মৃত্তিকা হলো পরিবেশ ও জীবনের মূল ভিত্তি। আমাদের দেশের উন্নয়ন এই মৃত্তিকা বা মাটির উপরেই নির্ভরশীল। মাটি ফসল, বৃক্ষরাজি ও অনুজীবসমূহকে পুষ্টি সরবরাহ করে, পানিকে ফিল্টার করে পানের যোগ্য করে দেয়, বন্যা থেকে রক্ষা করে এবং খরার বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিলিয়ন জীবের বাসস্থান হিসাবে কাজ করে। মাটি অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করে এবং কার্বন সিঙ্ক হিসাবে কাজ করে জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করে। তাছাড়া, উপরের স্তরে (০–৯ ইঞ্চি) বসবাসরত অনুজীবগুলো পচনশীল শাক–সবজিকে ৫ থেকে ৩০ দিনে; মৃত পশু বা প্রাণীর দেহকে ১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করে এবং পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে অপচনশীল দ্রব্য; যেমন; দৈনন্দিন ব্যবহারের প্লাস্টিক ব্যাগ ১০ থেকে ২০ বছর, প্লাস্টিক বোতল ৪০০ বছর এবং গ্লাস ৪ হাজার বছর পর্যন্ত মাটিতে অবস্থান করে মাটির গুণাগুণ নষ্ট করে দেয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশে বর্তমানে ইটভাটা, শিল্পায়ন, নগর উন্নয়নের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে শতভাগ আবাদযোগ্য কৃষি জমি। যদিও বাংলাদেশে ২০১৩ সনের ৫৯ নং আইনের আওতায় ইটের সংজ্ঞায় বলা আছে ‘ইট’ অর্থ বালি, মাটি বা অন্য কোনো উপকরণ দ্বারা ইটভাটায় পোড়াইয়া প্রস্তুতকৃত কোনো নির্মাণ সামগ্রী। উল্লেখ্য যে, একমাত্র মাটি ছাড়া বালি বা অন্য কোন উপকরণ দিয়েতো ইট তৈরি সম্ভব নয়। উল্লেখযোগ্য যে, মানুষ বালিকে উত্তপ্ত করে চাল থেকে মুড়ি তৈরি করে, ইট তৈরি করে না। তাছাড়া অনুমতি সাপেক্ষে মজা পুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দিঘি বা নদ–নদী বা হাওর–বাওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গার মাটি দিয়েও ইট তৈরিতে আগ্রহ দেখায় না কারণ এই সমস্ত মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বেশি থাকে। তাই দেশের সকল (বৈধ/অবৈধ) ইটভাটায় উপকরণ হিসেবে আবাদযোগ্য কৃষি জমির মাটিই ব্যবহৃত হচ্ছে।
বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, দেশে বর্তমানে ৭,২০০ ইটভাটাতে বছরে প্রায় ৩৫০০ কোটি ইট পোড়ানো হয়, এতে প্রতি বছর টপ সয়েল ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি টন যা ৬৫ হাজার হেক্টর কৃষি জমির উপরের স্তরের মাটির সমান। তাছাড়া রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, পুকুর খনন নির্মাণসহ নানা কাজে আরো ১৫ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমিও অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। উক্ত হিসাবে বছরে মোট উর্বর জমি হারানোর পরিমাণ প্রায় ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১% হারে আবাদযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে অপরদিকে একই হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। উক্ত হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবাদি জমির অবক্ষয় চলতে থাকলে আগামী ৭০ বছর পরে বাংলাদেশে কোনো কৃষি জমি অবশিষ্ট থাকবে না।
তাই, চীন, থ্যাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মত আমাদের দেশেও ইট উৎপাদনে কৃষিজমির মাটির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি। বাংলাদেশে বর্তমানে পরিবেশবান্ধব দুই শতাধিক ব্লক ইট তৈরির কারখানা রয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় ব্লক ইটের কারখানা সংখ্যা খুবই কম।
পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট ব্যবহারে সুবিধা সমূহ:
১। ব্লক ইট তৈরিতে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের পরিবর্তে নদীর তলদেশের মোটা বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়।
২। ব্লক ইট তৈরি হয় কারখানায় আর ইট তৈরি হয় ইটভাটায়, তাতে জায়গাও কম লাগে এবং আগুনেও পোড়াতে হয় না।
৩। ব্লক ইট ব্যবহারে ভবনের নির্মাণব্যয় ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব।
৪। ব্লক ইট সার্বিকভাবে কৃষিবান্ধব, পরিবেশবান্ধব, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগসহনীয়, টেকসই, ওজনে হাল্কা, দীর্ঘস্থায়ী, সহজ নির্মাণ, উন্নত মানের ফিনিশ, কম অপচয়, আগুন ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী, তাপ ও শব্দনিরোধক।
৫। ব্লক ইট নির্মাণে খরচঃ বর্তমানে ৫টি ইটের বাজার মূল্য প্রায় ৬০ টাকা এবং পাঁচটি ইটের সমান ১টি ব্লক ইটের মূল্য ৩৭ টাকা।
৬। ইট ভাটার চেয়ে ব্লক ইটের কারখানা খুলতে কম টাকা লাগে। ৪০–৫০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলেই ব্লক ফ্যাক্টরি শুরু করা যায়।
৭। ব্লক ইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ড্রেসিং এর দরকার হয় না ফলে নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যায়।
৮। ব্লক ইট ওজনে হালকা বিধায় স্থানান্তর সহজ।
