হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)’র জন্ম: হযরত উমর (রা.) আসহাবে ফীল তথা হস্তীর ঘটনার ১৩ বছর পর মক্কা মুকাররমায় জন্ম গ্রহণ করেন। এক বর্ণনামতে তিনি উনচল্লিশজন পুরুষের পর চল্লিশতম ইসলাম গ্রহণকারী মুসলমান। তাঁর পূর্বে এগার জন অন্য বর্ণনামতে তেইশজন মহিলা ইসলাম গ্রহণ করেন। নবীজির নবুওয়ত ঘোষণার ষষ্ঠ বৎসরে ২৬ বা ২৭ বছর বয়সে তিনি ইসলামের সুধা পান করেন। (তারিখুল খুলাফা, পৃ: ৮৬)
নাম ও বংশ পরিচয়: নাম: উমর, ডাকনাম: আবু হাফস, উপাধি ফারুক, পিতার নাম: খাত্তাব, মাতার নাম: আনতামা যিনি ছিলেন হিশাম বিন মুগীরার বোন, তাঁর বংশ পরিচয়ের ধারা উধ্বতন অষ্টম পুরুষে রাসূলুল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশের সাথে মিলে যায়। (তারিখুল খুলাফা, পৃ: ৮৬, তাবকাত ইবনে যাদ, খন্ড:৩, পৃ: ৫৯)
আল কুরআনের আলোকে তিনি অগ্রবর্তি মুহাজির সাহাবী: নবীজির সাহচর্য অবলম্বন, নবীজির কথা কাজ অনুমোদন ও সমর্থনের যথার্থ মূল্যায়নে অগ্রগামী সাহাবী। যাঁর জীবনাদর্শ ছিল নবীজির জীবন দর্শনের বাস্তব নমুনা। কাফিরদের কুফরি, মুনাফিকদের কপটতা, প্রতিরোধে যিনি ছিলেন আপোষহীন, যাদের মর্যাদা বর্ণনায় আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “হে অদৃশ্যের সংবাদদাতা নবী, আপনার জন্য যথেষ্ট আল্লাহ এবং সেসব মু’মিনরা আপনার অনুসরণ করেছে।” (সূরা: আনফাল, আয়াত: ৬৪)
নবীজির দুআ: হযরত সাঈদ ইবনে মুসায়্যির রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন উমর ইবনুল খাত্তাব অথবা আবু জেহেল কে দেখতেন তখন দুআ করতেন। হে আল্লাহ! এ দুজনের মধ্যে যে তোমার নিকট প্রিয় তাকে দিয়ে তোমার দ্বীনকে শক্তিশালী কর।
(তাবকাত ইবনে সাদ, খন্ড: ৩, পৃ: ৫৮)
তিরমিযী শরীফের বর্ণন্যায় এসেছে, এ দুজনের মধ্যে হযরত উমর আল্লাহ তা’আলার প্রিয় ছিল। (তিরমিযী, খন্ড: ২, পৃ: ২০৯), এক রেওয়ায়েতে এসেছে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.)’র জন্য এ দুআ করেছিলেন। হে আল্লাহ, তুমি বিশেষ ভাবে ওমর ইবনুল খাত্তাবকে মুসলমান করে ইসলামকে বিজয় ও শক্তি দান কর।” (ইবনে মাযাহ, পৃ:১১, আল মুসতাদরেক ইমাম হাকেম, খন্ড: ৩, পৃ: ৮৬)
হযরত উমর (রা.)’র ইসলাম গ্রহণে আসমান বাসীরা আনন্দ প্রকাশ করেছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যখন হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছে, তখন হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম নবীজির খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! হযরত উমরের ইসলাম গ্রহণের কারণে আসমানবাসীরা আনন্দ ও খুশী উদযাপন করেছে। (ইবনে মাযাহ, পৃ: ১১, আল মুস্তাদরেক হাকেম, খন্ড: ৩, পৃ: ৮৩, তারিখুল খুলাফা, পৃৃ: ১৮৯)
ইসলামের ইতিহাসের এক নব দিগন্তের সূচনা:হযরত উমর (রা.) ইসলাম গ্রহণের কারণে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হয়। তাঁর পূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী কারো পক্ষে মুসলমান হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করা ছিলো অসম্ভব ও দুরুহ। সেই কঠিন ক্রান্তিকালে অকুতোভয় বীর সাহাবী হযরত উমর এর প্রচন্ড সাহসিকতা প্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত উমর (রা.) ঈমান আনেনি আমরা মুসলমানগণ প্রকাশ্য কাবা শরীফে গিয়ে নামায আদায় করতে পারিনি। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, তারিখুল খুলাফা, পৃ: ১৯০)
হযরত সুহাইব বিন সিনান (রা.) বর্ণনা করেন, যখনই হযরত ওমর (রা.) ইসলাম গ্রহণ করলেন, ইসলামের বিজয় ধারা সূচিত হলো, প্রকাশ্যে ইসলামের প্রচার শুরু হলো দলে দলে আমরা কা’বা ঘরের চতুর্দিকে সমবেত হতাম কা’বার তাওয়াফ করতাম, কেউ আমাদের উপর সীমা অতিক্রম করলে আমরা মোকাবিলার সক্ষমতা অর্জন করলাম। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, তাবকাত ইবনে সাদ, খন্ড: ৩, পৃ: ৫৯. আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড: ৩, পৃ: ৪০২)
হযরত উমরের হিজরত: হযরত উমর (রা.) নবুওয়তের ১৩তম বর্ষে ২০ জনের এক বিশাল কাফেলাসহ প্রকাশ্যে মদীনা মনোওয়ারা হিজরত করেন। হযরত মওলা আলী শেরে খোদা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এ প্রসঙ্গে বর্ণনা করেন, হযরত উমর (রা.) ছাড়া অন্য কাউকে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে হিজরত করতে আমি দেখিনি প্রত্যেকে মক্কার কাফিরদের ভয়ে গোপনে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছেন একমাত্র ফারুকে আযম ওমর (রা.) প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বায়তুল্লাহ শরীফের তাওয়াফ করলেন, মকামে ইবরাহীমে নামায পড়লেন। সেই সময় কা’বার চত্বরে সমবেত মক্কার সর্দারদের সামনে প্রকাশ্যে দ্বীপ্ত কন্ঠে কাফিরদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে মদীনা মনোওয়ারা হিজরতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন, প্রকাশ্যে কাফিরদের কে হুমকী দিয়ে ঘোষণা দিলেন যে তার আপন মাতাকে সন্তান হারা করতে চায়, নিজ স্ত্রীকে বিধবা করতে চায়, নিজ সন্তানকে এতিম বানাতে চায়, সে যেন তার মুকাবিলায় মুখোমুখি হয় আল্লাহু আকবর! কাফিরদের কেউ বিন্দুমাত্র সাহস করেনি সকলে ভীত সন্ত্রস্ত। ইসলামের প্রচার প্রসার ও বিজয়ে হযরত উমর (রা.)’র অবিস্মরনীয় অবদান ছিলো বিস্ময়কর। (তারিখুল খুলাফা, পৃ: ১৮৮)
হযরত উমর ফারুক (রা.)’র সমর্থনে কুরআনের আয়াত অবতরণ: হযরত ইবনে মবদুবিয়া মুজাহিদ থেকে বর্ণনা করেন, আমিরুল মু’মিনিন যখন কোনো বিষয়ে রায় বা মত প্রকাশ করতেন আল্লাহ তা’আলা তাঁর মতের সমর্থনে কুরআন মজীদে আয়াত নাযিল করেছেন, এ বিষয়ে বিশের অধিক আয়াত প্রমাণ হিসেবে বিদ্যমান আছে।
মকামে ইবরাহীমে নামায আদায়ের আয়াত অবতরণ ছিল তাঁর মতের সমর্থনে: হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বর্ণনা করেন, একদা আমি মুস্তফা জানে রহমত সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে কা’বা শরীফ তাওয়াফরত ছিলাম, আমার অন্তরে মকামে ইবরাহীম সন্নিকটে দু’রাকাত নামায করার আগ্রহ সৃষ্টি হলো, আমি আমার অভিপ্রায় নবীজির সামনে ব্যক্ত করলাম, তখনি আল্লাহ তা’আলা এর অনুকুলে আয়াত নাযিল করে জানিয়ে দেন, তোমরা ইবরাহীমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাযের স্থান বানাও। (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১২৫, বুখারী শরীফ, খন্ড: ১ম, পৃ: ৫৭)
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, হযরত ফারুকে আযম উমর (রা.) তিনি তো একবার মকামে ইবরাহীমে নামায আদায়ের ইচ্ছা পোষন করেছিলেন, কিন্তু আল্লাহ তা’আলার দরবারে প্রিয় রসূলের এই মহান সাহাবীর আমল এমনভাবে প্রিয় ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছে, কিয়ামত পর্যন্ত কা’বা শরীফের হজ্বকারী ও তাওয়াফকারীদের প্রত্যেক তাওয়াফের পর দু’রাকাত নামায আদায় করা ওয়াজিব সাব্যস্ত করে দিয়েছেন। প্রতিয়মান হলো, মকামে ইবরাহীম হযরত ইবরাহীম খলিলুল্লাহর কদম মোবারকের বরকতময় চিহ্নের পবিত্র স্মারক। মকামে ইবরাহীমের নিকটে দু’রাকাত নামায আদায় করা হলো হযরত ফারুকে আযম (রা.)’র সুন্নাত ও স্মারক। (আনোয়ারুল বয়ান, খন্ড:৩, পৃ: ৪০৩)।
জান্নাতের সু–সংবাদ প্রাপ্ত সাহাবী: আশরায়ে মুবাশশরা জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ১০ জন প্রসিদ্ধ সাহাবাগনের দ্বিতীয় জন হযরত উমর (রা.)। সাহাবাগনের মধ্যে তিনিই প্রথমে আমিরুল মু’মিনীন উপাধি অভিধায় ভূষিত।
হযরত উমর (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের সংখ্যা: হযরত উমর (রা.) কর্তৃক ৫৩৯ টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে, খোলাফায়ে রাশেদীনের ৩য় ও ৪র্থ খলিফা হযরত উসমান জিন্নুরাইন (রা.), ও হযরত মাওলা আলী শেরে খোদা (রা.) এবং উল্লেখ যোগ্য সাহাবায়ে কেরাম হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর, হযরত আবু হুরায়রা, হযরত আবু মুসা আশয়ারী, হযরত বারা ইবনে আযেব, হযরত আবু সাঈদ খুদরী, হযরত সাদ প্রমূখ সাহাবায়ে কেরাম তাঁর থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। (তারিখুল খুলাফা, পৃ: ১১০)
হযরত ওমর (রা.)’র দুআ: হযরত উমর (রা.) আল্লাহ তা’আলার দরবারে প্রায়শ এ প্রার্থনা করতেন, হে আল্লাহ আপনার পথে আমার শাহাদাত নসীব করুন এবং আপনার রাসূলের শহরে আমাকে মৃত্যু দান করুন। (বোখারী শরীফ, খন্ড: ১ম, পৃ: ২৫৩)
খিলাফত ও ইন্তিকাল: সাম্য ন্যায় নীতি ও আদর্শের মৃর্ত প্রতীক, মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলিফা, আমিরুল মু’মিনীন হযরত উমর (রা.) ২৩ জমাদিউস সানি ১৩ হিজরি মোতাবেক ২৪ আগষ্ট ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দ খিলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ২৩ হিজরির ২৬ জিলহজ্ব বুধবার তিনি আহত হন। চার দিন পর যেদিন মহররম মাসে চাঁদ উদিত হয় সেদিন প্রত্যুষে শনিবার তিনি মাওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে গমন করেন। তিনি ১০ বছর ৬ মাস ৫ দিন খিলাফতের দায়িত্ব পালন করেন। ইন্তিকালের সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। হযরত সুহাইব (রা.) তাঁর জানাযা নামায পড়ান। হযরত উসমান জিন্নুরাইন, হযরত মাওলা আলী, হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ, হযরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সাহাবাগন তাঁর কবর শরীফে অবতরণ করেন। ১ মহররম রাওজায়ে আকদাসে নবীজির নুরানী পরশে এবং খলিফাতুল মুসলেমীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)’র পাশ্বে ও কীর্তিমান মহান খলিফা চিরনিদ্রায় শায়িত হন। মহান আল্লাহ আমাদের কে তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ রেজাউল করিম আজাদ
রাউজান, সুলতানপুর, চট্টগ্রাম
প্রশ্ন: রাসূলুল্লাহ সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতবার হজ্ব আদায় করেছেন?
জানালে কৃতার্থ হব।
উত্তর: অধিকাংশ তাফসীরকারদের মতে ৯ম হিজরিতে হজ্ব ফরজ হয়। ৯ম হিজরিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কে আমিরুল হুজ্জাজ নিযুক্ত করে হজ্বে প্রেরণ করেন। ১০ম হিজরিতে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার ফরজ হজ্ব আদায় করেছেন। এটা ছিল হজ্ব ফরজ হওয়ার পর নবীজির প্রথম হজ্ব। এরপর নবীজির হজ্ব করার সুযোগ হয়নি।
তাফসীর হাদীস ও ইতিহাসের পরিভাষায় এটি “হাজ্জাতুল বিদা” বিদায়ী হজ্ব হিসেবে প্রসিদ্ধ। এ হজ্বে এক লক্ষ চৌদ্দ হাজারের অধিক সংখ্যক সাহাবায়ে কেরাম নবীজির সফর সঙ্গী ছিলেন। এমনকি নয়জন উম্মুহাতুল মুমিনীন ও হযরত ফাতেমাতুয যাহরা (রা.) সহ এ হজ্বে নবীজির সাথে ছিলেন। তবে হিজরতের পূর্বে নবীজি কয়েকবার হজ্ব করার বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)’র বর্ণনা মতে হিজরতের পূর্বে দু’বার হজ্ব পালন করেন। এক বর্ণনায় তিনবার ওমরা হজ্ব আদায় করার বর্ণনা পাওয়া যায়। (শারহে মাওয়াহিব, ৭ম খন্ড, ৭ম পৃ: ১৩, শরহে মাওয়াহিব, খন্ড:৩, পৃ: ১০৫, সীরাতুল মুস্তফা, খন্ড: ৩, পৃ: ১৪১)