চায়নিজ শেষ রাজবংশের তৈরি গ্রীষ্মকালীন এই বাগানবাড়ির তিন চতুর্থাংশ দখল করে রাখা এই কুনমিং লেইকের নানান জায়গায় সর্বমোট ত্রিশটি সেতু থাকলেও, এই সতের সুড়ঙ্গ সেতু হল এখানকার সকল সেতুর রাজা।
এখান থেকে ওটা বেশ দূরে হলেও, ওটার উপরে লোকজনের নড়াচড়া দেখে মনে হচ্ছে ওটা এখানকার ছবি তোলার জন্য নিশ্চয় চমৎকার জায়গা। আচ্ছা আছে কী ঐ সেতুটার ঐ পাশে? নাহ আরো আগে যদি আসা যেতো এখানটায়, তবে গিয়ে উঠা যেতো ঐ সেতুতে সবাইকে নিয়ে। তুলতাম ছবি আমরাও। কিন্তু এখন তো ঐ পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। আছে ওটা লেইকের বেশ দূরে। লেইকের পাড় ধরে ঐ আয়ুষ্মান পাহাড়ে যাবার জন্য যতোটা হাঁটতে হবে, চোখ আন্দাজে মনে হচ্ছে ওখান থেকে আরো এতটা পথই হাঁটতে হবে। ঐ পর্যন্ত যেতে যেতেই মনে হচ্ছে ঐ লংজিবিটি পাহাড়ের উপর চেপে বসবে রাতের অন্ধকার! তারপর সে অন্ধকার ঝুপ করে নেমে পড়বে লেইকের বুকজুড়ে! সেক্ষেত্রে এ মুহূর্তে লক্ষ হোক ওই আয়ুষ্মান পাহাড়ই।
আচ্ছা, একাকী হাঁটছি কেন? আশপাশ তো দেখছি এক্কেবারে জনশূন্য। লোকজন যা দেখেছি এখানে এসে, তার সংখ্যা তো কম নয়? কিন্তু আছে তো সবাই ঐ দিকটাতেই, মানে লংজিবিটি হিলের দিকটাতেই। জমাট বরফ হয়ে থাকা লেইকের মাঝখানে মজমা বসানো লোকজনও যে লেইকের বুকের উপর দিয়ে হেঁটে ফিরছে ওইদিকেই তাও তো দেখছি। মানে কী এর? এই বিশাল কুনমিং লেইক পাড় ধরে গড়ে ওঠা ঐ রাজপ্রাসাদ ও বাগান বাড়িতে ঢোকার মূল গেট কি তবে ওইদিকেই নাকি?
সাধারণ যুক্তি তো তাই বলে? এখনকার মূল আকর্ষণ তো ঐ লংজিবিটি হিলই। প্রায় ৬০ মিটার উঁচু ঐ লংজিবিটি হিলের উপরেই তো আছে প্রাচীন চায়নিজ ঐতিহ্য মেনে নির্মাণ করা নানান দালান। আগে ঐ সব দালানগুলোর কোনো কোনোটি রাজবাড়ির অন্দরমহল আর কোনো কোনোটি বাহিরমহল হিসাবে ব্যবহৃত হলেও, কালের বিবর্তনে এখন ঐ সবের বেশির ভাগই পরিণত হয়েছে যাদুঘরে। অতএব ওই অংশটাকেই ধরতে হয় এখানকার মূল আকর্ষণের জায়গা। সে যুক্তিতে সামার প্যালাসে ঢোকার জন্য ওইখানে শুধুমাত্র একটা গেটই থাকার কথা না, বরং ওইটাই সম্ভবত এ এলাকায় ঢোকার সদর দরোজা। যার মানে দাঁড়ায় এই যে, লি খাঁ আমাদের এনে ঢুকিয়েছে এখানে এই রাজবাড়ির পেছনের দরজা দিয়েই।
কথাটা মনে হতেই, বহুদিন পর মনের ভেতর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের রানী সুকণ্ঠি শেফালী ঘোষ তাঁর মদির কণ্ঠে গেয়ে উঠলেন, ‘বাইন দুয়ার দি নো আইসসো তুঁই নিশিরকালে, মা বাফেরে লাগাই দিব মাইনশে দেখিলে!’
এখন অবশ্যই ঘোর কোনো নিশির কাল নয়। আর ওইখানে মানে ওই আয়ুষ্মান পাহাড়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে না ঐ রাজবাড়ির কোনো কন্যা। অতএব ঐখানে এ সন্ধ্যায় গেলে, এখানকার কোনো শেফালী ঘোষ বা মালকা বানুর কোনো রকম লোকলজ্জার মুখোমুখি হওয়ারও আশঙ্কাও নেই, তারপরও কথা হচ্ছে লি খাঁ এই কামডা করলো ক্যান আমাদের সাথে? কেন সে এই গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের মূল অংশ না নিয়ে গিয়ে, নামিয়ে দিল পেছনের দিকে। শুধু তো নামিয়েই দেয়নি, সেই বাইন দুয়ার দিয়ে সে আমাদের ঢুকিয়েও দিল বিখ্যাত এই বাগানবাড়ির চত্বরে?
এই কথা মনে পড়তেই, মোটামুটি সর্বক্ষণই লি খাঁর সার্ভিসে তার উপর মন বেশ সন্তুষ্ট থাকলেও এখন কিছুটা খিঁচড়ে গেল তা। সাথে সাথে থেমে গেল পায়ের চলাও। থেমে ডান দিকে নজর দিতেই এই হাঁটা পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাল ইটে চায়নিজ স্থাপত্যে তৈরি করা লম্বাটে যাত্রীছাউনি মার্কা ঘরটি চোখে পড়ল। ওটার দিকে এগুতে এগুতে মনে হল, হতে পারে লি খাঁ, এই একদিনে প্রথমে মুতিয়ানু মহাপ্রাচির, তারপর বার্ডস নেস্ট মানে বেইজিং ন্যাশানাল স্টেডিয়াম, এবং সবশেষে আমাদের এইখানে আনার যে পণ করেছিল মনে মনে, তা পূরণ করতে গিয়ে এছাড়া কোনো উপায় ছিল না তার। বার্ডস নেস্ট থেকে শেষ বিকেলে রওয়ানা করে লেইকের ওপাড়ের এখানকার মূল ফটকে নিয়ে যেতে, নিশ্চয় তাকে ঘুরতে হতো অনেক। কিম্বা হতে পারে ঐদিকে যেতে হলে পড়তে হতো বেইজিং জ্যামের পাল্লায়, তাতে হয়তোবা দেখা যেত যে এখানে ঢোকার জন্য দর্শনার্থীদের জন্য যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া আছে, তা পার হয়ে যেতো। এ কারণেই নিশ্চয় লি খাঁ অগত্যা যাকে বলে কোণ কোণাইচ্চা পথ ধরে নিয়ে এসেছিল এই রাজবাড়ির বাইন দুয়ারে, মানে পেছনের দরজায়।
ব্যাপার যদি তাই হয় তবে আমাদের শোফার কাম গাইড লি খাঁ, কাজ ঠিকই করেছে। আগামীকাল তো আমাদের শপিং ডে। গত সাত আট দিন তো কোনো ধরনের কেনাকাটা করা হয়নি। অবশ্য এরকমই তো পরিকল্পনা ছিল যে এই ভ্রমণের শেষদিন হবে শুধুই শপিং ডে। কারণ শপিং করা ছাড়া তো বাঙালির ভ্রমণ পরিপূর্ণ হয় না। তার উপর যদি থাকে সাথে নারীসদস্য, তাহলে তো কথাই নেই। অতএব আগামীকাল তো আর আসতে পারতাম না এখানে। লি খাঁর ডিউটি তো আজই শেষ। তারপর দিন তো ফিরে যাবো আমার সোনার বাংলায়। সেদিক থেকে লি খাঁ পেছনের দরজা দিয়ে হলেও যে এখানে এনে ঢুকিয়ে দিয়েছে আমাদের একদম শেষ বেলায়, তা তো সে ভালই করেছে।
সে যাক, এখন কথা হচ্ছে আরো কি যাবো নাকি সামনের দিকে ওই আয়ুষ্মান পাহাড়ের পাদদেশের দিকে? আচ্ছা এসেছি কতোটা পথ ঐদিক থেকে এই পর্যন্ত, সেটার একটু আন্দাজ করে নেই। সন্ধ্যার আঁধার অতি ধীরে হলেও ভালোই তো চেপে বসেছে দেখছি লেইকের বুকে। এদিকটায় এই বাঙাল ভিন্ন আর কোনো লোকজনও তো নেই। আচ্ছা এরকম একটা নির্জন নিরালায় পড়ি যদি এখন কোনো ছিনতাইকারীর পাল্লায়, হবে টা কী তাহলে?
একথা মনে হতেই ঝটপট উঠে পড়লাম একটু আগে এসে যাত্রী ছাউনিমার্কা এই লাল দালানটার ভেতরের দিকের যে কার্নিশে বসেছিলাম তা থেকে। দ্রুত পিছু ফিরে দেখি অনেকটাই হেঁটে এসেছি দারা পুত্র পরিবার পিছু ফেলে। সামনের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, আরো অনেকটা পথই হাঁটতে হবে লংজিবিটি হিলের পাদদেশে যেতে হলে। এরই মধ্যে মনে ছিনতাইকারীর আশঙ্কা ঢোকায়, কেমন যেন ভয় ভয় করছে একটু। নাহ, আর এগুনো যাবে না সামনে, বরং ফিরেই যাওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ। দ্রুত দিলাম উল্টা হাঁটা। হাঁটছি আর ভাবছি, আচ্ছা এ কি তবে ঢাকা সিনড্রোম নাকি? না হয় চায়নার বেইজিং শহরের একপ্রান্তে অবস্থিত সামার প্যালসের নির্জনতায়, ছিনতাইকারীর পাল্লায় পড়ার আশঙ্কা জাগল কেন মনে?
আরে দূর, এটা ঢাকা সিন্ড্রোম হবে কেন? চায়না, বেইজিং কি ধোয়া তুলসি পাতা নাকি? মনে নেই, সেই যে তিয়েন আন মেন স্কয়ারের তিন চক্করে পড়ে পথ হারিয়ে যখন হোটেলের কন্সিয়ার্জ মিস ইনাকে ফোন করেছিলে, সে কিন্তু তুমুল উদ্বিগ্ন স্বরে প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিল, কোনো টাউট বাটপারের পাল্লায় পড়েছ কী না! কী মনে হয় এতে? বেইজিং কি শুধুই সাধুসন্তদের জায়গা নাকি? যে পরিমাণ জাল টাকার ছড়াছড়ি এইখানে, তাতেও তো প্রমাণিত হয় এখানেও আছে ঢের চোর ছেঁচড় টাউট বাটপার। আবার এই চায়নিজরা সারা দুনিয়ার বাজার দখল করার জন্য প্রতিনিয়ত টনে টনে যেরকম নকল মাল সাপ্লাই দিয়ে যাচ্ছে এই গ্রহজুড়ে, তাতেও তো তাদের চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র মনে করার কোনো কারণ নেই !
নাহ, পরিষ্কার বোঝা গেল যে এমনিতে সচেতন আমি যতোই জোর গলায় বলি না কেন, ‘সকল দেশের সেরা সে যে আমার জন্মভুমি’, তারপরও সচেতন আমার চোখে এবং চেতনায় নিজ দেশের দোষত্রুটি ধরা পড়ে। সে জায়গায় মনের ভেতরের অবচেতন দ্বিতীয়জন এ ব্যাপারে এক্কেবারে একচোখা একরোখা। সে হলো আপাদমস্তক কড়া ‘ইনহাস্ত ওয়াতানাম’ মার্কা সৈয়দ মুজতবা আলির আব্দুর রহমান একটা।
হাঁটছি বেশ দ্রুতই ফিরতি হাঁটা। কিন্তু মন পড়ে আছে পেছনের দিকে। ভেবেছিলাম আর কিছু না হোক, এতো বিশাল সামারপ্যালেস এলাকার অন্তত দুটো না তিনটা জিনিষ দেখে যাবোই। যার একটা হলো, প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার লম্বা একটা করিডোর। চায়নিজ শিল্প সুষমায় চমৎকার কারুকাজমণ্ডিত সেই করিডোরের নাম হল লং গ্যালারী। দ্বিতীয়টি হল, এই লেইকে একটা জাহাজ আছে, সেটি দেখবো।
যদিও ওই জাহাজটি এই লেইকেই আছে, তারপরও ওটা কিন্তু ভাসমান কোনো জাহাজ না। ওটি হল লেইকের পানিতে পশ্চিমা জাহাজের ডিজাইনে তৈরি করা একটা প্যাভিলিয়ন ; তৈরি করা হয়েছিল যা নিরেট পাথর আর কাঠ দিয়ে। আচ্ছা মার্বেল বোট নামের সেই জাহাজ বা নৌকার আরেকটা নাম যেন কী?
না মনে পড়ছে না। আচ্ছা কাঁধে ঝোলানো পাশব্যাগেই তো আছে হোটেলে থেকে দেওয়া গাইড বই তো না বলা চলে সেই প্যাম্পলেটা। হাঁটতে হাঁটতে, সেটি বের করে আধো অন্ধকারে, চোখের বেশ কাছে সেটি ধরে দেখলাম, সেই জাহাজের নাম হল ‘বোট অব পিউরিটি এন্ড ইজ ’!
লেখক : প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক












