সমগ্র সৃষ্টি তথা প্রকৃতি আল্লাহর অসীম দান। প্রকৃতিজুড়ে স্রষ্টার অস্তিত্ব বিদ্যমান। রাসূল(দ.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর নূর হতে আর সমগ্র প্রকৃতি আমার নূর হতে সৃষ্টি’। আধ্যাত্মিক সাধকগণ প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে বিলীন করে প্রাকৃতিকতা ধারণসহ আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেন এবং প্রকৃতির মালিক আল্লাহর নৈকট্যতা লাভ করেন। এজন্য বলি– যেখানে প্রাকৃতিকতা সেখানেই আধ্যাত্মিকতা। প্রকৃতির নির্যাস ব্যতীত কখনো আধ্যাত্মিকতা লাভ করা যায় না। কারণ প্রকৃতি হলো স্রষ্টার প্রকাশ ও বিকাশ। প্রকৃতির বিশালতা উপলব্ধি করতে পারলেই স্রষ্টার অস্তিত্ব ও বিশালত্ব বুঝা যায়। এর জন্য প্রয়োজন প্রকৃতির প্রতি নিগূঢ় ভালোবাসা। প্রকৃতিপ্রেম ব্যতীত কখনো স্রষ্টাপ্রেম জাগ্রত হয় না। প্রকৃতির প্রতিটি কণায় কণায় স্রষ্টার অস্তিত্ব ও শক্তি নিহিত। প্রকৃতির প্রধান উপাদান হলো পঞ্চশক্তি (আকাশ, বায়ু, অগ্নি, পানি ও মাটি)। প্রকৃতির মাঝে স্রষ্টার অস্তিত্ব বিদ্যমান বলেই শক্তিরূপে এর বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই। এজন্য প্রকৃতির প্রতিটি কণা এক একটি শক্তি, এক একটি জ্ঞান, এক একটি সূর্য। আল্লামা শেখ সাদী(র.) বলেছেন, ‘প্রতিটি কণায় একটি সূর্য রয়েছে’। যার দিব্যজ্ঞান আছে সে–ই এই সূর্য দেখতে পায়। প্রকৃতিপ্রেম ও সাধনা ব্যতীত এই জ্ঞান আহরণ সম্ভব নয়। যে প্রকৃতিকে ভালোবাসে না সে স্রষ্টা থেকে অনেক দূরে (নিজেকে যতই মহান সাধক মনে করুক না কেন)। হযরত শেখ সাদী (র.) আরও বলেন, ‘যেদিন জ্ঞানচক্ষু ফুটবে সেদিন প্রকৃতির প্রতিটি কণায় স্রষ্টার দর্শন পাবে।’ এজন্য প্রয়োজন প্রকৃতির প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। পঞ্চশক্তির মধ্যে আকাশ– স্থান (যে অবকাশ দেয় এবং সবকিছু যে ধারণ করে), বায়ু– পৃথিবীর প্রাণ, অগ্নি– আলো, মাটি– অস্তিত্ব, পানি– জীবন। এই পঞ্চশক্তি তথা সমগ্র প্রকৃতির প্রাণ হলো বৃক্ষ। বৃক্ষ আকাশ, বায়ু, পানি ও মাটির মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। শুধু তাই নয়; এগুলোকে পরিশুদ্ধও করে। পবিত্র সনাতন ধর্মে বৃক্ষকে শিবের (মহাদেব) সাথে তুলনা করা হয়েছে। মহাদেব যেমন অকাতরে দিয়েই যায়, কোনো বিনিময় আশা করে না। তদ্রুপ বৃক্ষও সৃষ্টিসহ মানবকে দিয়েই যায়। মহাদেবের অনেক নামের একটি নাম স্তানু। তদ্রুপ বৃক্ষেরও একটি নাম স্তানু। সনাতন ধর্মের গুরুরা বলেছেন, ‘যদি মহাদেবের দর্শন পেতে চাও, বৃক্ষের যত্ন নাও’।
বৃক্ষ মানবের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান (অমৃত নামক) অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং মানবের বর্জ্য কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করে। পাশাপাশি বিষাক্ত ক্লোরোফ্লোরো কার্বন ও কার্বন মনোক্সাইড শোষণ করে বায়ুকে পরিশুদ্ধ এবং মাটির অবকাঠামোকে শক্ত রাখে। একদিকে বিষ শোষণ অন্যদিকে অমৃত সরবরাহ করছে। এরই নাম স্তানু। সূর্যের আলো সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্লোরোফিল উৎপন্ন করে। ক্লোরোফিল(সবুজ) হল শক্তির আধার। এটি উৎপন্ন হয় বৃক্ষের মধ্যে।
বৃক্ষ বায়ু থেকে কার্বন ডাই–অঙাইড, মাটি থেকে পানি নিয়ে খাদ্য উৎপন্ন করে এবং মানবজাতির জন্য খাদ্য সরবরাহসহ কল্যাণে নিজেকে নিবেদন করে। এক মিনিটের জন্য যদি অক্সিজেন সরবরাহ বন্ধ থাকে তাহলে কী অবস্থা হবে? একবার ভাবুন! মানবসহ পৃথিবীর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।
ইসলাম ধর্মে বৃক্ষের তাৎপর্য ও প্রয়োজনীয়তাকে অত্যন্ত গুরুত্বসহ মানবসন্তানের সাথে তুলনা করেছে। রাসুল (দ.)বলেছেন, ‘বৃক্ষ মানবের সমতুল্য’ (সহি বুখারী, নং ৭২)। কোরআন শরীফে যতবার বেহেশতের বর্ণনা এসেছে, ততবারই বৃক্ষের গুণাগুণ বর্ণনা করা হয়েছে। বৃক্ষ আল্লাহর এবাদতে মগ্ন থাকে। আল্লাহ বলেন, ‘বৃক্ষ প্রতিনিয়ত আমায় সিজদা করে’ (আর রহমান–৬)। শুধু তাই নয় বৃক্ষ থেকে শিক্ষা নিয়ে বৃক্ষের মত মানবকেও এবাদত করার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ আরও বলেন, ‘বৃক্ষ আমার এবাদতে মশগুল থাকে। