আমাদের দেশে কুরবানির ঈদের দিন সবাই খুব ব্যস্ত থাকেন। গরু, কসাই, মাংস, ছুরি ইত্যাদি নিয়ে। আমি গত কয়েক বছর একটা গরু ছেলেমেয়েদের নামসহ শ্বশুরবাড়িতে (গ্রামে) কুরবানি দেবার ব্যবস্থা করেছি। শ্বশুর বাড়ির জমিজমার তত্ত্বাবধায়ক গরু কুরবানি দিয়ে মাংস বিতরণ করেন। নিজের জন্য সংরক্ষণ করেন এবং আমার জন্য প্রয়োজন মত মাংস পাঠান কারণ শহরে আমার ঘরের কেয়ার টেকারদের কিছু মাংস দিতে হয়। শহরের সাধারণ মানুষ বিভিন্নভাবে কুরবানির মাংস সংগ্রহ করেন কিন্তু গ্রামের অনেক মানুষের পক্ষে তা সম্ভব হয় না। তাই গ্রামে কুরবানি দেবার ব্যবস্থা করেছি। শহরে অনেক আত্নীয়স্বজন আছেন কিন্তু তাদের মাংস দেয়ার অর্থ ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া’।
ভালো কাজের সুফল অনেক। গ্রামে কুরবানি দেওয়ায় অনেক দুস্থ মানুষ মাংস পাচ্ছেন। সে সাথে অনেক বছর পর ঈদের দিন আমারও খুব আরাম আয়েশে কাটছে। শহরের বাসায় আমার ঈদের দিনে ব্যস্ততা নেই। ফজরের নামায পড়ার পর আমি আরও কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিই। তারপর উঠে জর্দা সেমাই খেয়ে ধীরে ধীরে চা কফি পান করি। একা থাকি তাই শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোন করেন। আমি নাতিশীতোষ্ণ রোদে বসে (চট্টগ্রামে আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে তাই মৃদু উষ্ণ চমৎকার আবহাওয়া) মোবাইল ফোনে শুভেচ্ছা বিনিময় করি। এবার ঈদে কন্যা অনিন্দিতা তার ছোট ছেলে শুভ্রকে নিয়ে আমার সাথে ঈদ করার জন্য এসেছে। ফলে ঈদের দু’তিন দিন আগে থেকেই আমরা আনন্দ করেছিলাম। একদিন ভাটিয়ারিতে গলফ ক্লাবের আশে পাশে মনোরম এলাকায় (চট্টগ্রামে আজকাল বেড়াবার জন্য অনেক সুন্দর স্থান রয়েছে) ঘুরে বেড়িয়ে দুপুরের লাঞ্চ খেয়ে বিকেলে ফিরে এসেছিলাম। আরেকদিন ছোট নাতির সাথে ছোট হয়ে সিংহ বাঘ দেখে অনেক মজা লাগলো। ফয়’স লেক এখন শিশু তরুণদের বিনোদনের স্পট। অতীতের শ্যামল অরন্যের মাঝে লেকের পানি, নৌকায় ভ্রমণ মনে অন্যরকম অনুভূতি এনে দিতো। মনে হতো ‘দূরে কোথাও’ যেখানে ‘হারিয়ে যেতে নেই মানা’। পান্নাসবুজ শ্যামল পরিবেশে কলেজের সহকর্মীদের সাথে পিকনিক করেছিলাম। লেকের একদম কাছে নরম ঘাসের ওপর বসে খেতে খেতে আড্ডা দেওয়া, ছবি তোলা, ডিঙি নৌকায় ভয় মিশ্রিত অন্তরে লেকের পানি হাতে স্পর্শ করে ঘুরে বেড়ানো নাগরিক জীবনের যন্ত্রের আনন্দ থেকে আমাদেরকে কিছুক্ষণের জন্য মুক্তির আনন্দ দিয়েছিল।
বিকেলে একটা রেস্তোঁরায় গিয়েছিলাম। মেনু দেখে শুভ্র জিজ্ঞেস করলো, নানু অক্টোপাসের মাংসের স্টেক খাবেন? অক্টোপাস? ফয়ে’স লেকে অক্টোপাসের ছবি দেখেছিলাম। মনে পড়তেই আঁতকে উঠলাম। অক্টোপাস কি বিচ্ছিরি! এর মাংস কি করে খাবো। বিদেশে খায় জানি। এখন এদেশেও! কাঁকড়া অক্টোপাস লবস্টার এসব এখন অনেকের প্রিয় খাদ্য। আমি অনিন্দিতাকে বললাম অক্টোপাস হারাম না হালাল? আজকাল এ নিয়ে সবাই চিন্তিত। অনেক আগে বিদেশে গিয়েছিলাম। সে সময় হ্যাম বারগার প্রায় সব খাবারের দোকানের রয়েছে। হ্যাম বারগার কিনতে একজ বাঙালি নিষেধ করেছিলেন। বলেছিলেন “জানেন না হ্যাম আমাদের জন্য হারাম! হট ডগ কিনতে গিয়ে মুজিব জিজ্ঞেস করেছিল এটা হ্যাম না বিফ? বিদেশি বিক্রেতা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। এ আবার কি ধরনের প্রশ্ন। তাদের জন্য দু’টোই হালাল। তাই নিস্পৃহ কন্ঠে উত্তর দিয়েছিল ‘আই ডোন্ট নো’। সে সময় চিকেন, বিফ হালাল ভাবে জবাই করা হয়েছে নাকি তা নিয়ে কেউ, মাথা ঘামাতো না। এখন সবাই সচেতন হয়েছেন। হান্ড্রেন্ড পার্সেন্ট হালাল খোঁজেন নিশ্চিন্ত মনে খান। কিন্তু দুর্নীতি যে হারাম তা নিয়ে অনেকের অন্তরে কোন রকম দুশ্চিন্তা নেই।
ঈদের দিন কন্যা ও নাতিকে নিয়ে খুব আনন্দে কাটালাম। কসাই, মাংস সংরক্ষণ, বিতরণ থেকে অনেক দিন পর মুক্তি পেয়েছি। মনেও শান্তি। কুরবানির মাংস যাদের জন্য বেশি প্রয়োজন তাদের অনেকেই সেদিন খেয়েছেন। মাংস পেয়েছেন। শহর থেকে দূরে হলেও আমি খবর পেয়েছি। ঈদের পরদিন দুপুরে অনিন্দিতা বললো আম্মু চলেন সিনেমা দেখি। সিনেমা? সে তো অনেকদিন দেখি না। আজকাল শুনেছি দেশে অনেক ভালো ছবি হচ্ছে। তাই বললাম ঠিক আছে চলো যাই। শুনেছি সিনে কমপ্লেঙে আজকাল তরুনরা সিনেমা দেখছে। কিন্তু কি ছবি? বাণিজ্যিক ছবির বিজ্ঞাপন (টেলিভিশনে) দেখলেও আমার মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এদেশে এখন অনেক নারী বিনোদনের উপকরণ। আজকাল নাটক, সিনেমা, কিছুই দেখা হয় না। এ বিষয়ে খোঁজও নেই না। অথচ তরুণ বয়সে বান্ধবীরা মিলে আলমাস, জলসা সিনেমা হলে সিনেমা দেখতাম। তখন সুতরাং, আবির্ভাব, সূর্য দীঘল বাড়ি, জহির রায়হানের সিনেমা সবার ভাল লাগতো। সিনেমা দেখার সাথে সাথে বান্ধবীরা মিলে সেজেগুঁজে তখন পাউডার পার্লার ছিল না, সাজগোজ মানে মুখে একটু পাউডার ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, সূতি বা জর্জেটের শাড়ি পরনে থাকতো) আনন্দে কলরব করে সিনেমা দেখার পুলক ছিল অন্যরকম। তবে মনে সামান্য ভীতি থাকতো যদি মুরুব্বিরা জানতে পারেন। সে সময় ভাল ছবিগুলোতে অশ্লীলতা থাকতো না। যা হোক অনিন্দিতাও সিনেমার খোঁজ রাখে না। আমি প্রাক্তন সহকর্মী রোকেয়াকে ফোন করলাম। সে তার নাতনিকে ফোন করলো। জানলাম ‘লাল শাড়ি’ ভাল সিনেমা কিন্তু সেটা নেই। ‘সুড়ঙ্গ’ আছে। সেটাও ভালো। ভাবলাম ‘পথের পাঁচালী’ অথবা ‘অপুর সংসারের’ মত সিনেমা আমাদের দেশে তৈরি হতে দেরি হবে কিন্তু “হঠাৎ বৃষ্টি”র মত বিনোদনমূলক ভালো সিনেমা তৈরি হতে পারে বা ‘জীবন থেকে নেয়ার’ মত সিরিয়াস সিনেমা নির্মাণ করা অসম্ভব না।
