প্রকৌশল শিক্ষার মানোন্নয়ন ও আগামীর চতুর্থ শিল্পবিপ্লব

ত্রিয়মা রায় | মঙ্গলবার , ১৮ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

শিল্প’ শব্দটির সাথে ‘প্রকৌশল’ শব্দ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একে অপরের পরিপূরক। প্রকৌশল ব্যবস্থা ছাড়া যে কোনো ধরনের শিল্পের চৌকাঠ ডিঙানো সম্ভব নয়। প্রকৃতিগতভাবেই অসম্ভব। হাতছানি দিচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। অধিক জনসংখ্যার কর্মসংস্থান আর স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের রূপকল্প২০৪১ এর সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। কেবল বাংলাদেশ নয়বর্তমানে বিশ্বের বহুল আলোচিত বিষয়ের মধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব অন্যতম একটি বিষয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্পব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব শব্দটির উৎপত্তি ২০১১ সালে, জার্মান সরকারের একটি হাইটেক প্রকল্প থেকে। একে সর্বপ্রথম বৃহৎ পরিসরে তুলে নিয়ে আসেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ‘ক্লস শোয়াব’। ইন্টারনেটের আর্বিভাবে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের পর তথ্যপ্রযুক্তির বাধাহীন ব্যবহার ও দ্রুত তথ্য স্থানান্তরের মাধ্যমে গোটা বিশ্বের জীবন প্রবাহের গতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্টারনেট অব থিংকিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়ছে। এই ডিজিটাল বিপ্লবের ছোঁয়ায় উৎপাদন ব্যবস্থায় ঘটবে অকল্পনীয় পরিবর্তন। যেখানে উৎপাদনের জন্য মানুষের যন্ত্র চালাতে হবে না, বরং যন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর্মসম্পাদন করবে এবং এর কাজ হবে আরও নিখুঁত ও নির্ভুল। চিকিৎসা, যোগাযোগ, প্রকাশনা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও এর প্রভাব হবে অত্যন্ত জোরালো।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে আমাদের প্রধানতম লক্ষ্য হতে হবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উপযোগী সুদক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টি। এজন্য প্রয়োজন প্রকৌশল বা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার যথাযথ মান নিশ্চিত করা। গত ১৬ই জুন ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ তারিখের দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকৌশল শিক্ষা নিয়ে একটি রিপোর্ট আমাকে ব্যথিত করেছে। প্রকৌশলবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসাবে নিজেকে দুর্ভাগা ও বেওয়ারিশ মনে হচ্ছে। শিল্পভাবনার ভবিষ্যৎ চাহিদা বিবেচনা করে দেশে সরকারিবেসরকারিভাবে নিয়তপ্রতিনিয়ত, যত্রতত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার বেশভূষা লাগানো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। যেনতেনভাবে প্রতিষ্ঠিত বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল শিক্ষা উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। লোভনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা প্রবল আকর্ষণ নিয়ে প্রকৌশলবিদ্যায় ভর্তি হচ্ছে। বিপুল অংকের অর্থ খরচের এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের মানযাচাইয়ের বয়স তো আর আমাদের হয়নি। পত্রিকার রিপোর্ট বলছে প্রকৌশল শিক্ষা চলমান থাকা ১০২ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ২০ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কোর্স পরিচালনার স্বীকৃতি রয়েছে। সরকারিবেসরকারি মিলিয়ে প্রকৌশলবিদ্যা পরিচালনাকারী ১৪৩ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ২৯ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৬টি প্রকৌশল বিষয়ক কোর্সের অ্যাক্রেডিটেশন বা স্বীকৃতি রয়েছে। মানদণ্ডহীনবিবেকহীন আতঙ্ক ছড়ানো এই তথ্য পেয়ে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠেছে। যথাযথপ্রকৃত শিক্ষা বঞ্চিত প্রকৌশলবিদ্যার্থীদের জন্য আফসোস রইল। দেশকে উন্নত সমৃদ্ধ করার বহুকাঙ্ক্ষিত আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকার সারাদেশব্যাপী অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ আগ্রহের সাথে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। অথচ অপার গুরুত্বের প্রকৌশল শিক্ষাকে মুখস্ত বক্তৃতাবিবৃতির শিক্ষাতে নিক্ষিপ্ত করছেন। মুখরোচক মিথ্যার গড়নে তৈরি হচ্ছে আগামীর প্রকৌশলীরা।

আমরা জেনেছি স্বাধীনতার পর জাতির পিতা এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আজকে আমার গোলায় ধান নাই। আমার ক্ষেতে ফসল নাই, আমার রিজার্ভ মানি নাই। রাস্তাঘাট পুলব্রিজ সবকিছু ধ্বংসপ্রাপ্ত। কিন্তু আমার কাছে আছে জনশক্তি। এই জনশক্তি কাজে লাগিয়ে আমি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলবো’। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রকৌশল শিক্ষাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট গবেষক, শিক্ষাবিদ উদ্যোক্তা ও নীতিনির্ধারক নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছিল। বর্তমানে আমাদের দেশের ৪৯ শতাংশ মানুষের বয়স ২৪ বছরের নিচে। এইসমস্ত যুবতরুণদের কর্মসংস্থানভিত্তিক দক্ষতার শিক্ষা নিশ্চিত করলেইতো দেশের শিল্পায়ন এগিয়ে যাবে। যথাযথ প্রযুক্তি শিক্ষা ও প্রকৃত জ্ঞানার্জন ছাড়া তরুণযুবদের দক্ষতা প্রদর্শন সম্ভব হবে না। শিক্ষা বঞ্চিত রেখে তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা রীতিমতো কৌতূহলোদ্দীপক। প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা গবেষণার হাত ধরেই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ শিল্পসমৃদ্ধ হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ আকাঙ্ক্ষা ‘স্মার্ট নাগরিকের’ সাথে ‘স্মার্ট ইকোনোমি’ প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলার মতো প্রযুক্তিদক্ষ প্রকৌশলীদের কর্মতৎপরতায় ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাবে। প্রকৌশল শিক্ষাব্যবস্থার যাবতীয় অসঙ্গতি, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম প্রতিবন্ধকতা অতিদ্রুত দূর করে প্রকৃত অর্থই প্রকৌশলী সৃষ্টি করা হবে; এই ভাবনায় আচ্ছন্ন হচ্ছি।

লেখক: শিক্ষার্থী, পানিসম্পদ কৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়চুয়েট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিরে যাও আপন নীড়ে
পরবর্তী নিবন্ধওয়ার্ল্ড র‌্যাঙ্কিং এবং বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ: কিছু প্রাসঙ্গিক কথা