হিমুর আর আম বাদুড়

অনিন্দ্য আনিস | বুধবার , ১২ জুলাই, ২০২৩ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার।বাতাসের অস্তিত্বও নেই।গাছের দিকে তাকালে তাসচ্ছ জলের মত চোখে ভেসে ওঠে। দূর আকাশের একমাত্র উজ্জ্বল বস্তু চাঁদ। কুসুমদের বাড়ির পশ্চিম দিকের তাল গাছের মতো এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে।মনের ভাব প্রকাশ করার মতো কাউকে নিজের নাগালে পাচ্ছে না। মুখ কালো করে রেখেছে। বাবা ঘুমঘুম চোখেপা টিপে টিপে হিমুর দরজার সামনে হাজির হয়। হুট করে ভূত দেখার মতো হিমু আঁতকে ওঠে। ভূত কোত্থেকে আসবে? আমাকে কী দেখে ভূতের মতো মনে হয় তোমার? হিমুকে বাবা বিরক্ত সুরে জানায়।না মানে আব্বু!না মানে কী? বইয়ের প্রতি মনোযোগ আছে, না মোবাইল নিয়ে বসে পড়েছো? দুদিন পরে ক্লাসএক্সাম তা কী মনে আছে? না বারবার মনে করাতে হবেএই বলতে বলতে হিমুর পাশে বাবা বসল। হিমু ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে কাঁপতে থাকে।বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,’ বোকা ছেলে বাবাকে কেউ ভয় পায়? বাবা তো হচ্ছে সবচেয়ে কাছের মানুষ। বাবারা ভালোবাসায় কোমল আর শাসনে ভীষণ কড়া। আমার বাবা অর্থাৎ তোমার দাদুভাইকে আমি ভীষণ ভয় পেতাম। আব্বুকে যতটা বাইরে থেকে কঠিন মানুষ মনে হতো, প্রকৃত পক্ষে সে এর চেয়ে দিগুণ কোমল মনের মানুষ ছিলেন।

আমি তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তোমাকে শাসন করি। তুমি পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে পারলে এখানেই আমার সার্থকতা। বাবা আবারও মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেলেন। হিমু হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মনে হয় একটু জন্য প্রাণে বেঁচে গেলো। ধীরে ধীরে চার্জের লাইটের আলো ফুরিয়ে গেল। পয়ত্রিশ সেকেন্ড পরে নিজ থেকে বন্ধ হয়ে যায়। হিমু অন্ধকারে থাকতে পছন্দ করে না।তাই হাত বাড়িয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে খোলে দিলো। চাঁদের আলো হালকা রুমে ছড়িয়ে পড়ল নিজের হাতের পাঁচটা আঙুল ঠিক করে দেখা যাচ্ছিল না।আজ এতো অন্ধকার কেন? অসহ্য গরমে আর কতক্ষণ আবদ্ধ করে ঘরে থাকা যায়। হিমুদের বাড়ি ছাড়িয়ে দিহানদের বাড়ি।ওদের আবার বেশ কয়েকটা আম গাছ আছে।আমের ভারে ডাল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। মিনিটে তিনচারেক বার ধপাস ধপাস আওয়াজ কর্ণপাত হয়।

হিমুর আম খেতে মন আনচান আনচান করছে। গতকাল আব্বু গোপালভোগ আম পাঁচ কেজি গল্লামারী বাজার থেকে নিয়ে এসেছে। কিতু তাতো আব্বুর রুমে কাঠের নিচের বাঁশ ঝুড়িতে। এখন আব্বুর রুমে যাওয়া যাবে না। আমার তো আম খেতে হবে। দুচোখ আকাশের দিক করে ভাবছে কী করা যায়। মন স্থির করল দিহানদের গাছের আম খাবে। কোনো উপায় না পেয়ে দিহানদের আম বাগানে গেলো। একী কান্ড। এত্ত আম গাছের নিচে। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবে। এই করতে করতে আমের গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এএএএমা। আমের বাকি অর্ধেক কে খেয়েছে। হাত মুছতে মুছতে অন্য একটা আম হাতে তুলে। ওমা এই আমেরও বাকি অর্ধেক নেই কেন? কোথায় গেলো? এভাবে এদিকসেদিক করে দেখে প্রায় সব আম অর্ধেক নেই। হিমু মন খারাপ করে বসে পড়ল।

ধুত্তেরি, শুধু শুধু আসলাম। আম খাওয়ার প্রবনতা বারবার মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়। হিমু আবারও উঠে দাঁড়ায়। লক্ষ্য করল আম গাছের ডালপালা খব করে নাড়াচাড়া করছে। কী ব্যাপার! ভূমিকম্প হলো নাকি? কী করে সম্ভব? গাছ ব্যতীত সবকিছু তো স্থির আছে। তাহলে গাছ কেন নড়বে? হিমু গাছের দিকে গাঘেঁষে দাঁড়িয়ে উপরে উঁকি মারে। ওহ! এই সব তোমরা করছো? তোমরা কে ভায়া? আমবাদুড়ের একজন জবাব দেয়।এই রাতবিরাতে অন্যের গাছের আম এভাবে কেউ অর্ধেক খায়? তোমাদের জন্য আমি একটা আমও খেতে পারিনি। মন খারাপ করে বাদুড়ের দিকে করুণ দৃষ্টিতে চোখের পাতা ফেলছে।

বাদুড়ের একটুও মায়া হয় না। বাদুড় নিজের মতো করে আম খেয়ে গাছের তলে ফেলছে। আম বাদুড়ের একজন এসে বলল, এই যে ছোট্ট খোকা দাঁড়াও। হিমু এদিকসেদিক তাকিয়ে কাঠের পুতুলের মতো ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বেশ নাদুসনুদুস একটা আমবাদুড়। চোখ দুটো মারবেলের মতো গোল। কলাপাতার মতো পাতলা ডানা। নতুন আম খাওয়া শিখছে একটা খেতে না খেতেই হাঁপিয়ে ওঠছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে, ‘আম খাবে? কয়েকটা আম হিমুর দিকে ছুঁড়ে দিল। হিমু ক্রিকেট খেলায় তুখোড় তাআম লুফে নেওয়ার দক্ষতা দেখলেই মনে হবে।

আমবাদুড় হিমুর খুব কাছে এসে বসল। হিমু আম পেয়ে নিজকে আর সামলাতে পারল না।আমের খোসা ছাড়িয়ে দুচোখ বন্ধ করে খেতে শুরু করল।হঠাৎ আমবাদুড়ের কথা হিমুর মনে পড়ল। আমবাদুড়ের দিকে একটা ছুড়ে দিয়ে বলে নাও তুমিও খাও। একী তুমি এতো কাছ থেকে আমটা ধরতে পারলে না?আম বাদুড় প্রতিউত্তরে বলে,’ কী করে ধরব বলতে পারো? আমি তো রাতের বেলা চোখে দেখতে পাই না! তাহলে তুমি গাছে বসে আম খাচ্ছো কি করে? আমরা শব্দের তরঙ্গে বুঝতে পারি আমাদের আশেপাশে কোনো বস্তু আছে কিনা। আমি কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না। তবে তরঙ্গের ধ্বনিতে বুঝতে পেরেছি তুমি আমার খুব কাছাকাছি আছো।

হিম হাঁ করে আম বাদুড়ের কথা শুনছে। অবাকও হয়েছে বটে। তোমরা তো খুব বিচক্ষণ প্রাণী। চোখে দেখতে না পেয়েও খুব করে রাত্রে চলাফেরা করতে পারো। আবার খেতেও পারো। আম বাদুড় বলল,’তুমি বলছিলে না আমরা অর্ধেক খেয়ে ফেলে দেই? ব্যাপারটা তা নয় আমরা দেখতে পাইনা বিধায় এদিক খাওয়ার পরে ওদিকে নখ দিয়ে ধরতে গেলে আমের বোটা ভেঙে নিচে পড়ে যায়। হিমু বিষয়টা আগে চিন্তা করেনি তাই মিছামিছি ওদের দোষ দিয়েছে। এতক্ষণে আম বাদুড়ের সাথে হিমুর ভীষণ ভাব হয়ে যায়। আম খাওয়ার ধান্ধায় পড়ে ঘড়ির দিকে হিমুর খেয়াল নেই। হঠাৎ করে সময়ের প্রতি দৃষ্টি দিলো। এএএএমা রাত তিনটা বাজে! আমাকে এখুনি যেতে হবে নয়তো আমার আব্বু এসে খুব বকুনি দিবে।আম বাদুড় হিমুকে আরও কয়েক আম গাছ থেকে দিলো।হিমু আম পেয়ে খুশিতে আত্মহারা। আম বাদুড় বাবামায়ের উদ্দেশ্যে ওড়ে গেলো। হিমু আম নিয়ে নিজের ঘরে আসল। পানি খেতে খেতে হালকা করে জানলা বন্ধ করে দিল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির গৌরব অতীশ দীপঙ্কর
পরবর্তী নিবন্ধনূরুল ইসলাম চৌধুরী