বিএনপি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা বাংলাদেশকে বিদেশিদের কাছে বন্ধক দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায় কি–না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বুধবার সুইজারল্যান্ড ও কাতার সফর নিয়ে গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, এখনও যদি বলি যে, না, ওই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বা আমাদের দেশ কাউকে লিজ দেব, তাহলে আমার ক্ষমতায় থাকার কোনো অসুবিধা নাই, আমি জানি সেটা। কিন্তু আমার দ্বারা সেটা হবে না। সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ‘নষ্ট’ করার জন্য এই সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে আন্দোলন করা বিএনপিকে দায়ী করেছেন। বলেছেন, উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে। এখন নির্বাচন তার আলোকেই হবে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো গণতান্ত্রিক ধারাকে নষ্ট করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিরোধী দলগুলো ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের ধরপাকড় ও জরুরি অবস্থায় ফিরে যেতে চায় কি না, সে প্রশ্নও তিনি রেখেছেন। বলেছেন, সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী আগামী সাধারণ নির্বাচন যথাসময়েই অনুষ্ঠিত হবে। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং এ নিয়ে সরকারের চেষ্টা নিয়েও কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, মানুষ দুবেলা পেট ভরে ভাত খাচ্ছে। এত ইনফ্লেশনের মধ্যেও মানুষের খাবারের অভাব তো ওভাবে হচ্ছে না। হ্যাঁ, একটু চাপে আছে মানুষ, আমি জানি। সেই কষ্টটা আমি বুঝি। বুঝি বলেই আমাদের প্রচেষ্টা আছে, মানুষের দুঃখকষ্ট সহজ করার চেষ্টা করছি। পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ে– কিছু লোক মজুদদারি করে, ইচ্ছা করে দাম বাড়ায়। এরকম যারা রোলিং করে, মজুদদারি করে, কালোবাজারি করার চেষ্টা করে, অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে, ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি।
নৌকা প্রতীকে লড়তে যারা প্রার্থী হবেন, তাদের মধ্য থেকে সবথেকে ভালো প্রার্থীকেই বেছে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন, আওয়ামী লীগ সবসময় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে বলেই আজকে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছি। (গণতন্ত্র) ফিরিয়ে এনেছি বলেই গণতান্ত্রিক পরিবেশে ইলেকশন হবে, অনেকেই তো প্রার্থী হতে পারে। প্রার্থী যদি হয়, শত ফুল ফুটতে দিন, যে ফুলটি সব থেকে সুন্দর সেটি আমি বেছে নেব। আমার উত্তর পরিষ্কার। খবর বিডিনিউজ ও বাসসের।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে কাউকে খেলতে দেওয়া হবে না। আমার দেশের মাটি ব্যবহার করে কোনো জায়গায় কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবে, কাউকে অ্যাটাক করবে বা এ ধরনের কাজ– আমরা হতে দেব না। আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি, আমরা শান্তিপূর্ণ সহযোগিতায় বিশ্বাস করি। কিছু কিছু তো আছে, আমি আগে বললাম অন্য দেশের তাবেদারি করবে… দেশের মাটি ব্যবহার করে অন্য দেশে আক্রমণ করবে, আমার দেশকে নিয়ে খেলবে, এটাতো আমি অন্তত হতে দিতে পারি না। এটা তো আমি হতে দেব না।
আওয়ামী লীগ সভাপতি অভিযোগ করেন, ২০০১ সালে বিএনপি গ্যাস বিক্রি করার মুচলেকা দিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। তিনি প্রশ্ন রাখেন, এখন তারা দেশ বিক্রি করবে, নাকি সেন্ট মার্টিন দ্বীপ বিক্রি করার মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় আসতে চায়? আমি তো এটুকু বলতে পারি যে, আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের কন্যা। আমার হাত থেকে এদেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে আমি ক্ষমতায় আসতে চাই না। ওই গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিলে আমিও ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।