একটি সিনে কমপ্লেঙে আমি ও অনিন্দিতা গেলাম। শুভ্র যাবে না। আগে সিনেমা হলের সামনে ভীড় থাকতো, টিকেট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন ছিল। কিন্তু সিনে সিনেকমপ্লেক্সের সামনে সেরকম ভীড় নেই। সিনেমা দেখবো কি ! দর্শকরা ঘোরাঘুরি করছে। কারণ প্রজেক্টরে কি সমস্যা হয়েছে। আমি সালোয়ার কামিজ পরে গিয়েছিলাম। বয়স্ক মানুষ দেখলে সবাই কি ভাববে। আমাকে স্মার্ট মনে হলেও মনে মনে আমি সব সময়ই ভীত থাকি এ ভেবে “পাছে লোকে কিছু বলে”। মুখে মাস্ক। কিন্তু যেখানে ‘বাঘের বয় সেখানে সন্ধ্যা হয়।’ হলের সামনে ত্রিতরঙ্গ সংগঠনের কর্ণধার শাওন এবং চৌদ্দ পনেরো জন সদস্য। তাড়াতাড়ি মাস্ক খুলে ফেললাম। এখন মুখ লুকিয়ে লাভ হবে না। শাওন বললো আজকে সিনেমা দেখা হবে না মনে হয়। প্রজেক্টরে গন্ডগোল। মনে মনে ভাবলাম তা আমি জানি। কারণ যখনই কোন সময় আনন্দ করতে গিয়েছি একটা বিপত্তি ঘটবেই। আমি সেটাকে ‘ব্যাড লাক’ বলি না। বলি ‘গুড লাক’। এই ‘গুড লাক’ আমাকে খুব কষ্ট দেয়! সমস্যা সৃষ্টি করে। যা হোক দু’ঘন্টা পর সিনেমা শুরু হলো। ‘সুড়ঙ্গ’ না। আরেকটা সিনেমা। দশটা বেজে গিয়েছে। বাসায় শুভ্র একা। তাই অনিন্দিতাকে বললাম আধ ঘন্টা দেখবো। আজকাল নতুন ধরনের কি সিনেমা তৈরি হচ্ছে তা কিছুক্ষণ পরখ করে দেখবো। সব কিছুর অভিজ্ঞতা থাকা প্রয়োজন। সিনেমা শুরু হলো। গল্পটি অদ্ভুত। প্রবীণ স্বামী (বিকারগ্রস্ত) তার নবীন স্ত্রীকে চাবুক দিয়ে মারধর করে। এ যুগেও এসব হয় কি! হতে পারে! আগুন দিয়ে বউকে হত্যার খবর আমরা প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি। কিন্তু স্ত্রীর তেমন রিএ্যাকশন নেই। এতো চাবুকের বাড়ি খেলে তো অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবার কথা। কিন্তু পরদিনই নায়িকা মনের আনন্দে নাচ গান করছে। বাংলাদেশের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা ক্যামেরায় মনোরমভাবে ধরা পড়েছে। নায়িকা অনিন্দ্যসুন্দর। বাংলাদেশের সিনেমায় ঐশ্বর্য রাইয়ের চেয়ে সুন্দর নায়িকা আছে জানতাম না। গল্প বোধগম্য হলো না। শেষ পর্যন্ত দেখলে হয়তো বুঝতে পারতাম। সংগীত মনমুগ্ধকর। কিন্তু চাবুক মারার দৃশ্য আমার প্রবীণ হার্ট সহ্য করতে পারছিল না। সাউন্ড খুব ভাল। বিপুল শব্দ। আমি হার্টফেল করবো না তো। তাই সিনেমা অর্ধেক দেখে অনিন্দিতাকে সাথে নিয়ে ফিরে এলাম। আমাদের দেশে সত্যজিত– ঋত্বিকের মত পরিচালক কখন আসবেন জানি না। কিন্তু তরুণ, তপন, বাসু চ্যাটার্জির মত পরিচালক নিশ্চয়ই আছেন। নতুন প্রজন্ম ব্যতিক্রমধর্মী ভাল সিনেমা হয়তো দেখতে পাচ্ছেন বা পাবেন। ঈদের সময় এদেশের তরুণদের ভালো সিনেমা দেখার আগ্রহ চিরন্তন।
টীকা : কুরবানির ঈদে মাংস সংরক্ষণ করবেন না। বিতরণ করবেন দু:খী মানুষের মাঝে। দেহ ও মনের জন্য স্বাস্থ্যকর হবে।
লেখক : কবি, সাহিত্যিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক।