মশা খুঁজতে এবার ‘ড্রোন’ ব্যবহার করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। বাসা–বাড়ি ও অফিস–আদালতের ছাদ বাগান এবং অন্যান্য উৎসে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার লার্ভা খুঁজতে এ ড্রোন ব্যবহার করা হবে। এর মধ্য দিয়ে এডিস মশার উৎসস্থল শনাক্তকরণে এক প্রকার জরিপও চালাবে চসিক। আগামীকাল রোববার নগরের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটি থেকে এ কার্যক্রম শুরু হবে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনও গত রোববার থেকে মশার উৎসস্থল খুঁজতে ড্রোন অভিযান শুরু করে। এছাড়া গত কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টি কর্তৃপক্ষ মশা মারতে ড্রোনের ব্যবহার করছে।
এর আগে নগরের ৪১ ওয়ার্ডের অনাবাদি জমি, নালা ও ঝোঁপঝাড়, ডোবা, খাল, পুকুর–জলাশয়, পরিত্যক্ত বাড়িতে জরিপ চালিয়ে মশার ৪৩৩টি প্রজননস্থল চিহ্নিত করে সংস্থাটির ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ শাখা। এসব প্রজননস্থলকে হটস্পট ধরে কীটনাশক ছিটানোর উপর জোর দিচ্ছে চসিক। ড্রোন অভিযানে যেসব বাসা–বাড়ির ছাদবাগানে এডিস মশার উৎসস্থল পাওয়ায় যাবে ওসব ভবন মালিককে আইনের আওতায় আনা হবে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, মশা খুঁজতে চসিক ‘ডিজেআই ম্যাভিক এয়ার এস২’ মডেলের ড্রোন ব্যবহার করবে। এটার ওজন ৫৯৫ গ্রাম। ড্রোনে থাকবে ৪৮ মেগাপিক্সেলের একটি ক্যামেরা। মাটি থেকে ১০০ মিটার উঁচুতে উঠে ছবি বা ভিডিও করা যাবে এ ড্রোন দিয়ে। এছাড়া যিনি ড্রোনটি নিয়ন্ত্রণ করবেন তার চতুর্পাশে ৩ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম এ ড্রোন। ড্রোনটির জন্য প্রতিদিন সিটি কর্পোরেশনকে ৫ হাজার টাকা ভাড়া গুণতে হবে। প্রাথমিকভাবে নগরের ৬০টি আবাসিক এলাকায় এ ড্রোন অভিযান পরিচালনার লক্ষ্য ঠিক করা হয়।
ড্রোন পরিচালনার জন্য সাগর দত্ত নামে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব না কমা পর্যন্ত সে ড্রোন দিয়ে মশার উৎসস্থল খুঁজবে। এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার সিএমপি কমিশনারকে দেয়া চসিকের একটি চিঠিতে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম নগরীতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ড্রোন ব্যবহার করে বিভিন্ন বাসা–বাড়ি ও অফিস–আদালতের ছাদ, ছাদবাগান ও পরিত্যক্ত জায়গা পর্যবেক্ষণ করে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন’। ড্রোন ব্যবহারের অনুমতি চাওয়া হয় ওই চিঠিতে।
ড্রোন ব্যবহারে দায়িত্ব পাওয়া সাগর দত্ত আজাদীকে বলেন, অতীতে ১৫০ মিটার উঁচুতে ড্রোনটি তুলতে সক্ষম হয়েছি। বেশি উপরে উঠলে ছবি স্পষ্ট হয় না। তাই চসিকের কার্যক্রমে ১০০ মিটার পর্র্যন্ত তোলা হবে। তিনি বলেন, ২–৩ মিনিট ব্যপ্তি ভিডিও করে দেয়া হবে সিটি কর্পোরেশনকে।
চসিকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আজাদীকে জানান, স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা জন্ম নেয়, তাই বাসা–বাড়ির ছাদ এডিসের প্রজননের অন্যতম উৎস। কারণ ছাদবাগানে ফুলের টবে জমে থাকে স্বচ্ছ পানি। ছাদে আরো নানা উৎস থাকে যেখানে পানি জমে থাকে। কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের পক্ষে শহরের সব–বাড়িতে গিয়ে বা ছাদে এডিসের উৎস আছে কীনা যাচাই করা সম্ভব না। করলেও সেটা সময়–সাপেক্ষ। ড্রোন ব্যবহার করলে এ কাজ অনেক সহজ হবে বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া শহরের বহু বাড়ির ছাদের সঙ্গে আরেকটি ছাদ লেগে আছে। মশা খোঁজার জন্য প্রত্যেক ছাদে হেঁটে হেঁটে যাওয়াও সম্ভাব নয়। তবে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একটি ড্রোনের মাধ্যমে অনেকগুলো ভবনের ছাদ পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