বাংলাদেশে নির্বাচন বাধাগ্রস্তকারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে লেখা ছয় মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের চিঠির বিষয়টি ইঙ্গিত করেও কথা বলেন শেখ হাসিনা। সেই চিঠিতে দাবি করা হয়, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা চাপে আছে। তাদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মনে করি, দেশের মানুষকে সচেতন হতে হবে। ঠিক যেভাবে আমাদের হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সম্প্রদায় প্রতিবাদ করেছে। বলেছে যে, না, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভুয়া তথ্য, সেভাবে সকলকে সোচ্চার হতে হবে। নির্বাচন যত কাছে আসবে, তত বেশি বেশি পরিমাণে এ ধরনের অপপ্রচার চালবে বলেও মনে করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, মানুষকে তারা বিভ্রান্ত করছে এটা ঠিক। কাজেই আমি দেশবাসীকে বলব এ সমস্ত অপপ্রচারে কান দেবেন না, বিভ্রান্ত হবেন না। এরা বলতেই থাকবে, যত ইলেকশন সামনে আসবে আরও বেশি বলবে। কিন্তু নিজেদের মনে নিজে প্রশ্ন করতে হবে, আসলে ভালো আছেন কি–না, দেশটা ভালো চলছে কি–না, দেশটা এগোচ্ছে কি–না, দেশটার আরও উন্নতি হবে কি–না।
সংবাদ সম্মেলনে একজন গণমাধ্যমকর্মী প্রশ্ন রাখেন রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়েও। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার থেকে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী এলেও শান্তির নীতিতে চলার কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো ঝগড়া করেনি। তিনি বলেন, আমরা সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়– এই নীতিতে বিশ্বাস করি, সেভাবে আমরা মেনে চলব।
সাংবাদিকদের একটি প্রশ্ন ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপির দাবির বিষয়ে। এ সরকার ব্যবস্থা ছাড়া দলটি ভোটে অংশ না নেওয়ার, এমনকি ভোট হতে না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্বাচনকালীন সময়ে আমাদের বিরোধী দল থেকে নানা রকম প্রস্তাব– এখন আবার তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কে খালেদা জিয়ারই উক্তি ছিল যে, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়। একবার যেটা তারাই বাদ দিয়েছে, এই পদ্ধতিটা তারাই নষ্ট করেছে, তারাই কিন্তু এটা রাখেনি, সেটাকে আবার তারা ফেরত চাচ্ছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে আদালতের রায়ের কথাও স্মরণ করিয়ে দেন আওয়ামী লীগ প্রধান। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায় আছে এবং সেই মোতাবেক আমাদের সংবিধানও সংশোধন করা হয়েছে যে, একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বা সরকার প্রধান আরেকজন নির্বাচিত সরকার প্রধান দ্বারাই প্রতিস্থাপিত হবেন। এর বাইরে অনির্বাচিত কেউ আসতে পারবে না।
বিরোধী দলগুলোকে উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা (বিএনপি) কি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা চান? অর্থনৈতিক উন্নতি চান? দেশের মানুষের কল্যাণ হোক সেটা চান? নাকি আবার সেই ২০০৭–এর মত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, আবার সেই ইমার্জেন্সি, আবার সেই ধরপাকড় সেইগুলি চায়? এটা তো দেশের মানুষকে বিবেচনা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, উচ্চ আদালতের রায়ের বিষয়টি জেনেও বিএনপির আন্দোলনের উদ্দেশ্যটা হল অসাংবিধানিক সরকার আনা। তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের গণতন্ত্রটা ওয়েস্ট মিনস্টার টাইপ অব ডেমোক্রেসি, ঠিক ইংল্যান্ডের মত জায়গায় যেভাবে নির্বাচনটা হয়, ঠিক সেভাবে আমাদের এখানে নির্বাচন হবে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘাত হচ্ছে, অনেক পেশার অবসরপ্রাপ্ত অনেকে নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নের কোনো বার্তা দেবেন কিনা, প্রধানমন্ত্রীকে এই প্রশ্ন করেন একজন সাংবাদিক। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাভাবিকভাবে সামনে ইলেকশন আসলে প্রার্থী হবার জন্য অনেকেরই আকাঙ্ক্ষা থাকবে, এতে তো কোনো সন্দেহ নেই। আর নির্বাচন যখন হবে, কাকে প্রার্থী করা হবে, কাকে প্রার্থী করা হবে না, এটা তো আমাদের দলেরও একটা লক্ষ্য থাকে।