ঐতিহাসিক ২৩ জুন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৭৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এই দলটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম পুরাতন, সবচেয়ে বৃহৎ, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রগতিপন্থী গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যবাদী একটি রাজনৈতিক সংগঠন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সফল নেতৃত্বদানকারী এখনো এই দলটি সগৌরবে পরিচালিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের ক্ষমতায় সুনামের সঙ্গে দীর্ঘদিন টিকে আছে।
কালের যাত্রায় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নে এই রাজনৈতিক দলের যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন তারিখে প্রতিষ্ঠালগ্নে দলটির নামকরণ করা হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। বলা বাহুল্য, ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় ছাড়া পাশাপাশি সময়ে আরও দুটি ঘটনা বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকে ত্বরান্বিত করেছিল– এর একটি হলো, ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার এবং অপরটি, একই মাসে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগের প্রার্থীর পরাজয়।
১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল তারিখে টাঙ্গাইলে পূর্ব বাংলার প্রথম উপ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ থেকে টাঙ্গাইলের প্রখ্যাত জমিদার পন্নী সাহেব প্রার্থী হলেন। তাঁর বিপক্ষে প্রার্থী হলেন শামসুল হক। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে অথবা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে টাঙ্গাইলে উপনির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছিলো। আমরা ঠিক করলাম, শামসুল হক সাহেবকে অনুরোধ করবো মুসলিম লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়তে। শামসুল হক সাহেব শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন, কিন্তু টাকা পাওয়া যাবে কোথায়? হক সাহেবেরও টাকা নেই, আর আমাদেরও টাকা নেই। তবু যেই কথা সেই কাজ। শামসুল হক সাহেব টাঙ্গাইলে চলে গেলেন, আমরা যে যা পারি জোগাড় করতে চেষ্টা করলাম। কয়েক শত টাকার বেশি জোগাড় করা সম্ভব হয়ে উঠল না। ছাত্র ও কর্মীরা ঘড়ি, কলম বিক্রি করেও কিছু টাকা দিয়েছিলো।’ চলতে থাকলো তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। শেষ পর্যন্ত এই উপ নির্বাচনে শামসুল হক বিপুল ভোটের ব্যবধানে পন্নীকে পরাজিত করেন। অতঃপর শামসুল হককে টাঙ্গাইল ‘বিজয়ী বীর’ খেতাবে ভূষিত করা হয় এবং এ বিজয় মুসলিম লীগের পরাজয় এবং ভাঙন হিসেবে কাজ করে।
আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৫০ মোগলটুলীর ইতিহাস। এই অফিসকে কেন্দ্র করেই হাশিম–সোহরাওয়ার্দী জোট সমর্থক প্রগতিশীল মুসলিম লীগের তরুণ ও ছাত্রকর্মীবৃন্দ কলকাতা ও অন্যান্য স্থান হতে একত্রিত হতে থাকেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও শামসুল হক এবং মোগলটুলী অফিসের বিবরণ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,‘১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে প্রথমে উঠব ঠিক করলাম। শওকত মিয়া মোগলটুলী অফিসের দেখাশোনা করে। মুসলিম লীগের পুরানা কর্মী। আমার বন্ধুও। শামসুল হক সাহেব ওখানেই থাকেন। মুসলিম লীগ ও অন্যান্য দলের কর্মীদের সভা ডেকেছেন শামসুল হক সাহেব– রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে।’ এভাবে দলটির প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক প্রাথমিক পর্যায়ে ছাত্র যুব সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। পাশাপাশি ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, মফস্বলের তরুণ আইনজীবী, ব্যবসায়ী শ্রেণিকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে তাঁরা ঢাকা সহ পূর্ব বাংলার নানা এলাকা সফর করেন। বলা বাহুল্য সেই ১৯৪৮ সালে যখন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংঘটিত হচ্ছে, এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক প্রমুখদের নিয়ে পূর্ব বাংলা সফর করছেন তখন ঢাকায় পাকিস্তান পুলিশের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ শেখ মুজিবের নামে একটি ফাইল খোলেন। পাকিস্তানি আমলের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সামপ্রতিক সময়ে প্রকাশিত ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অফ দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ বইয়ে এই জনসভাগুলোর বিবরণ পাওয়া যায়।
২.
আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ শে জুন তারিখে কর্মী সম্মেলনের আহবান করা হয়। স্থান নির্বাচিত হয় কে এম দাস লেনের ‘রোজ গার্ডেনে’। এটি অবশ্য তখন হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি নামে পরিচিত ছিল। ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন এই দলের যখন কর্মী সম্মেলন হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। ফলে তাঁকে দলের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়। সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন যথাক্রমে আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শামসুল হক।
সম্মেলনে শামসুল হক ‘মূল দাবি’ নামে একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বিবেচনার জন্য তা পেশ করেন। পরে কিছু পরিবর্তন–পরিমার্জন করে খসড়া ম্যানিফেস্টো আকারে তা গৃহীত হয়। সম্মেলনের কিছুদিন পরে কারাগার থেকে বের হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাসানী এবং শামসুল হককে নিয়ে সদ্যগঠিত দলটিতে কৃষক শ্রমিক, ছাত্র যুব সমাজকে সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে তাঁরা ঢাকা সহ পূর্ব বাংলার নানা এলাকা সফর করেন। এই সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিস ঢাকার ১৫০ মোগলটুলি থেকে নবাবপুর নিয়ে আসা হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে এই অফিসের বিবরণ পাওয়া যায়। যেমন– ‘আওয়ামী লীগ অফিসে যেয়ে দেখি একখানা টেবিল, দুই তিনখানা চেয়ার, একটা লম্বা টুল। প্রফেসর কামরুজ্জামান অফিসে বসেন। একটা ছেলে রাখা হয়েছে, যাকে অফিস পিয়ন বলা যেতে পারে। শামসুল হক সাহেব জেলে। আমি জয়েন্ট সেক্রেটারি। ওয়ার্কিং কমিটির সভা ডাকলাম। তাতে যে বার–তেরজন সদস্য উপস্থিত ছিলেন তারা আমাকে এ্যাকটিং জেনারেল সেক্রেটারি করে প্রতিষ্ঠানের ভার দিলেন। আতাউর রহমান সাহেব অন্যতম সহ–সভাপতি ছিলেন, তিনি সভাপতিত্ব করলেন।’
১৯৫২ সালের পর বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলায় জেলায় সভা করার জন্য প্রোগ্রাম শুরু করলেন। ভাসানী তখন হাসপাতালে। এই সময় তিনি যাদেরকে নিয়ে জেলা কমিটির কাজে ঢাকার বাইরে যেতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আতাউর রহমান খান এবং আবদুস সালাম খান। এছাড়াও বিভিন্ন জেলায় যাঁরা সংগঠন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে দিনাজপুরে রহিমুদ্দিন, পাবনায় ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুর রব বগা মিয়া, খুলনায় শেখ আবদুল আজিজ এবং মমিনুদ্দিন, ময়মনসিংহে আবুল মনসুর আহমদ, হাশিম উদ্দিন, রফিকুদ্দিন ভূইয়া, হাতেম আলী তালুকদার, নোয়াখালীতে আবদুল জব্বার খদ্দর, চট্টগ্রামে এম এ আজিজ, মোজাফ্ফর আহম্মদ, জহুর আহমদ চৌধুরী, কুমিল্লায় আবদুর রহমান খান, লাল মিঞা ও খন্দকার মোশতাক আহমদ প্রমুখ। এভাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যে সিলেট থেকে শুরু করে দিনাজপুর এবং বগুড়া থেকে বরিশাল প্রত্যেকটা জেলায়ই আওয়ামী লীগ কর্মীরা সভার আয়োজন করেছিল। প্রায় প্রত্যেকটা মহকুমায় ও জেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে উঠে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব প্রায় প্রতিটি জনসভায় উপস্থিত থাকায় সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেলা। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল।
একথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিশাল অবদান রয়েছে। সংগঠনটি বিকশিত হতে শুরু করে ভাষা আন্দোলনের পর পরই। ভাষা আন্দোলনের কারণে নিগৃহীত রাজনৈতিক ও ছাত্রকর্মীরা ১৯৫৩ সালের প্রথম দিকে মুক্তি পেতে শুরু করে। যদিও শামসুল হক সাহেব এই সময় মুক্তি পেলেন, কিন্তু তখন তিনি অসুস্থ। তার অসুস্থতার কারণে তিনি জেনারেল সেক্রেটারির কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করলেন। এই সময় মুসলিম লীগ ও মুসলিম লীগ সরকার দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলছিল। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন শুধু সুষ্ঠু নেতৃত্ব ও সুশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। এছাড়াও গণমানুষের সম্পৃক্ততার জন্য দলটির অসামপ্রদায়িকীকরণও প্রয়োজন। ফলে বঙ্গবন্ধু ভাসানী এবং আতাউর রহমান খানের সঙ্গে পরামর্শ করে কাউন্সিল করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৫৫ সালের ২১–২২ অক্টোবর তারিখে পুরান ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হলো। এই কাউন্সিল অধিবেশনেই আওয়ামী মুসলিম লীগ নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে করা হলো ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। শুরু হলো অসামপ্রদায়িক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের অগ্রযাত্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে দলটির নাম থেকে পূর্ব পাকিস্তান শব্দটিও বাদ দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় থেকে সর্বত্র ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামে দেশে এবং বিদেশে পরিচিত পেতে থাকে। মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগের যে উত্থান ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন শুরু হয়েছিল তা আজও সকল শ্রেণির মানুষের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে আছে।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাক্তন উপ উপাচার্য, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়