জানা গেছে, গত বছর ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাদ ড্রোন দিয়ে সার্ভে করে। এর মধ্যে ২ হাজার ২৭০টি ছাদে এডিস মশার লার্ভা পায়। এদিকে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার পাঁচলাইশ ও উত্তর খুলশীতে দুইদিনে হেঁটে হেঁটে ৪১টি বাড়ি পরিদর্শন করে চসিক। এর মধ্যে ১০টি ভবনে এডিস মশার উৎস পাওয়া যায়। এই ১০ ভবন মালিককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ড্রোন ব্যবহারের সময়ও যে বাড়ির ছাদে এডিস মশার লার্ভা বা উৎস পাওয়া যাবে ওই ভবনের মালিককে জরিমানা করা হবে। প্রসঙ্গত, নগরে সরকারি–বেসরকারি ২ লক্ষ ৬ হাজার ৯৭৫টি হোল্ডিং আছে।
জোরালো হচ্ছে ক্রাশ প্রোগ্রামও : ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় চসিকের চলমান ক্রাশ প্রোগ্রামকে আরো গতিশীল করার উদ্যোগ নেয়া হযেছে। এর অংশ হিসেবে আজ থেকে স্প্রে ম্যানের সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এজন্য নতুন করে মশক নিধন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা হয় ৭৫ জন শ্রমিক। সবমিলিয়ে মশক নিধন কার্যক্রমে কাজ করবে ৪০০ শ্রমিক। তারা আজ শনিবার থেকে ১০টি টিমে ভাগ হয়ে কীটনাশক ছিটাবে। গত বৃহস্পতিবার ৭টি টিম কাজ করেছিল। এছাড়া গতকাল শুক্রবার নগরের সরকারি–বেসরকারি হাসপাতাল ও আশেপাশের এলাকায় কীটনাশক ছিটায়।
এছাড়া আগামীকাল রোববার থেকে সচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যক্রমও জোরালো করা হবে। এতদিন ৫টি টিম প্রচারণা চালালেও কাল থেকে দ্বিগুণ টিম বা ১০টি টিম মাইকিং করবে শহড়জুড়ে। সামগ্রিক বিষয়ে চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মো. আবুল হাশেম আজাদীকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করছি। এ কার্যক্রম যাতে আরো গতিশীল হয় তাই ড্রোন ব্যবহার করব। ড্রোন দিয়ে আমরা এডিস মশার উৎসস্থল পর্যবেক্ষণ করব। গত সপ্তাহে আমরা বাসা–বাড়িতে অভিযান চালিয়েছি। ড্রোনের ব্যবহারে আরো গতি বাড়বে। এখন এক ঘণ্টায় যত বাসা–বাড়ি ভিজিট করছি ড্রোনে একই সময়ে কয়েকগুণ বেশি বাসা–বাড়ি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। কারো বাসা–বাড়িতে লার্ভা পাওয়া গেলে সাথে সাথে জরিমানা করব। এছাড়া কীটনাশক ছিটাতে স্প্রে ম্যানের সংখ্যা বাড়িয়ে টিম বৃদ্ধি করছি। শনিবার থেকে ১০টি টিম স্প্রে করবে।
চসিকের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহী আজাদীকে বলেন, হটস্পটের পাশাপাশি নগরের ৪১ ওয়ার্ডে ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে। পর্যাপ্ত কীটনাশক মজুদ আছে।
প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন চকবাজার ওয়ার্ডের পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার প্রেসিডন্সি স্কুলের সামনে একটি ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করে চসিক। এরপর ২২ জুন একই ওয়ার্ডের চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের সামনে ৪১ ওয়ার্ডে ১০০ দিনের আরেকটি ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হয়। সর্বশেষ কর্মসূচির ১৬ দিন পেরিয়েছে। এরপরও মশা নিয়ন্ত্রণে না আসার অভিযোগ করেছেন নগরবাসী। এদিকে নগরে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপও। গতকাল নতুন করে ৩৪ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত শনাক্ত হয় ৭২১ জন।