চট্টগ্রামে দুই বছর আগে তিনটি ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয় থেকে অবৈধভাবে ১৮টি জন্মনিবন্ধন দেওয়ার ঘটনায় তিনটি মামলার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করেছে পুলিশ। এসব ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ চারজনের সম্পৃক্ততা পেয়েছে, যাদের মধ্যে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের এক কর্মীও আছেন।
নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের উপ–কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, চট্টগ্রামের চকবাজার ও পতেঙ্গা থানার তিনটি মামলার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। কয়েক দিনের মধ্যেই আদালতে আলাদা আলাদা তিনটি অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে। তিনি জানান, তিনটি অভিযোগপত্রেই যাদের নাম থাকছে তারা হলেন দুই কম্পিউটার দোকানি আরিফুল ইসলাম সাগর ও নাজমুল হক আরিফ, জন্ম–মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের প্রোগ্রামার মো. খালিদ ও তার পূর্বপরিচিত খায়রুল ইসলাম। এদের মধ্যে পুলিশ আরিফুল ইসলাম সাগরকে যশোরের শর্শা উপজেলা এবং নাজমুল হক আরিফকে গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য দুইজনকে গ্রেপ্তার করতে না পারায় তাদেরকে পলাতক দেখিয়ে অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানান অতিরিক্ত উপ–কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন। খবর বিডিনিউজের।
সফটওয়্যার হালনাগাদের জন্য ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ পর্যন্ত জন্ম নিবন্ধন সার্ভার বন্ধ থাকায় ওই সময়ে কোনো জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়নি। কিন্তু সফটওয়্যার বন্ধ থাকার পরও ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর ১৬ নম্বর চকবাজার, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা এবং ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড থেকে মোট ১৮টি জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়। এসব সনদের মধ্যে সাতটি করে ১৬ নম্বর চকবাজার এবং ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড আর চারটি ৪১ নম্বর দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড থেকে দেওয়া হয়। চকবাজার ওয়ার্ড থেকে চারজন পুরুষ ও তিনজন নারীকে জন্ম সনদ দেওয়া হয়। অন্যদিকে উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ড থেকে তিনজন পুরুষ, চারজন নারী ও দক্ষিণ পতেঙ্গা ওয়ার্ড থেকে একজন পুরুষ ও তিনজন নারীর নামে এসব সনদ দেওয়া হয়। একই বছরের ১ মার্চ জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে নতুন করে পাসওয়ার্ড দেওয়ার পর সফটওয়্যারে প্রবেশের পর সংশ্লিষ্টরা সফটওয়্যারের কার্যক্রম বন্ধ থাকার পরও জন্ম নিবন্ধন সনদ দেওয়ার বিষয়টি ধরতে পারেন। ঘটনাটি নজরে আসার পর ৯ জুন চকবাজার থানায় একটি ও পতেঙ্গা থানায় দুটি মামলা করেন সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের জন্ম নিবন্ধন সহকারীরা। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২২, ২৪, ২৬, ৩৩ ও ৩৪ ধারায় মামলাগুলো করা হয়েছিল। যেগুলোর তদন্ত করে নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম শাখা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এসআই স্বপন কুমার সরকার বলেন, আদালতে জবানবন্দিতে আরিফুল ইসলাম সাগর জন্ম নিবন্ধন সনদ তৈরির সাথে আরও তিনজনের নাম উল্লেখ করেন। এদের মধ্যে নাজমুল হক আরিফকে গত জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হয়। আর খালিদ ও খাইরুলের পরিচয় শনাক্ত করা গেলেও গ্রেপ্তার করা যায়নি। পলাতক খালিদ জন্ম–মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের প্রোগ্রামার ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, এই দুজনকে পলাতক দেখিয়ে অভিযোগপত্র তৈরি করা হয়েছে।
তদন্ত কর্মকর্তা স্বপন সরকার জানান, অবৈধভাবে সার্ভারে প্রবেশ করে জন্মনিবন্ধন তৈরির অভিযোগে আরিফুল ইসলাম সাগরের মোবাইল ফোন, নাজমুল হক আরিফের মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, সিপিইউর ফরেনসিক টেস্ট করানো হয়েছে। পরীক্ষায় সেগুলো অবৈধভাবে জন্ম নিবন্ধন তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে বলে প্রমাণ মিলেছে। তিনি বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ২২, ২৪, ২৬, ৩৩ ও ৩৪ ধারায় মামলাগুলো করা হয়েছিল। যেহেতু পরষ্পরের যোগসাজশের অবৈধভাবে এ জন্ম নিবন্ধগুলো তৈরি করা হয়েছে তাই ৩৫ ধারাও যুক্ত করা হয়েছে অভিযোগপত্রে।
আরও তিনটি মামলার তদন্ত চলছে : এদিকে এ বছরের শুরুতে নগরীর ছয়টি ওয়ার্ডে অবৈধভাবে ৮০৬টি জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার ঘটনা ধরা পড়ে। যেগুলোর মধ্যে ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ৪১৯টি জন্ম নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে ২৪৯টি, ৩৮ নম্বর দক্ষিণ মধ্যম হালিশহর ওয়ার্ডে ৪০টি, ১৩ নম্বর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে ১০টি, ৪০ নম্বর উত্তর পতেঙ্গা ওয়ার্ডে ৮৪টি ও ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে চারটি করে অবৈধ জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার ঘটনা ঘটে। এসব অবৈধ জন্ম নিবন্ধন ইস্যুর ঘটনায় খুলশী থানায় দুইটি ও হালিশহর থানায় একটি মামলা করা হয় ১১, ১৩ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে। বাকী ঘটনাগুলোয় সংশ্লিষ্ট থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। এসব মামলারও তদন্ত করছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট।
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ–কমিশনার আসিফ মহিউদ্দিন বলেন, ২০২১ সালের জন্ম নিবন্ধনগুলো হয়েছিল পুরনো সফটওয়্যারে। আর এ বছরেরগুলো হয়েছে হালনাগাদ করা সফটওয়্যারের মাধ্যমে। তিনি জানান, এ বছর ছয় ওয়ার্ডে চার শতাধিক জন্ম নিবন্ধন দেওয়ার ঘটনায় মোট ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন নির্বাচন কমিশনের বহিষ্কৃত কর্মচারী জয়নাল আবেদীন। এছাড়া নড়াইল, ঢাকা, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় চারজনকে। পুলিশ কর্মকর্তা আসিফ মহিউদ্দিন জানান, গ্রেপ্তারদের কাছ থেকে জব্দ করা বিভিন্ন আলামত ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। সেগুলোর প্রতিবেদন আসার অপেক্ষায় আছেন তারা।