(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
চীনের মহাপ্রাচীরের ওপর কিলবিল করছিল মানুষ। নানা দেশের নানাজাতের শত শত মানুষ উচ্ছ্বসিত এই প্রাচীর দেখে। আমিও মনভরে দেখছিলাম চারদিক। ঘুরছিলাম প্রাচীরের এদিক ওদিক। কষ্ট করে হলেও হাঁটছিলাম। কখনো কখনো কিছুটা দৌড়ানোরও চেষ্টা করছিলাম। পাহাড়ে চড়ার সময় একটু দৌড়ের উপর থাকলে শরীরে বাড়তি শক্তি জুটে! সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভেঙ্গে এগুচ্ছিলাম এখানে–ওখানে।
আমার মন ভরে যাচ্ছিল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম এই মহাপ্রাচীর দেখে। কিন্তু আমার মাথায় ঢুকছিল না যে কি করে এই প্রাচীরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি যে মানুষের হাতে তৈরি একটি স্থাপনা তাতে কারো কোন সন্দেহ নেই। চীনের মানুষই এই মহাপ্রাচীর নির্মাণ করেছে। কিন্তু পাহাড়ের এত উপরে কি করে এত শক্ত প্রাচীরটি নির্মাণ করা হলো! এতগুলো পাথর কোত্থেকে আনা হলো, এত কষ্ট করে এত পাথর যোগাড় করাও কী চাট্টিখানি ব্যাপার ছিল!! মহাপ্রাচীরের উচ্চতা ৫ থেকে ৮ মিটার বা ১৪ ফুট থেকে সাড়ে ২৬ ফুট। পাহাড়ের এত উচ্চতায় এসে এত উঁচু দেয়ালটি কি করে নির্মাণ করা হয়েছিল!
শুধু কি উচ্চতা! এটি পুরুত্ব বা প্রস্থে ৩২ মিটার বা প্রায় ১০৫ ফুট! ১০৫ ফুট চওড়া ২৬ ফুট উঁচু একটি পাথরের স্তুপ। পাথরগুলোও সুন্দরভাবে কেটে কুটে সাইজ করে বসানো। কোন এবড়ো থেবড়ো নয়। কি সাংঘাতিক অবস্থা। আধুনিক প্রযুক্তিকে হয়তো এরূপ দেয়াল নির্মাণ মোটেই কঠিন নয়, কিন্তু শত শত বছর আগে? আমার মাথায় ঢুকছিল না। পিরামিডের সামনে দাঁড়িয়েও আমি এমনতর নানা প্রশ্নের উত্তর পাইনি।
গ্রেটওয়ালের যেই স্থানটিতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সেটি পুরোপুরি পাহাড়ী অঞ্চল। দস্যুদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সুউচ্চ পাহাড়ের উপরই গ্রেটওয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা এই গ্রেটওয়ালের পুরোটা পাহাড়ী অঞ্চল কিনা তা আমার জানা নেই। তবে যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেখানে মাইলের পর মাইল শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আর পাহাড়ের চূড়ায় ১০৫ ফুট চওড়া রাস্তার মতো গ্রেটওয়াল। পাহাড়সহ কোথাও কোথাও গ্রেটওয়ালের উচ্চতা প্রায় ৮৮৮ মিটার বা ২৯১৩ ফুট! আমরা লিফটে এবং ক্যাবল কারে চড়ে এই উচ্চতা মাড়িয়ে গ্রেটওয়ালের উপর পৌঁছে গেছি! এখন হাঁটছি, দৌড়াচ্ছি!
মন ভরে গ্রেটওয়াল দেখা বলতে যা বুঝায় ঠিক সেভাবেই দেখছিলাম। আমাদের গাইড হাত ইশারায় সবাইকে জড়ো করলেন। তিনি এবার ফিরতে হবে বলে উল্লেখ করে বললেন, শহর থেকে আমরা বেশ দূরে চলে এসেছি। এখন না ফিরলে রাত নেমে যাবে। তাছাড়া লাঞ্চেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। তিনি মজা করে বললেন, ক্ষুধা লেগেছে। তিনি সকলকে শেষবারের মতো চীনের এই মহাকীর্তি দেখে ফিরতি পথ ধরার আহ্বান জানালেন।
সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। গাইডের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। অল্পক্ষণের মধ্যে আমরা ক্যাবল কার স্টেশনের দিকে রওয়ানা হলাম। পাহাড়ের শীর্ষ থেকে ক্যাবল কারে চড়ে আমাদের নিচে নামতে হবে। কারে চড়ে আমাদেরকে প্রথমে একটি ভবনে পৌঁছানো হবে। ওখান থেকে লিফটে নেমে কিছু পথ পায়ে হেঁটে চড়বো বাসে। ওই বাস প্রায় ৭০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমাদেরকে বেইজিং শহরে নিয়ে আসবে। ফেরার সময় বেজায় ভিড় ক্যাবল কার স্টেশনে। প্রচুর লোক। লাইন ধরে সিরিয়াল করে আমাদেরকে ক্যাবল কারে তোলা হচ্ছিল। একটি বক্সে চারজন। সুউচ্চ পাহাড়ের উপর দিয়ে কাচের বক্সে চড়ে নিচে নামছিলাম আমরা। সবুজে সবুজে একাকার চারদিক। পাহাড়ের পর পাহাড়ে বিস্তৃত চোখজুড়ানো বন–বনানী। নিচে নেমে আসার অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের বাস হাজির হলো।
গাড়ি চলছিল। খুব বেশি গতি নেই। বেশ ধীরস্থির ভাবে চলছিল আমাদের বাস। কিছুপথ আসার পর বাসের গতি আরো কমে গেলো। ইন্ডিকেটরের শব্দও শোনা গেলো। আমি বুঝতে পারলাম যে, লাঞ্চের জন্য বাস থামানো হচ্ছে। কিন্তু কোথায় যে কী লাঞ্চ করানো হবে কে জানে! ছোটখাটো একটি চত্বরে বাসটি থেমে গেলো। স্বয়ংক্রীয়ভাবে খুলে গেলো দরোজা। গাইড মিজ শিন চেন বললেন, এখন আমরা লাঞ্চ করবো। তবে আজ আমরা কোন রেস্টুরেন্টে বসে খাবো না। ফাস্টফুড খাবো। আমি খেয়াল করে দেখলাম যে, চত্বরটির পাশে অনেকগুলো খাবারের দোকান, অনেকটা ফুডকোট টাইপের। ছোট ছোট দোকান। প্রতিটি দোকানের দেয়ালে, শোকেসের গ্লাসে নানা ধরনের খাবারের ছবি। মিজ শিন চেন ম্যাকডোনাল্ডস টাইপের একটি দোকানের সামনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে বললেন, আমরা বার্গার স্যান্ডউইশ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এবং কোল্ড ড্রিংকস দিয়ে লাঞ্চ করবো। এরা বিভিন্ন ধরনের বার্গার করে। আপনারা আপনাদের পছন্দানুযায়ী বার্গার বা স্যান্ডউইশ অর্ডার করতে পারবেন। আমার ভিতরে মুছড়ানো শুরু হলো। সাপের নাকি ব্যাঙের বার্গার কে জানে! না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আশপাশে চোখ বুলিয়ে কোথাও কোন ফলের দোকান আছে কিনা দেখতে লাগলাম। মিজ শিন চেন কিছু বুঝলো কিনা কে জানে। তিনি আমার কাছে আসলেন। বললেন, এখানে বার্গারের বিভিন্ন ভ্যারাইটি আছে। ফিশ বার্গারও আছে, ভেজিটেবল দিয়েও এরা সুন্দর বার্গার করে। আপনি আপনার মতো করে অর্ডার করতে পারেন। ম্যাকডোনাল্ডসে ফিশ বার্গার খুবই জনপ্রিয়। ওরা টুনা ফিশ দিয়ে বার্গার করে। মিজ শিন চেনের কথা শুনে আমার পরাণে পানি আসলো। আমি দোকানটির ক্যাশে গেলাম। অর্ডার নিচ্ছিলেন যে তরুণী তাকে কি কি বার্গার আছে জানতে চাইলাম। তিনি আমার দিকে একটি ম্যানু কার্ড বাড়িয়ে দিলেন। চাইনিজ লেখা! কি যে যন্ত্রণা। চীনের গ্রেটওয়ালের কাছে পর্যটকমুখর একটি স্থানে ফাস্টফুডের ম্যানু যদি চীনা ভাষায় হয় তাহলে মানুষ যাবে কোথায়!
এখানে একটি কথা বলা যায় যে, চীনারা ইংরেজি কিংবা অন্য ভাষার ধার ধারে না। তাদের সাথে ব্যবসা করতে হলে চীনা ভাষা শিখে করতে হবে। তাদের খাবার খেতে হলেও চীনা ভাষায় অর্ডার করতে হবে। ব্যবসা করবেন আপনি, খাবার খাবেন আপনি তাই প্রবলেম আপনার। ভাষা আপনাকেই শিখতে হবে। আপনার ভাষা শিখে আপনার সাথে ব্যবসা করা কিংবা আপনাকে কিছু খাওয়ানোর দায় চীনাদের নেই। এতে করে পৃথিবীর উন্নত বিশ্বেরও হাজার হাজার মানুষ চীনা ভাষা শিখেই চীনে ব্যবসা বাণিজ্য করছে। চীনারা ইংরেজি শিখে ইংরেজদের সাথে কোন বেসাতি করেনি! চীনারা তাদের মায়ের ভাষাকে ভিন্ন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, যা রক্ত দিয়ে অর্জন করেও আমাদের মার্তৃভাষার জন্য আমরা করতে পারিনি।
চাইনিজ ভাষার ম্যানুকার্ড নিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ডাকলাম মিজ শিন চেনকে। তাকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমি একটি ফিশ বার্গার চাই। আমার হয়ে তিনি অনুবাদ করে তরুণীকে বুঝিয়ে দিলেন। তরুণী আমার অর্ডার কনফার্ম করলেন। অর্ডার কনফার্ম হলেও ভিতরে ভিতরে বেশ সংশয়ে ছিলাম যে, মিজ শিন চেন যা বলেছেন তা ঠিকঠাকভাবে তরুণী বুঝতে পেরেছেন কিনা। কিংবা শিন চেন ঠিকঠাকভাবে বলেছেন কিনা। এখন মাছের পরিবর্তে যদি ব্যাঙের বার্গার আসে! অল্পক্ষণের মধ্যে আমাদের সবাইকে বার্গার দেয়া হলো। সাথে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই।
ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিরীহ খাবার। আলু ভাজা। তাই এটি নিয়ে খুব একটা চিন্তা নেই। তবে বার্গারের ভিতরের টুকরাটি মাছের নাকি ব্যাঙের সেটি বুঝতে পারলাম না। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খাচ্ছিলাম আমি, টেবিলে অনাদরে পড়েছিল বার্গার। আমার সংশয়ের ব্যাপারটি শিন চেন বুঝতে পেরেছিলেন কিনা কে জানে। তিনি আমার কাছে এসে বসলেন। বললেন, আমিও ফিশ বার্গার নিয়েছি। এদের ফিশ বার্গার খুবই ভালো। সামুদ্রিক মাছ দিয়ে করে, বেশ মজা। শিন চেন নিজে বেশ আলতো করে বার্গারে কামড় দিচ্ছিলেন। আমার সংশয় ভাব উবে গেলো। বার্গারে কামড় দিলাম। বাহ, দারুণতো! মাছের স্বাদ একেবারে স্পষ্ট! (চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী