লিঙ্গ সমতার বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের ১২ ধাপ অবস্থানের উন্নতি হয়েছে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬ দেশের মধ্যে ৫৯তম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম–ডব্লিউইএফের ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ নামের রিপোর্ট থেকে জানা যায় এ তথ্য। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রতি বছর ‘গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ’ নামে এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে থাকে। ডব্লিউইএফ জেনেভা থেকে ২০২৩ সালের যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে এ বছর বাংলাদেশের স্কোর শূন্য দশমিক ৭২২। গত বছর শূন্য দশমিক ৭১৪ স্কোর ছিল। স্কোর নির্ধারণের ক্ষেত্রে শূন্য হলো সর্বনিম্ন এবং এক হলো সর্বোচ্চ। গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৭১তম। আর এ বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬ দেশের মধ্যে ৫৯তম। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার চেয়ে ভালো করছে। এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের উপসূচকে এ দেশ অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে। এবার এই উপসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। গত বছর ছিল নবম।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের স্কোর দক্ষিণ এশিয়ায় এবারও সর্বোচ্চ। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয়, অনেক উন্নত দেশও বাংলাদেশের চেয়ে পিছিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভুটান রয়েছে দ্বিতীয়, যার অবস্থান ১০৩তম। এর পর শ্রীলঙ্কা ১১৫তম। যথাক্রমে নেপাল ১১৬তম, মালদ্বীপ ১২৪তম, ভারত ১২৭তম, পাকিস্তান ১৪২তম এবং আফগানিস্তান ১৪৬তম। বৈশ্বিকভাবে শীর্ষ ৫টি দেশের মধ্যে রয়েছে– আইসল্যান্ড, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে ও সুইডেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে সরকারপ্রধান নারী থাকায় এবং জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন থাকায় রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের সমতার দিক থেকে অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী। তবে সেই অনুপাতে স্কোর খুব বেশি নয়। শূন্য দশমিক ৫৫২ স্কোর নিয়েও বাংলাদেশ ওপরের দিকের অবস্থানে থাকার কারণ হলো, অন্য অনেক দেশের স্কোর আরও কম। মাত্র ১২টি দেশের স্কোর ৫৫ শতাংশের বেশি। ৬৭টি দেশে গত ৫০ বছরে রাষ্ট্রপ্রধান নারী ছিলেন না। বৈশ্বিকভাবে লিঙ্গ বৈষম্য পরিস্থিতির কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। তবে তা সামান্য। গত বছরের চেয়ে মাত্র শূন্য দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট স্কোর বেড়েছে।
ক্ষমতায়নের জন্য শ্রমশক্তিতে এবং নেতৃত্ব, ব্যবসা ও সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
আমাদের অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, বাংলাদেশে শিক্ষায় নারীর অগ্রগতি লক্ষ্যণীয়। তাদের সুযোগ অনেক বেড়েছে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছেলেশিশুর চেয়ে মেয়েশিশু বেশি। পাবলিক পরীক্ষা ও উচ্চশিক্ষায়ও অনেক সময় ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা ভালো ফলাফল করে। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয়, কর্মক্ষেত্রে তেমন এগিয়ে নয় এরা। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাতেই বেশি পরিলক্ষিত হয়। অন্যান্য আরও ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে ঠিকই। কিন্তু আশানুরূপ নয়। এজন্য অংশগ্রহণ আরও বেশি হওয়া উচিত। আরো উল্লেখ্য, গড় আয়ুতে মেয়েরা একসময় পুরুষের চেয়ে বেশ এগিয়ে থাকলেও করোনার কারণে সেটি কিছুটা কমেছে।
বিশ্লেষকরা বলেন, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাদের অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া, নারীর জীবনের মূল্য পুরুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে কম নয়, সমান। সৃষ্টিকর্তার কাছেও নারী–পুরুষের মর্যাদা সমান। ধর্মীয় বিধান মতেও তাই। সর্বোপরি বর্তমানে নারীরা কর্মের কোনো ক্ষেত্রেই পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে নেই। যেখানেই নারীরা সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক নারীর অবদান ও ত্যাগ পুরুষের চেয়ে বেশি। সর্বোপরি বর্তমানে সভ্যতা নির্ণয়ের ভিত্তি হচ্ছে নারীর শিক্ষা, ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তা। এসব যে দেশে যত বেশি, সে তত বেশি সভ্য। তাই নারীদের মৌলিক অধিকারসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে এবং নির্যাতন ও হত্যা করে বিশ্বের কোথাও কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও উন্নতি সম্ভব নয়। তাঁরা বলেন, ‘তিন দশক ধরে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী পদে নারী থাকলেও রাষ্ট্র ও সমাজের চরিত্রটি এখনো পুরুষতান্ত্রিক। কেবল পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে নারী–পুরুষের সম–অংশীদারত্বের মাধ্যমেই জেন্ডার সমতা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে’।
জেন্ডার সমতায় বাংলাদেশের অগ্রগতিতে আমরা আনন্দিত। এ ধারা অব্যাহত রাখতে কাজ করতে হবে। তবে সমাজে নারী নির্যাতনের যে চিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করি, তা দূর করতে হবে। দূর করতে হবে বৈষম্য, আইনগতভাবেই। সে লক্ষ্যে পুরুষদেরও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীদের হতে হবে সর্বাধিক সোচ্চার।