৯। ব্লক ইট সাধারণ ইটের তুলনায় হালকা ওজনের হয়, ফলে ভবনের ভিত্তিতে চাপ কম পড়ে এবং মাটির ভারবহন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম হলেও নির্মাণ করা সম্ভব।
১০। ব্লক ইট দিয়ে কম পুরুত্বের দেওয়াল নির্মাণ করা যায় ফলে ফ্লোর এরিয়া তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়।
১১। ব্লকের আকার বড় হয় জোড়ার সংখ্যা কম হয়, ফলে মসলা কম লাগে।
১২। ব্লকে ফাঁকা থাকায় এগুলো তাপ, শব্দ ও আর্দ্রতায় অন্তরক হিসেবে উত্তম।
১৩। সর্বোপরি এগুলো আবহক্রিয়ায় কম আক্রান্ত হয়, তাই এগুলোর পৃষ্ঠে প্লাস্টারের দরকার হয় না।
১৪। ব্লকের দ্বারা নির্মিত দেওয়াল সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
১৫। চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকার–আকৃতির ব্লক তৈরি করা সম্ভব।
সুপারিশ:
১। নতুন করে কোনো ইটভাটা স্থাপনের অনুমতি প্রদান না করা এবং মাটি পোড়ানো বৈধ ও অবৈধ সকল ইটভাটাকে নিরুৎসাহিত করে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট কারখানা স্থাপনকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
২। পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রচলিত ইটের ব্যবহার থেকে সরে এসে ধাপে ধাপে স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারি সব উন্নয়নকাজে ব্লক ইট ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করা।
৩। ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা এবং ব্লক ইটের বাজার তৈরি করা।
৪। ব্লক ইট উৎপাদন উৎসাহিত করতে প্রকল্প অনুমোদনের সময় ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলক ব্যবহার, সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ ও কর ছাড় দেয়া।
৫। ব্লক ইট প্রস্তুত ও ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারক ও নির্মাণশ্রমিকদের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৬। ব্লক ইটের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সরকারের সব উন্নয়ন প্রকল্পে নির্দিষ্ট হারে ব্লকের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
৭। বেসরকারি পর্যায়ে নির্মিতব্য এপার্টমেন্ট ভবন ও সীমানা প্রাচীরে নির্দিষ্ট হারে ব্লক ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া।
৮। ব্লক ইট প্রস্তুতকারক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার জন্য একটি উপযুক্ত সরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
৯। ব্লক ইট উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ আমদানিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমদানি শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেয়া।
১০। বিএসটিআই, বুয়েট বা এইচবিআরসি কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের ব্লকের জাতীয় মান নির্ধারণ করা।
১১। ব্লককে বাজারে সহজলভ্য করা এবং ইটের সরবরাহ ও চাহিদা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা।
১২। ইট ভাটার মালিকদেরকে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট তৈরির কারখানা স্থাপনে উৎসাহ দেওয়া এবং সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দিয়ে সহায়তা প্রদান করা।
১৩। আবাদি জমিতে নতুন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, মেগাপ্রজেক্ট, শিল্প–কারখানা ইত্যাদি নির্মাণে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) অনুমোদন নেয়া।
১৪। প্রতিটা উপজেলায় একজন করে এসআরডিআই এর কর্মকর্তা নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করা। যারা ভূমি ও মৃত্তিকা সম্পদ ব্যবহার ও সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
১৫। কোনো কৃষক তার জমির উপরে মাটির বিক্রি বা সরানোর ক্ষেত্রে এসআরডিআই এর কর্মকর্তার/দের অনুমোদন নেওয়া।
১৬। সরকার কর্তৃক কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন করার যে উদ্যোগ ২০১০ সালে নেওয়া হয়েছিল, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা।
১৭। ব্লক ব্যবহারের সুফলসমূহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রপত্রিকা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা। এবং
১৮। প্রচলিত ইটের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর ব্লক ইট ব্যবহারের বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে ছিল তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আবাদি জমির মাটিই আমাদের জীবনের ভিত্তি। এই মাটি আগামী ৭০ বছরের মধ্যে দেশ থেকে বিলিন হয়ে যাক তা কারো কাম্য নয়। তথ্য মতে সমতল ভূমিতে ১ ইঞ্চি আবাদি মাটি তৈরি হতে কমপক্ষে ৫০০ থেকে ১ হাজার বছর সময় লাগে, কাজেই একবার হারিয়ে গেলে তাকে ফিরে পাওয়া খুবই কঠিন ও অসাধ্য ব্যাপার। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাকে রক্ষা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: প্রফেসর, মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।