চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে, আরো আগ্রাসী রূপ নিচ্ছে। চলতি জুলাইয়ের ৯ দিনে যে সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, তা গত জুন মাসে আক্রান্তের তুলনায় বেশি। এর মাঝে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় আরো ১১১ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, যা চলতি মৌসুমে একদিনে সর্বোচ্চ। এ নিয়ে চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৫৯ জনে। মৃত্যু হয়েছে ১৩ জনের।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাসে মোট ২৮২ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয় চট্টগ্রামে। তবে চলতি জুলাইয়ের ৯ দিনেই আক্রান্ত হয়েছে ২৯৫ জন। হিসেবে জুন মাসে আক্রান্তের সংখ্যা পার হয়েছে জুলাইয়ের ৯ দিনে। জুলাইয়ের ৯ দিনে আক্রান্তের এই সংখ্যা মে মাসের তুলনায় ৫ গুণের বেশি। মে মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫৩ জন। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি মৌসুমে সব মিলিয়ে ৮৫৯ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে চট্টগ্রামে। এর ৬৭ শতাংশই আক্রান্ত হয়েছে শেষ ৩৯ দিনে (জুনের ৩০ দিন ও জুলাইয়ের ৯ দিনে)। শেষ ৩৯ দিনে মোট ৫৭৭ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। অথচ এর আগের ৫ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৮২ জন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৭৭ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২২ জন, মার্চ মাসে ১২ জন, এপ্রিলে ১৮ জন এবং মে মাসে ৫৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। জুন মাসে ২৮২ জন এবং চলতি জুলাইয়ের ৯ দিনে সর্বোচ্চ ২৯৫ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও হয়েছে শেষ ৩৯ দিনে। চলতি বছর এ পর্যন্ত মোট ১৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে চট্টগ্রামে। এর মাঝে জানুয়ারিতে মারা যায় তিনজন। বাকি ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে শেষ ৩৯ দিনে। জুনে ৬ জন এবং জুলাইয়ের এই কয়দিনে মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছর প্রথম ৫ মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দশ গুণের বেশি। গত বছর প্রথম ৫ মাসে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৭ জন। চলতি বছর প্রথম ৫ মাসে শনাক্ত রোগীর এ সংখ্যা ১৮২ জন। গত বছরের জানুয়ারিতে ৯ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৪ জন, মার্চে ১ জন, এপ্রিলে ৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল। মে মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল শূন্য।
প্রকোপ ছড়িয়েছে সব উপজেলায় : মহানগরের পাশাপাশি এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়েছে চট্টগ্রামের সব উপজেলায়। এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে মোট আক্রান্ত ৮৫৯ জনের মধ্যে মহানগরে আক্রান্তের সংখ্যা ৬১২ জন। আর উপজেলা পর্যায়ে আক্রান্তের সংখ্যা ২৪৭ জন।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে, এরই মাঝে চট্টগ্রামের সবকয়টি (১৫টি) উপজেলায় ডেঙ্গুর প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। গতকাল পর্যন্ত লোহাগাড়ায় ৫ জন, সাতকানিয়ায় ১৮ জন, বাঁশখালীতে ১২ জন, আনোয়ারায় ১৩ জন, চন্দনাইশে ৬ জন, পটিয়ায় ১৩ জন, বোয়ালখালীতে ৭ জন, রাঙ্গুনিয়ায় ৭ জন, রাউজানে ১১ জন, ফটিকছড়িতে ৩ জন, হাটহাজারীতে ১২ জন, সীতাকুণ্ডে ১১৭ জন, মীরসরাইয়ে ১১ জন, সন্দ্বীপে ৪ জন এবং কর্ণফুলী উপজেলায় ৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
হিসেবে দেখা যায়, উপজেলা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে সীতাকুণ্ডে ১১৭ জন। এরপর বেশি আক্রান্ত সাতকানিয়া, আনোয়ারা, পটিয়া, বাঁশখালী, হাটহাজারী ও রাউজানে। এখনো কম আক্রান্তের তালিকায় রয়েছে ফটিকছড়ি ও সন্দ্বীপ উপজেলা।
হাসপাতালে ভর্তি দেড় শতাধিক : সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে (গতকাল পর্যন্ত) মোট ১৫৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মাঝে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালেই ভর্তি আছেন ৩৪ জন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১৪ জন এবং অন্যান্য হাসপাতালগুলোতে আরো ১১০ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
মশারির ভিতর থাকতে চান না রোগীরা : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের তিনটি মেডিসিন ওয়ার্ডে (১৩, ১৪ ও ১৬) এবং শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের দুটি ওয়ার্ডে (৮ ও ৯) ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। ওয়ার্ডের এক পাশে ডেঙ্গু কর্ণার করে এই রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এক পাশে চিকিৎসা দিলেও একই ওয়ার্ডের ভেতর হওয়ায় সাধারণ রোগীরাও থাকছেন পাশাপাশি। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সার্বক্ষণিক মশারির ভিতর থাকার কথা বলা হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। রোগীরা মশারির ভিতর থাকতে চান না। অধিকাংশ সময়েই তারা মশারি তুলে রাখেন। সরেজমিনে একাধিক ওয়ার্ড ঘুরে এমন চিত্র চোখে পড়েছে।
হাসপাতাল থেকে ডেঙ্গু রোগীদের মশারি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু গরমসহ নানা অজুহাতে ডেঙ্গু রোগীরা মশারি তুলে রাখেন এবং বেশিরভাগ সময় তারা মশারির বাইরে থাকেন বলে জানান চমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. রাজিব পালিত। তিনি বলেন, রোগীরা সচেতন নয়। যার কারণে বারবার বললেও তারা মশারির ভিতর থাকতে চান না। এতে করে ডেঙ্গু আক্রান্তদের পাশাপাশি থাকা সাধারণ রোগীরা ডেঙ্গুতে আক্রান্তের ঝুঁকিতে পড়ছেন।
ঝুঁকির কথা স্বীকার করে চমেক হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুর সাত্তার আজাদীকে বলেন, ঝুঁকি তো অবশ্যই আছে। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর অবশ্যই মশারির ভিতর থাকা উচিত। শুধু হাসপাতালে নয়, ঘরে থাকলেও। নয়তো ঘরের অন্য সদস্যরাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে কামড়ানো কোনো মশা যাতে অন্য কাউকে কামড়াতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
সাধারণ রোগীদের ঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আলাদা ওয়ার্ডে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান। অল্প সময়ের মধ্যেই আলাদা ওয়ার্ডে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। কিন্তু এবার পুরোদমে বর্ষা নামার আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করে, যা দিন দিন বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত স্বাস্থ্য বিভাগও।
থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। তিনি বলেন, কিছুদিন বেশ গরম পড়লেও ঘূর্ণিঝড়ের পর থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামে। থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন পাত্রে (জায়গায়) পানি জমে মশার লার্ভার সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে এডিশ মশার প্রজনন ঘটছে। মূলত এ কারণেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে শুরু করেছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধের অন্যতম উপায় হচ্ছে মশার লার্ভা ধ্বংস করা, এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করা। মোট কথা মশক নিধন কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা।