আল কুরআনের আলোকে দুআর গুরুত্ব:
দু’আ শব্দটি আরবি, এর অর্থ ডাকা, আবেদন করা, প্রার্থনা করা, যে কোন অবস্থাতেই আল্লাহকে ডাকা, আল্লাহর নিকট চাওয়া, দুআ করা ইবাদতের শামিল। আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “তোমরা আমার নিকট প্রার্থনা করো, আমি তোমাদের ডাকে (আবেদনে) সাড়া দিবো, নিশ্চয় ওইসব লোক যারা আমার ইবাদত থেকে অহঙ্কারে বিমূখ হয় তারা অবিলম্বে জাহান্নামে যাবে লাঞ্চিত হয়ে। (সূরা: আল মু’মিন, পারা:২৪, আয়াত: ৬০)
বর্ণিত আয়াতে দুআ করার নির্দেশ ও দুআ কবুল করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। আল্লাহর রহমত বান্দার সন্নিকটে রয়েছে, বান্দার দুআ বিফল হয়না, মহান আল্লাহ বান্দার দুআ কবুল করেন। পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ করেছেন, “এবং হে মাহবুব যখন আপনাকে আমার বান্দাগন, আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে তবে আমি তো নিকটেই আছি, প্রার্থনা গ্রহণ করি, আহবানকারীর যখন আমাকে আহবান করে সুতরাং তাদের উচিৎ যেন আমার নির্দেশ মান্য করে এবং আমার উপর ঈমান আনে যাতে পথের দিশা পায়। (সূরা: বাক্বারা, পারা:২, আয়াত: ১৮৬)
বর্ণিত আয়াতে এ কথার ইঙ্গিত রয়েছে যে, হে প্রিয় মাহবুব! সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ব্যক্তি আপনার কাছে আমাকে তালাশ করে আমি তাদের সন্নিকটে, যে আপনার থেকে দূরে সরে যায় আমিও তার থেকে দূরে। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, যদি আপনার নিকট আসে তবে নিশ্চয় আল্লাহকে পাবে তওবা কবুলকারী দয়ালু। (সূরা: নিসা, পারা:৫, আয়াত: ৬৪)
হাদীস শরীফের আলোকে দুআর গুরুত্ব:
দুআর মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভের পথ সুগম হয়, অন্তরের হতাশ দূর হয়, দুআর মাধ্যমে অন্তর আলোকিত হয়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “তোমাদের মধ্যে যার জন্য দুআর দরজা উন্মুক্ত করা হবে তার জন্য রহমতের সকল দরজা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। আর আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম প্রার্থনা হলো শারীরিক সুস্থতা কামনা করা। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ৩৫৪৮)
বিরাজমান বিপদাপদ ও অনাগত বিপদাপদ থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য আল্লাহর সমীপে কায়মনোবাক্যে দুআই বান্দাকে রক্ষা করতে পারে। হযরত মুআয ইবনে জাবাল রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, আগত অনাগত সমূহ বিপদাপদ থেকে (পরিত্রানের জন্য) দুআ হচ্ছে উপকারী। হে আল্লাহর বান্দাগন, তোমরা অবশ্যই দুআ করো। (মুসনাদে আহমদ–হাদীস: ২২০৪৪)
গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকলে দুআ কবুল হয়:
অন্যায় অপরাধ, মিথ্যাচার পাপাচার ও গুনাহের কাজ ও অপকর্ম থেকে মুক্ত থেকে বিনীত ভাবে আল্লাহর সমীপে দুআ করতে হবে। বান্দার জন্য যা কিছু কল্যাণকর তিনি ভালো জানেন বান্দার জন্য যা ক্ষতিকর ও অকল্যাণকর তিনিই এ বিষয়ে সর্বজ্ঞ। বান্দার কাজ হলো অন্যায় কাজ হতে মুক্ত থেকে আল্লাহর দরবারে দুআ করা। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত উবাদাহ ইবনে সামিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ভূপৃষ্টে যখন কোন মুসলিম যখন দুআ করেন আল্লাহ তা’আলা তার দুআ কবুল করে তাকে তা দান করেন অথবা তার থেকে অনুরূপ অনিষ্ঠতা দূর করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত সে কোন অন্যায় কাজের জন্য দুআ না করে অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন না করে। এক ব্যক্তি বলল, তাহলে আমরা অধিক পরিমাণ দুআ করব রাসূলুল্লাহ এরশাদ করেন, আল্লাহ তা’আলাও অধিক বেশি দিবেন। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ৩৫৭৩)
দুআ কবুল হওয়ার কতিপয় শর্ত:
আল্লাহর দরবারে দুআ কবুল হওয়ার জন্য বিশেষ কয়েকটি শর্ত রয়েছে। ১. বিনীত ভাবে একনিষ্ট অন্তরে দুআ করতে হবে, ২. আল্লাহর কাছেই দুআ করতে হবে অন্যদিকে অন্তর মনোনিবেশ করা যাবেনা, ৩. হারাম বিষয় ও অবৈধ কিছু লাভের জন্য দুআ করা নিষেধ, ৪. আল্লাহর রহমত লাভে দৃঢ় প্রত্যয়ী হতে হবে, ৫. এ অভিযোগ করা যাবেনা দুআ করতে আছি কিন্তু কবুল হচ্ছেনা। বণির্ত শর্তাবলী মেনে দুআ করলে বিফল হয়না। অনেক সময় বান্দার কল্যাণ বিবেচনা করে বান্দার প্রার্থীত নিয়ামত বিলম্বে দেয়া হয়। অথবা ঐ দুআর বরকতে বান্দার এমন জটিল কঠিন বিপদ মুসীবত দূরীভূত হয়ে যায় যা বান্দা কল্পনাও করেনি। কোন বান্দার দুআর প্রতিদান দুনিয়াতে না দিয়ে তার আমল নামায় লিপিবদ্ধ করা হয়। তার সব প্রতিদান তাকে পরকালে দেয়া হবে যা পেয়ে বান্দা সীমাহীন খুশী হয়ে যাবে।
দুআ করার নিয়ম ও আদব:
১. উত্তম সময়ে দুআ করার গুরুত্ব অনুধাবন করা যেমন আরাফাত দিবস ৯ই জিলহজ্ব, ২. মাস সমূহের মধ্যে রমজানুল মুবারক, ৩. জুমাবার দিবসে, ৪. রাতের শেষ ভাগে, (এয়াহিয়াউল উলুম, খন্ড:১, পৃ: ৭৬৫) ৫. নামাযের সময় সুনির্ধারিত, নামাযের পর দুআ কবুল হয়। (এয়াহিয়্যউল উলুম, খন্ড:১, পৃ: ৭৬৫), ৬. আজান ও ইকামতের মাঝখানে দুআ ফেরত হয় না। (মুসনাদে আহমদ ইবনে হাম্বল, খন্ড: ২, পৃ: ৫০৪)
শ্রেষ্ঠ দুআ “আলহামদুলিল্লাহ”:
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এরশাদ করতে শুনেছি, শ্রেষ্ঠ যিকর হলো, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” আর শ্রেষ্ঠ দু’আ হলো “আলহামদুলিল্লাহ”। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ৩৩৮৩)
হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় তোমাদের রব অত্যন্ত লজ্জাশীল ও দয়াময়, বান্দা যখন দুআর জন্য হাত উত্তোলন করে তখন তিনি খালি হাত ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ৩৫৫৬)
তিন শ্রেনির দুআ নি:সন্দেহে কবুল হয়:
হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তিন ব্যক্তির দুআ নি:সন্দেহে কবুল হয়, ১. মাতা পিতার দুআ, ২. মুসাফিরের দুআ, ৩. মজলুমের দুআ। (ইবন মাজাহ শরীফ, হাদীস: ৩৮৬২)
ফরজ নামাযের পর দুআ কবুল হয়:
হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো কোন দুআ বেশি কবুল হয়, নবীজি এরশাদ করেন, শেষ রাতের মধ্যভাগে এবং ফরজ সালাতের পর দুআ করা। (তিরমিযী শরীফ, হাদীস: ২৭৮২)
দরুদ শরীফের ওসীলায় দুআ কবুল হয়:
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নিশ্চয় দুআ আসমান ও জমীনের মাঝখানে ঝুলন্ত থাকে দুআ উর্দ্বালোকে পৌছেনা যতক্ষণ না তুমি তোমার নবীর উপর দরুদ শরীফ না পড়বে। (মিশকাত শরীফ, পৃ: ৮৭)
মক্কা শরীফে দুআ কবুলের স্থান সমূহ:
১. বায়তুল্লাহ শরীফে দৃষ্টি পড়ার পর দুআ করা, ২. আরাফাতের ময়দানে, ৩. মিনায়, ৪. জামারাতের নিকটে, ৫. মাউলুদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র পবিত্র জন্মস্থান, ৬. জান্নাতুল মুআল্লা: (মসজিদুল হারামের পূর্ব দিকে অবস্থিত মক্কা শরীফের প্রসিদ্ধ কবর স্থান এ পবিত্র কবরস্থানে নবীজির পিতা হযরত আবদুল্লাহ (রা.), নবীজির দাদা, নবীজির সহধর্মিনী উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রা.)সহ অসংখ্য সাহাবায়ে কেরাম ও নবীজির পবিত্র বংশের পূণ্যাত্নাগন এ কবরস্থানে শায়িত আছেন।) ৭. গারে সওর (নবীজি হিজরতের সময় এ নূরানী পাহাড়ে তিন দিন তিনরাত অবস্থান করেছিলেন। সাথে ছিলেন আমিরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)।) ৮. গারে হেরা, (হেরা পর্বতে সর্বপ্রথম নবীজির উপর ওহী নাযিল হয়, এটি মক্কা মুকাররমার সর্বাধিক সুউচ্চ পাহাড়,) ৯. মুলতাযিম (কাবা ঘর ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থান,) ১০. হাতিমে কাবার ভেতরে, ১১. সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের উপর, ১২. যমযম কুপের পানি পান করার সময়, ১৩. মসজিদে তানঈম তথা হযরত আয়েশা (রা.)’র নামে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ। এ মসজিদের দূরত্ব মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় ৫ কি.মি. (সংক্ষেপিত)।
হে আল্লাহ আমাদের দুআ কবুল করুন। আমাদের ক্ষমা করুন, দুআর ফযীলত ও বরকত আমাদের নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম। খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম
বুড়িশ্চর, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
প্রশ্ন: কুরবানীর চামড়ার বিধান সম্পর্কে ইসলামী শরীয়তের বিধান জানালে উপকৃত হব
উত্তর: কুরবানী দাতা ইচ্ছাকরলে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। যেমন মুসল্লা বানানো, বিছানা, চামড়ার পাত্র মশক ইত্যাদি তৈরী করা জায়েজ। তবে চামড়া যদি বিক্রয় করে বিক্রয়লব্ধ টাকা নিজে ভোগ করতে পারবেনা এই টাকা নিজের কোনো কাজেও লাগাতে পারবেনা। চামড়া যদি বিক্রি করা হয় এর হকদার হবে একমাত্র গরীব মিসকীন ও ইলমেদ্বীন অর্জনকারী দরিদ্র শিক্ষার্থীরা। (আলমগীরি, খন্ড: ৫, পৃ: ৩০১, জাওয়াহিরুল ফিকহ)
কুরবানীর পশুর চামড়া কোনো কাজের পারিশ্রমিক হিসেবে কাউকে দেওয়া জায়েজ নেই। যারা যাকাত ফিতরা পাওয়ার উপযোগী তারাই কুরবানীর পশুর চামড়ার বিক্রিত অর্থ পাওয়ার হকদার। কুরবানীর পশু যবেহ করা বা মাংস কাটার বিনিময়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কুরবানীর মাংস বা চামড়া দেওয়া ইসলামী আইনজ্ঞ ফকীহগনের মতে জায়েজ নেই। (সংক্ষেপিত), (ওয়াকারুল ফতোয়া, খন্ড: ২, পৃ: ৪৮১, বাহারে শরীয়ত খন্ড:১৫, পৃ: ১৫১, ফতোওয়ায়ে ফয়জুর রসূল, খন্ড: ২, পৃ: ৪৭৭, জাওয়াহিরুল ফিকহ)