প্রভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি ও শিক্ষার সুষ্ঠ পরিবেশ নষ্ট হয়। শিশু কিশোর দ্বারা রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ছিনতাই, চাঁদাবাজি, পকেটমারের মতো অপরাধ জনগণের আর্থসামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটায়। ছাত্রী অপহরণ, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ ইত্যাদি কারণে স্কুলকলেজগামী ছাত্রীরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে। কিশোর অপরাধের কারণে সমাজে মাদকাশক্তিও বেড়ে চলেছে যা সমাজ জীবনে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। সর্বোপরি কিশোরদের অর্থবহ জীবনকে ধ্বংস করে জাতিকে অন্ধকারচ্ছন্ন ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিশোররা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে? তা নিয়ে গবেষণা থাকলেও সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্কারগুলো তাতে কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না বা হচ্ছে না।

সমাজের যে সব স্থানে বা পরিধিতে অপরাধ প্রবণতার অংকুরোধগম ঘেটে চলেছে সেখানেই প্রথমে সংশোধন ও কঠোর আইনের প্রয়োগ জরুরি। এ অঞ্চলে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ নিয়ে প্রথম ১৯৬০ সালে গবেষণা করা হয়। তখন পুলিশের জন্য ‘স্ট্যাডিজ ইন জুভেলাইন ডেলিনকোয়েন্সি এ্যান্ড ক্রাইম ইন ইস্ট পাকিস্তান’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেন কলেজ অব স্যোশাল ওয়েলফেয়ার রিসার্চ সেন্টারের গবেষক সালাহ উদ্দিন আহমেদ।

পাকিস্তান আমলে কিশোরদের অপরাধে শীর্ষে ছিল, চুরি আর পকেটমার। বর্তমানে তারা ক্রমশ মাদক, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মারামারির ন্যায় অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।

সন্তানদের যদি আমরা সত্যিকারভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ মনে করি, তাহলে কঠিন এ সময়ে নিশ্চুপ বসে থাকলে চলবে না। যে অবস্থায় আমরা এখন আছি, একে সামাজিক অবক্ষয়ের বিপজ্জনক পর্যায় বলা যেতে পারে। এর থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। কিশোরেরা যখন ভয়ানক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারে না। পরিবারের মাধ্যমে, স্কুল, কলেজ, পাঠশালায়, সমাজের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং ধর্মীয় ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে এর প্রতিকার করা এবং সমাধান সম্ভব।

যেখানে শিশুদের নৈতিকতা শেখানো হবে, ভালো মন্দের পার্থক্য বোঝানো হবে। অতীতে আমরা শিশু বেলায় বাল্য শিক্ষায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নীতিবাক্য পড়ে এসেছি। বর্তমানে তা শিশুকাল হতে প্রাথমিক পাঠে নতুনভাবে পড়াতে হবে ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কথা মহাপাপ, গুরুজনকে ভক্তি করিবে।’ নিয়মানুবর্তিতা, বড়দের সম্মান করা, মাদককে না বলার শিক্ষা দেয়া এখন জরুরি। ছেলে মেয়েরা যাতে একে অপরকে সম্মান করতে শেখে, ভিন্ন ধর্মবর্ণ মত বর্ণের প্রতি শিশু বয়সেই শ্রদ্ধাশীল হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে তা পাঠ্যসুচির অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।

অপরাধ বিজ্ঞানী বিসলার বলেছেন, ‘কিশোর অপরাধ হলো প্রচলিত সামাজিক নিয়মকানুনের উপর অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরদের অবৈধ হস্তক্ষেপ।’ অন্যদিকে অপরাধ বিজ্ঞানী বার্ট বলেন, ‘কোনো শিশুকে তখনই অপরাধী মনে করতে হবে যখন তার অসামাজিক কাজ বা অপরাধ প্রবণতার জন্য আইনগত ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবিনা শারমিনের মতে, ‘সমাজ বিজ্ঞান বলছে, পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধুবান্ধবরা কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। একে বলা হয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, এ নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে গেছে।’

আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধুমপান বা দুষ্টুমিপনা করলে পাড়ার মুরব্বিরা শাসন করতেন, স্কুল কলেজে ছোট ভাইদেরকে বড়রা শাসন করেছে। এখন পাড়ার মুরব্বীরা এদেরকে দেখে নিজেরা ভয় পান। অন্যদিকে বড় ভাইয়েরা শাসন করাতো দূরে থাক বরঞ্চ নিজেরাই তাদেরকে ব্যবহার করে অনৈতিক কাজ করিয়ে নেন এবং নিজেরা গড ফাদারের ভূমিকায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করেন। কিশোর অপরাধের ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করে আমাদের সকলের উচিত কিশোরদের অন্ধকার থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনা। কিশোর অপরাধ সৃষ্টিতে শুধু কিশোররাই দায়ী নয়। এজন্য দায়ী আমাদের বিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা। তাই সরকারি প্রচেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় নিম্নোক্ত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের সুপারিশ করছি।

কিশোর অপরাধ মোকাবিলায় সর্বপ্রথম এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

কিশোরদের সুষ্ঠু আবেগীয় ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে যত্নবান হতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র শিশু কিশোরদের জন্য সুশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিশু কিশোরদের মানসিক বিকাশে পিতামাতাকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সন্তানের ভালোলাগার ও মন্দলাগাকে বিচার করতে হবে। দেশে পর্যাপ্ত কিশোর অপরাধ সংশোধন কেন্দ্র গড়ে তুলতে হবে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমগুলো শিশুর মানসিক বিকাশের উপযোগী কার্যক্রম ও অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে।

দেশের শিশু কিশোর বিষয়ক সাহিত্যিক, কবি ও সংগঠকরাও এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কৈশোরকাল মানুষের ভবিষ্যৎ জীবন গঠনের সময়। এ সময় থেকেই মানুষ অনেক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে পরিপূর্ণ জীবন গড়ে তুলতে শুরু করে। কিন্তু ক্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের কারণে অকালেই সে আশাহত হয়। হতাশা আর নৈরাজ্য জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়। কিশোরের সুপ্ত প্রতিভা অংকুরে বিনষ্ট হওয়ায় তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। তাই যে সকল বহুমুখী কারণে কিশোর অপরাধের সৃষ্টি তা রোধ করতে হবে। আমাদের বর্তমান কিশোরদের প্রকৃত মানুষ ও নিরপরাধী হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেই জাতির উন্নতি সম্ভব।

তরুণ, কিশোর, যুবকরাই হচ্ছে আমাদের জাতির মূলশক্তি। ৪ কোটি ৭৪ লাখ কিশোরকিশোরী জাতির মূলশক্তি। স্কুল, কলেজ, ক্লাব বা বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ও অবকাঠামোর মধ্য দিয়ে মানবিক বিকাশের মাধ্যমে তাদের মনোজগতকে যদি সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা যায় তবেই আমাদের যুব শক্তিই পৃথিবী আধুনিক উন্নত জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে। তাদের মধ্যেই নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদকশিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ: কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের মনীষীদের কীর্তি ও কৃতি তুলে ধরা হোক : তৈরি হোক ইতিহাস সচেতন প্রজন্ম