দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার অভিযোগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে তুলোধোনা করেছেন বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। তাঁরা ‘ব্যবসায়ী’ মন্ত্রী টিপু মুনশির বাজার সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না সেই প্রশ্নও তোলেন। কেননা, তিনি বলেছেন, ‘লক্ষ্য রাখা দরকার, (সিন্ডিকেটের হোতাদের) জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম। সেটা হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে ক্রাইসিসটা তৈরি হবে, সেটা সইতে তো আমাদের কষ্ট হবে।’ এই বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সিন্ডিকেটের পক্ষ নিয়েছেন। পরে স্বীকার করলেন, দেশের নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করছে। ‘সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা’ হিসেবে দায়ী করে তাঁর কঠোর সমালোচনার জবাব দিতে গিয়ে পত্রিকান্তরে মন্ত্রী সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব স্বীকার করে বলেন, ‘এটা ঠিক, বড় বড় গ্রুপ একসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবসা করে।’
অন্যদিকে, শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খুলনা শহীদ শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালে রোটারি ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে জড়িত সিন্ডিকেট, যা ভাঙার চেষ্টা চলছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘এই সিন্ডিকেট এক দিনে গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি সিন্ডিকেট ভাঙার। কিন্তু সিন্ডিকেট অনেক বছরের। তাই ভাঙতে সময় লাগছে। কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি ভাঙার।’ তিনি আরও বলেন, ‘মানুষ কষ্ট না পায় সেই চেষ্টা করছি। সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মানুষকে সাহায্য করার জন্য। তারই ধারাবাহিকতায় এক কোটি পরিবারকে আমরা সাশ্রয়ী দামে খাবার দিচ্ছি।’
‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের কিছুই করার নেই’ বলে যে বক্তব্যটি বাণিজ্যমন্ত্রী দিয়েছেন, তার তীব্র সমালোচনা করে বিরোধী দলের নেতারা বলেন, ‘তাঁর (বাণিজ্যমন্ত্রী) বক্তব্যে বোঝা যায় যে আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে না। আপনাদের কিছুই করার নেই তাহলে দেশ চালায় কে? কর্মহীনতা, অর্ধাহার, অনাহারক্লিষ্ট দেশবাসীর প্রতি মন্ত্রীর এই বক্তব্য নিষ্ঠুর রসিকতা।’
আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া এখন নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা। তাঁরা বলেছেন, বাজারের নৈরাজ্য আর মুনাফাখোর সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে শ্রমজীবী, স্বল্পআয়ের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। ব্যবসায়ীদের খামখেয়ালিতে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত, শ্রমজীবী–মেহনতি মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার।
চাল ও তেলসহ সব নিত্যপণ্যের দাম দফায় দফায় বাড়ছে। এতে মানুষের জীবনে চরম সংকট নেমে এসেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে এই সামর্থ্যহীনতার দায় সরকারের নেওয়া ছাড়া গতি নেই। তাঁরা ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। উপরন্তু করের আওতা বাড়িয়ে জনগণের ভোগান্তি আরও বাড়ানো হয়েছে। সবচেয়ে বিপদে আছেন শ্রমজীবী মানুষ। তাঁদের আয়ও বাড়েনি। কিন্তু খরচ বেড়েছে অনেক বেশি।
বিশ্লেষকরা বলেন, বাস্তব সত্য হচ্ছে, বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পরিপূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। ফলে হঠাৎ করে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণের সরকারি সিদ্ধান্ত পুরোপুরি দায়িত্বহীন ও জনগণের ওপর নতুন গজবের সামিল। চিনি বাজার থেকে প্রায় উধাও। পেঁয়াজ–রসুনসহ প্রতিটি ভোগ্যপণ্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে।
এমন প্রেক্ষাপটে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের বাজারে সরকারের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির অভিযোগ তুলছেন অনেকেই। সরকার কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে, সেই প্রশ্নও আসছে। তবে ব্যবসায়ী নেতাদের অনেকে বলছেন, মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে কোন পণ্যের চাহিদা এবং যোগানের ওপর তার বাজার নির্ভর করে, সেখানে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ঘাটতি পর্যালোচনা করে তাতে যোগান দেয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ আগাম পরিকল্পনার মাধ্যমে বাজারে হস্তক্ষেপ করবে। এই ব্যবস্থাপনাতেই ঘাটতি আছে বলে তাঁরা মনে করেন। তাঁরা বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতি এই নয় যে ব্যবসায়ীর ওপর সব ছেড়ে দেবো, যা হওয়ার তাই হোক, তা তো হতে পারে না। সরকারকে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবশ্যই রাখতে হবে।
তাঁরা বলেন, গত কয়েক দিনের মধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রীর মূল্য নিয়ন্ত্রহীন হয়ে পড়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে কাজ করছে অনেক অসাধু সিন্ডিকেট ব্যবসায়ী। সরকারকে এই অসাধু সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। সরকার বিভিন্ন পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরেও সেটা মানা হচ্ছে না। বিক্রেতারা নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে পণ্য বিক্রি করছে। অসাধু বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে তাঁরা মন্তব্য করেন। তাঁরা বলেন, টিসিবির দ্রব্য সামগ্রী আরও সঠিকভাবে ও ব্যাপকহারে দেশব্যাপী বিতরণ করতে সরকারের উদ্যোগ জোরদার করতে হবে।