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বৃক্ষের মত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’ (সূরা–নমল)। অর্থাৎ এবাদত কীভাবে করতে হয় তা বৃক্ষ থেকে শিক্ষা নিতে বলা হয়েছে। বৃক্ষের রয়েছে প্রেমানুভূতি। একদা রাসুল (দ.) জুমার নামাজের পূর্বে মিম্বর (ঊসতূনে হান্না–গাছের ঢাল) জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন। সাহাবিরা এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ‘এটি প্রতিনিয়ত আমার জন্য কান্না করে’। বৃক্ষের আছে অপরিসীম শক্তি। বদর যুদ্ধে অস্ত্র সংকট হলে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য রাসূল(দ.) গাছের ঢাল ভেঙে সকলকে দেন। আল্লাহ ও রাসূল(দ.)’র অপরিসীম কৃপায় এগুলো এক একটি মহাশক্তিতে পরিণত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয় হয়।
একটি দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূখণ্ডের শতকরা পঁচিশ ভাগ বনাঞ্চল থাকা আবশ্যক। কিন্তু সেই পরিমাণ নেই বলে তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গাছ তাপমাত্রা শোষণ করে। তাই আমাদের প্রয়োজন প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ করা। বৃক্ষরোপণ অতি পুণ্যের কাজ। বৃক্ষের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূলে পাক (দ.) আরও বলেন, ‘যে বৃক্ষরোপণ করল বৃক্ষের যত ফুল, ফলমূল, পাতা আছে সম পরিমান সওয়াব আমলনামায় জমা হবে’। আরও বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বৃক্ষরোপণ করে মৃত্যুবরণ করলে বৃক্ষ যতদিন বাঁচবে তার রুহে ততদিন সওয়াব বর্ষিত হবে’ (মুসলিম শরীফ–১৫৫২)। ব্যবসায়িক সফরকালে সাহাবিদের নিয়ে একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনারা যদি জানেন যে– কাল কেয়ামত সংঘটিত হবে কিংবা মৃত্যু হবে, তাহলে শেষ পুণ্যকাজ হিসেবে একটি বৃক্ষরোপণ করবেন’। বৃক্ষরোপনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা এই হাদীসের মাধ্যমে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়। তিনটি জিনিস সদকায়ে জারিয়া হিসেবে গণ্য– আদর্শবান সন্তান রেখে যাওয়া, রাস্তাঘাট তথা সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজ এবং বৃক্ষরোপণ’। বর্তমানে আমরা বৃক্ষরোপণ না করে বিপরীতে বৃক্ষ নিধন করছি। বৃক্ষনিধন মহাপাপ। তিনি আরও বলেন ‘কোনো ব্যক্তি বিনাকারণে বৃক্ষ কর্তন করলে আল্লাহ তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’। যুদ্ধ ময়দানে নারী শিশুসহ বৃক্ষের কোনো প্রকার ক্ষতি না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখার তাগিদ দিয়েছেন। আমরা রাসুলের উম্মত হয়ে জেনে–বুঝে, পরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ নিধন করছি। না জেনে, না বুঝে মানুষ ভুল করে, এর ক্ষমা আছে। কিন্তু পরিকল্পিত ভুল শয়তানে করে। এই ভুলের কোনো ক্ষমা নেই। বায়ুর মধ্যে অঙিজেনের পরিমাণ শতকরা পনেরো ভাগের নিচে নেমে আছে তাহলে মানুষসহ প্রকৃতির অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে। তাই বৃক্ষ নিধন বন্ধ করে সকলের উচিত বেশি করে বৃক্ষরোপণ করা।
মাতৃদুগ্ধের ঋণ যেমন শোধ করা সম্ভব নয় তেমনি প্রকৃতির ঋণ কখনো শোধ হবে না। যে প্রকৃতির অমৃত গ্রহণ করে ঋণ স্বীকার করে না; তার মত মহাপাপী আর কেউ নয়। এই পৃথিবীতে বসবাসে তার কোনো অধিকার নেই।
বর্তমান সরকার বৃক্ষরোপণে যথেষ্ট আন্তরিক হলেও মানুষ সচেতন নয়। মানুষকে সচেতন করার জন্য মসজিদের ইমামগণ জুমার নামাজের পূর্বে বৃক্ষরোপণের উপকারীতা ও বৃক্ষ নিধনের অপকারিতা সম্পর্কে কোরআন হাদিসের আলোকে বক্তব্য রাখলে সকলে তা গ্রহণ করবে। পুরোহিতগণসহ আরো ভূমিকা রাখতে পারেন গুরু, পীর–মাশায়েখরা। তারা যদি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা ভক্ত–শিষ্যদের বুঝাতে পারেন তারা তা গ্রহণ করবে। মুনি–ঋষি–আওলিয়াগন আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে প্রকৃতির সুরক্ষা করতে হয়, কিন্তু আমরা তা ধারণ করি না। কারণ আমরা তাদের চরণ ধরি, আচরণ ধরি না। এখন বৃক্ষ রোপনের সময়। আসুন সকলে একটি করে হলেও গাছ লাগাই, অপরকে সচেতন করি এবং বৃক্ষনিধন বন্ধে একসাথে কাজ করি। লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক।