অনিয়মের অভিযোগে ভোট বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমানো নিয়ে বিরোধীদের আপত্তির মুখে সংসদে পাস হয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) সংশোধনী বিল, ২০২৩। গতকাল মঙ্গলবার বিলটি পাসের সময় বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে প্রার্থী হতে খেলাপিদের ছাড় দেওয়া, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়েও সমালোচনা করেন। খবর বিডিনিউজের।
তবে আইনমন্ত্রী এসব অভিযোগ নাকচ করে দাবি করেছেন, বিদ্যমান আইনের ৯১ এ অনুচ্ছেদে ভোট বন্ধের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। ইসির ক্ষমতা কমানো হয়নি বরং এ নিয়ে বিরোধীরা জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। এদিন বিকালে আইনমন্ত্রী আরপিও সংশোধনের আলোচিত বিলটি সংসদে উত্থাপন করলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর আগে বিরোধী দলের বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং তাদের আনা সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি করা হয় কণ্ঠভোটে। বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম বলেন, নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আইনের এ সংশোধনী। কিন্তু আরপিরও মধ্যে কতগুলি ক্লজ লাগানো হল– যার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন খর্ব হচ্ছে। আমরা জানি নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা করলে যে কোনো নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু এই অধিকার খর্ব করা হল। সংশোধনের পর এখন কী করা হল সেই প্রসঙ্গ তুলে তার দাবি, সেন্টারগুলো বন্ধ করতে পারবে কিন্তু পুরো নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে না। তা হলে এই ইসি কীভাবে নিরপেক্ষ নির্বাচনটা করবে, প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ফখরুল ইমাম বলেন, আইনে ইলেকশনের স্থলে পোলিং শব্দটা এনে বড় পার্থক্য করা হয়েছে। আগের দিন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধের বিধানের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিকে নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই আইনে যেটা হচ্ছে তাতে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং এই কমিশন দিয়ে নির্বাচন করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না। সংশোধনীর যে প্রস্তাবটা দেওয়া হয়েছে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা ফিরে আসার একটি পথ হতে পারে।
গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেন, আপাত দৃষ্টিতে এই আইনটি সংশোধনের উদ্দেশ্য মহৎ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দেশে আইন হয় ব্যক্তি, গোষ্টী ও সরকারের স্বার্থে। নির্বাচনের আগে এমন আইন করা হয়। তার অভিযোগ, বর্তমান সরকারের আমলে নির্বাচন ব্যবস্থা এমনভাবে ধ্বংস করা হয়েছে যে মানুষ এখন ভোট বিমুখ। যারা সরকার উৎখাতে আন্দোলন করছে তারাও এরজন্য কম দায়ি নয়। তারা এক কোটি ৩৯ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিল। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হলেও আগেরগুলোর মতো বর্তমান কমিশন সর্বকালের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তার।
জাতীয় পার্টির আরেক সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ইচ্ছা থাকলে দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনেই সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব। ইসির মানসিকতার ওপর নির্ভর করে নির্বাচন। সোজা বাংলায় তাদের মেরুদণ্ড শক্ত কি না। শত আইন করে দিলেও মেরুদণ্ডহীন লোকদের দিয়ে কিছু হবে না।
একই দলের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেন, এই আইনে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি। নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরে এসেও নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হয়নি। তার মতে, বাহাত্তারের আদেশ বহাল থাকলে ইসি শক্তিশালী হত।
তিনি বলেন, এতদিন আইনে ইলেকশন শব্দ ছিল। ইলেকশন বলতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত বোঝায়। সেটা বাদ দিয়ে পোলিং যুক্ত করা হয়েছে। এর অর্থ শুধু ‘ভোটের দিন’ বোঝানো হয়েছে বলে দাবি তার। তার ভাষ্য, ভোট বন্ধে ইসির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। তারা শুধু ভোটের দিন ভোট বন্ধ করতে পারবে।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু বলেন, তাল গাছটা আমার রেখেই আইনটা করা হয়েছে। মানুষের শঙ্কা রয়েছে আদৌ ভোটাধিকার পাবে কি না। নির্বাচনের অধিকার খর্ব করে দলীয়করণের লক্ষ্যে আইনে সংশোধন আনা হয়েছে।
বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ৯১ এ অনুচ্ছেদে যে কোনো নির্বাচনী আসনের ভোট বন্ধের ক্ষমতা রয়েছে ইসির। এরসঙ্গে ৯১ এএএ অনুচ্ছেদে সংশোধনী আনা হয়েছে। তিনি জানান, একটি আসনে ১০০–১৪০টি পোলিং সেন্টার থাকে। সেখানে বলা ছিল ৩/৪টি পোলিং সেন্টারে যদি কোনো সহিংসতা বা জরবদখল হলে সবগুলো পোলিং সেন্টারের ইলেকশন বন্ধ করে দিতে পারবে। কিন্তু সেটা গণতন্ত্রের পরিপন্থি। সেটা জনগণের ভোটাধিকারেরও পরিপন্থি। কারণ বাকিগুলোতে তো কোনো সহিংসতা বা অনিয়ম হয়নি। শুধু এ তিনটায় হয়েছে। এজন্য বলা হয়েছে– যেখানে সহিংসতা বা অনিয়ম হয়েছে সেগুলো বন্ধ হবে। আমি বুঝতে পারলাম না কেন উনারা বলছেন নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। উনাদের এই কথাটা অমূলক। এটা বিভ্রান্তিকর কথা।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হসিনার সরকার অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে জনগণকে যে অঙ্গীকার দিয়েছেন তা পালন করার জন্য সরকার সচেষ্ট। তিনি জানান, যে সংশোধনী (৯১ এএএ উপধারা) নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে সেটা ১৯৭২ এর আরপিওতে ছিল না। বর্তমান নির্বাচন কমিশন প্রথম এ সংশোধনীর প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু মন্ত্রিসভায় যখন এটা যায় তখন ‘গণতন্ত্র পরিপন্থি, ভোটাধিকার পরিপন্থি’ বলে সেই জায়য়গাটি সংশোধন করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী দাবি করেন, ব্যাংকে যেন ঋণ খেলাপিদের টাকা ফেরত আসে এবং অর্থঋণ আদালতের উদ্দেশ্য যাতে প্রতিপালিত হয় সেজন্য ওই সংশোধনী আনা হয়েছে। তাদের টাকা ফেরত দিতে উৎসাহিত করতে এটা করা হয়েছে।
আইনমন্ত্রী বলেন, একজন বলেছেন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই অন্যরকম। এটা আমি সাহসের সাথে বলতে পারি– আওয়ামী লীগ সরকারের আন্ডারে যত নির্বাচন হয়েছে। সবগুলোই কিন্তু সকল পক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে বলেছে। আপনি বলেন সংসদ নির্বাচন, আপনি বলেন সিটি করপোরেশন নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন–সব নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে গেল বছর অগাস্টে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ– আরপিও সংশোধনে একগুচ্ছ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এ নিয়ে কয়েক দফা বৈঠকের পর খসড়া চূড়ান্ত হয়। পরে নির্বাচনী আইনে এ সংশোধনের প্রস্তাব ২৮ মার্চ নীতিগত ও ১৮ মে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর ৬ জুন সংসদে বিলটি উপস্থাপন করা হয় এবং পাস হয় ৪ জুলাই।









