প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৫ জুলাই, ২০২৩ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহর রসুল (.) নবুয়ত জিন্দেগীতে একবারই হজ করেছেন, যাকে বিদায় হজ বলা হয়। উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য হজ কবে ফরজ হয়েছিল এ নিয়ে ৬ টি বর্ণনা পাওয়া যায়। তৎমধ্যে মজবুত বর্ণনায় দুটি পড়ে। একটি হল ৯ম হিজরি অন্যটি ১০ম হিজরি। নবম হিজরির পক্ষে যৌক্তিকতা হল ৮ম হিজরিতে মক্কা মুকাররমা বিজয়ের পরের বছর আল্লাহর রসুল (.) পবিত্র মদিনা থেকে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (.)’র নেতৃত্বে দুই শতের কমবেশি সাহাবাকে হজে পাঠিয়েছিলেন। এর কয়েকদিনের ব্যবধানে হযরত আলী (.)’র নেতৃত্বে মহান সাহাবাগণের আরেকটি গ্রুপকে হজে পাঠান। এতে হযরত আলী (.) কে হজ পালনের পাশাপাশি একটি দায়িত্ব দেয়া হয়, আর তা হল আগামী বছর থেকে অমুসলিমের জন্য কোন হজ নেই। হজ শুধুমাত্র মুসলমানের জন্য। নবম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার পক্ষে যৌক্তিকতা হল, হজ ফরজ না হলে আল্লাহর রসুল (.) গুরুত্ব দিয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (.)’র নেতৃত্বে মহান সাহাবাগণকে হজে পাঠাতেন না।

দশম হিজরিতে হজ ফরজ হওয়ার পক্ষে যৌক্তিকতা হল এর আগে হজ ফরজ হয়ে থাকলে আল্লাহর রসুল (.) কোন অবস্থাতেই হজ বিলম্ব করতেন না। মৌলিক ভাবে আরাফায় অবস্থানকে হজ বলা হয়। ইহা হজের প্রধান রুকন। হজ ফরজ হওয়ার পিছনে দৃষ্টি দিলে নবী পাক (.)’র পবিত্র মক্কায় তের বছর নবুয়ত জিন্দেগী ছিল অত্যধিক প্রতিকূল অবস্থায়। পবিত্র মক্কায় স্বল্পসংখ্যক ঈমান আনা মুসলমান টিকতে না পেরে আবিসিনিয়ায় হিজরত করতে বাধ্য হন। আবিসিনিয়া বলতে বর্তমান ইথিওপিয়া, সোমালিয়া ও আশপাশ নিয়ে বৃহত্তর এরিয়া। বাকিরা পর্যায়ক্রমে পবিত্র মদিনায় হিজরত করেন। নবী পাক (.) পবিত্র মদিনায় হিজরত করে বদর, উহুদ ও খন্দক সহ ভয়াবহ যুদ্ধের মুখোমুখী হন। অতঃপর ষষ্ঠ হিজরিতে মাত্র ১৭০০ জন মতান্তরে ১৪০০ জন সাহাবা নিয়ে এহরাম পরিধান করে ওমরা করতে আসেন জন্মভূমি মক্কা মোকাররমার দিকে। পবিত্র মক্কায় ঢুকতে বাধার সম্মুখীন হন। অনন্যোপায় হয়ে বর্তমান জেদ্দা যেতে হোদায়বিয়া নামক স্থানে মক্কার কাফেরদের সাথে সন্ধি করতে হয়। এ সন্ধির শর্তসমূহ অনেকটা একতরফা কাফেরদের পক্ষে। এর মধ্যেও এ সন্ধির মাধ্যমে প্রকাশ্য বিজয় বলে মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের সুরা ‘ফাতহ’র ১ নম্বর আয়াতে ঘোষণা দেন ‘নিশ্চয় আমি আপনাকে প্রকাশ্য বিজয় দান করেছি’।

মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে অষ্টম হিজরিতে দশ হাজার সাহাবার বিশাল সহযাত্রী নিয়ে বিনা বাধায় পবিত্র মক্কা জয় করেন, যা পবিত্র মক্কা বিজয় নামে খ্যাত। এর মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে দশম হিজরিতে পবিত্র মদিনায় আল্লাহর রসুল (.) ঘোষণা দেন: তিনি পবিত্র মক্কায় হজ করতে যাবেন। এর মধ্যে এই মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে তথা অষ্টম থেকে দশম হিজরির মধ্যে জাযিরাতুল আরব তথা আরব উপদ্বীপ দ্রুত ইসলামের ছায়াতলে এসে যায়। পশ্চিমে লোহিত সাগর, দক্ষিণে ইয়েমেন ওমান সহ আরব সাগর। পূর্বে আরব আমিরাত, কাতার সহ পারস্য উপসাগর। উত্তরে কুয়েত, ইরাক ও জর্ডানের অংশবিশেষ এই বিশাল এরিয়া জাযিরাতুল আরব।

পবিত্র মদিনায় নবী পাক (.)র হজের ঘোষণা ধ্বনিপ্রতিধ্বনি হতে হতে সমস্ত জাযিরাতুল আরবে মুসলমান নরনারীর কানে, দিলে আওয়াজ পৌঁছে যায়। উৎসাহ স্পৃহা জেগে বসে প্রাণপ্রিয় রসুলের সাথে হজ করতে পবিত্র মক্কায় গমন করবেন। আল্লাহর রসুল (.) নবুয়ত জিন্দেগীতে এই প্রথম এবং একবারই হজ করছেন। তিনি আল্লাহর প্রেরিত মহাপুরুষ। সমস্ত নবী রসুলগণের সর্দার। অতএব, হজ কী তা কীভাবে করতে হবে তার যাবতীয় আহকাম রসুল (.)’র নখদর্পন। কিন্তু মহান সোয়া লাখ থেকে দেড় লাখ সাহাবা যারা হজে আসবেন তাদের জানার কথা নয় হজ কিভাবে করা হবে। যেহেতু মুসলমান হিসেবে সমস্ত সাহাবার প্রথম হজ পালন বলা যাবে। আল্লাহর রসুল (.)’র ঘোষণায় পবিত্র মদিনা থেকে উত্তর পশ্চিম থেকে সাহাবাগণ পবিত্র মদিনায় মিলিত হন। যারা আসতে পারেননি তাঁরা পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ২৫ জিলকদ আল্লাহর রসুল (.) বিশাল সাহাবাগণের জুলুস সহকারে হজের উদ্দেশ্যে যুল হোলাইফা নামক মিকাতে এসে রাত্রি যাপন করেন। সকল উম্মাহাতুল মুমিনীনও সাথে ছিলেন। এখান থেকে পরদিন হজের নিয়তে এহরাম পরিধান করেন সকল মুসলিম নরনারী। আল্লাহর রসুল (.)’র নেতৃত্বে মহান সাহাবাগণ পবিত্র মক্কার দিকে আসতে থাকেন।

আল্লাহর রসুল (.) হাজার হাজার সাহাবার সমবিহারে জিলহজ মাসের ৪ তারিখে পবিত্র মক্কার একদম নিকটে পৌঁছে যান। সম্ভবত পরদিন দিনের প্রথম প্রহরে মসজিদুল হারামে প্রবেশ করেন। পবিত্র কাবা তাওয়াফ করেন রমল ও এজতেবা সমেত। তাওয়াফের পর সায়ী করে যাদের সাথে কুরবানির পশু নেই তাদেরকে এহরাম মুক্ত হতে নির্দেশ দেন। তাঁর সাথে পশু ছিল বিধায় এহরাম অবস্থায় থেকে যান। এখানে হজ দুই প্রকারে ভাগ হয়ে যায়। আল্লাহর রসুল (.) সহ যাদের সাথে পশু তথা উট দুব্বা আছে তাদের হজের প্রকার হল কেরান। অপরদিকে যাদের সাথে পশু না থাকায় তাওয়াফ সায়ীর পর এহরাম মুক্ত হলেন তাদের হজ হল তামাত্তু।

আল্লাহর রসুল (.) পবিত্র মক্কায় অবস্থানকালিন জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মহান সাহাবাগণ হজের উদ্দেশ্যে আসতে থাকেন। ৮ জিলহজ বৃহস্পতিবার সকালে পবিত্র মক্কা থেকে প্রায় ৫ কি.মি পূর্ব দক্ষিণে মিনায় পৌঁছেন। এখানে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন রাত্রিযাপন করে। ইত্যবসরে যারা পবিত্র মক্কায় এহরাম মুক্ত হয়েছিলেন তারা হজের উদ্দেশ্যে পুনরায় এহরাম পরিধান করেন। মিনা থেকে ৯ জিলহজ শুক্রবার সকালে আরাফাতের দিকে রওনা হন। আরাফার ময়দানে প্রবেশ করে বর্তমান মসজিদে নমেরার স্থানে অবস্থান নিয়ে গোসল করেন। বিদায় হজের খুতবা দেন। পর পর দুই রাকাত করে চার রাকাত যোহর আসরের নামাজ পড়েন। অতঃপর জাবালে রহমতের দিকে চলে যান। দীর্ঘ ৫/৬ ঘণ্টা এখানে মহান আল্লাহ পাকের জিকিরে মশগুল থাকেন।

যে সমস্ত অসংখ্য সাহাবা পরবর্তীতে পবিত্র মক্কায় তাওয়াফ সায়ী করতে পারেননি অথবা মিনা বা আরাফাতে এসে হজের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রসুল (.)’র সাথে মিলিত হন তাদের হজ হল এফরাদ।

বিদায় হজে আল্লাহর রসুল (.)’র সাথে কতজন সাহাবা ছিলেন সেসময় গণনা করতে পারার প্রশ্ন আসে না। কোনো কোনো বর্ণনায় সোয়া লাখ কোনো কোনো বর্ণনায় ১ লাখ ৩০ হাজার থেকে ৩৫ হাজার মহান সাহাবা নরনারী আরাফাতে বিদায় হজে উপস্থিত হয়েছিলেন। এতে ধারণা করা যায় যে, বিদায় হজে আল্লাহর রসুল (.)’র সাথে ১ লাখ ২৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার মহান সাহাবাগণকে নিয়ে হজ করেছেন।

আল্লাহর রসুল (.) নবীরসুলগণের সর্দার। তাঁর ভিতর জানা হয়ে থাকার কথা যে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মানবের কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে সেই লক্ষ্যে আরাফাতে সুরা মায়েদার ৩ নম্বর আয়াতটি নাজিল হয়। যেখানে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘আজকের এই দিনে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম’। এ আয়াতের মাধ্যমে রসুল (.)’র মিশনের সাফল্য ও সমাপ্তি ঘোষণা আসল। বিদায় হজে তিনি শীঘ্রই তাঁর ওফাতের ইংগিত দেন।

আরাফাতে সূর্যাস্তের পর যখন পশ্চিম আকাশে লালিমা দূর হয়ে গেল তখন উটে আরোহণ করে মহান সাহাবাগণকে সাথে নিয়ে মোযদালিফার দিকে যাত্রা করেন। রসুলে পাক (.) ধীরে ধীরে চলতে থাকলেন। অর্থাৎ স্বাভাবিক গতিতে চলতে চলতে মোযদালিফায় এসে পৌঁছলেন। পুরো যাত্রাপথে তিনি তালবিয়াহ পাঠে রত থাকেন।

মোযদালিফায় পৌঁছে আযান দিতে বললেন। অতঃপর প্রথম একামত দেয়া হল। মাগরিবের নামাজ আদায় করলেন। তারপর দ্বিতীয় একামত দেয়া হল একামতের পর এশার নামাজ আদায় করলেন।

অর্থাৎ এশার ওয়াক্তে মাগরিব ও এশা পর পর আদায় করা হল। এশার নামাজের পর রসুলে পাক (.) শুয়ে পড়লেন।

শোয়া থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়লেন। দোয়া করতে থাকলেন সুবহে সাদিক থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত।

আল্লাহর রসুল (.) পূর্বাকাশ একদম আলোকিত হয়ে গেলে মিনার দিকে যাত্রা করলেন। মোযদালিফা ও মিনার মধ্যবর্তী স্থানে গজবের স্থান অতিক্রমকালে উটের গতি বাড়িয়ে দিলেন। যেখানে আবরাহা বাদশাহ পবিত্র কাবা ধ্বংস করতে এসে নিজেই ধ্বংস হয়েছিল।

রসুলে পাক (.) মিনায় পৌঁছে প্রথমে বড় শয়তানের প্রতি ৭ টি পাথর নিক্ষেপ করলেন। তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ করলেন। অতঃপর হজের কুরবানি করলেন। বর্তমান মসজিদে খায়েফের নিকটে বিশ্রামে আসেন। এখানেও খুতবা তথা ভাষণ দেন। এতে হজের বিধিবিধান শিক্ষা দিলেন। অতঃপর ১০০ টি উট কুরবানি করলেন। এরপর মাথা মুণ্ডালেন।

অতঃপর প্রস্তুতি নিয়ে পবিত্র কাবার দিকে যাত্রা করেন। যোহরের নামাজের আগেই ফরজ তাওয়াফ ও সায়ী আদায় করে নেন। বারে বারে সহযাত্রীগণকে হজের আহকাম শিক্ষা দিচ্ছিলেন। জমজমের পানি পান করেন। সাফামারওয়া সায়ী করেন। এরপর মিনায় পুনঃপ্রত্যাবর্তন করেন।

সকালে সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে পুনঃ তিন শয়তানের প্রতি ৭ টি করে মোট ২১ টি পাথর নিক্ষেপ করেন।

১১ জিলহজ রবিবার রসুলে পাক (.) মিনায় আরেকটি খুতবা তথা ভাষণ দেন।

সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়লে নবী পাক (.) আবারও তিন শয়তানকে ২১ টি পাথর নিক্ষেপ করেন। মহান সাহাবাগণের মধ্যে যারা মিনা ত্যাগ করে বিদায় নিতে চেয়েছিলেন তাদেরকে অনুমতি দেন। এরই মধ্যে রাত্রে রসুলে পাক (.) পবিত্র কাবায় গিয়ে তাওয়াফ করেন যা হজের আহকামে বিদায়ী তাওয়াফ হিসেবে খ্যাত।

রসুল পাক (.) ১৩ জিলহজ মিনা ত্যাগ করেন তিন শয়তানকে ২১ টি পাথর নিক্ষেপ করেন। মিনা ত্যাগ করে পবিত্র মদিনায় রওনা হন। যুল হোলাইফা মিকাত পৌঁছা পর্যন্ত হজের সফর অব্যাহত রাখেন। যুল হোলাইফাতে রাত্রি যাপন করে পর দিন নবী পাক (.) পবিত্র মদিনায় পৌঁছেন।

নবী পাক (.)’র বিদায় হজের উপর একাধিক বর্ণনা রয়েছে। তৎমধ্যে ১৩ জিলহজ মিনা থেকে পবিত্র মদিনা গমনের বিষয়টি কিছুটা অস্পষ্টতা দেখা যায়। বিদায় হজের পর মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে নবী পাক (.)’র ওফাত হয় পবিত্র মদিনায়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধডেঙ্গু জ্বরের ক্লিনিক্যাল কোর্স এবং চিকিৎসা প্রণালী
পরবর্তী নিবন্ধসত্যিকারের কুরবানি