চন্দ্র মাসের ৩০ জিলকদ হযরত শাহ আমানত (রহ.)র ওফাত বার্ষিকী। চট্টগ্রাম মহানগরীর কেন্দ্রস্থলে লালদীঘির পূর্ব দিকে এ মহান পীর সূফি দরবেশ শায়িত রয়েছেন। তাঁর মাজারে প্রতিনিয়ত যেয়ারতকারীর সমাগম হয়। তাঁর একটি কারামত বহুল প্রচারিত। আর তা হল: আদালত ভবনে একব্যক্তির উপকার করতে দলিল এনে দেয়া।
আজ থেকে ৫০/৬০ বছর বা তারও আগে মহান পীর সূফি অলি দরবেশগণের অসংখ্য কারামত প্রকাশ, যা বাস্তব সত্য। একালে দুনিয়া কামাইয়ের জন্য ভন্ড পীর সূফি দরবেশের কমতি নেই, ফলে তাসাউফ জগত আজ অত্যধিক কলুষিত। এ জগতের উপর ভর করে দুনিয়া কামাইয়ের প্রতিযোগিতা চলমান।
হযরত শাহ আমানত (রহ.) তাসাউফ জগতের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি তরিকত জগতের একজন মহান পীর। তাঁর এ প্রচার মনে হয় তুলনামূলক কম। হযরত শাহ আমানত (রহ.)র পীর হচ্ছেন পুরাতন ঢাকার লক্ষীবাজার মিয়াসাহেব ময়দান মসজিদের দক্ষিণ সংলগ্ন শায়িত হযরত শাহ আবদুর রহীম শহীদ। অপরদিকে তাঁর মুরিদগণের মধ্যে অন্যতম হলেন ঢাকা আজিমপুরে শায়িত প্রসিদ্ধ পীর সূফি অলি দরবেশ হযরত মুহাম্মদ দায়েম (রহ.)। হযরত দায়েম (রহ.) মতান্তরে চট্টগ্রামেরই বাসিন্দা। হযরত শাহ আমানত (রহ.)র অত্যধিক উঁচু মাপের মুরিদ। তাঁর জীবনের একটি ঘটনা তরিকত জগতে বহুল প্রচারিত, যা সাধারণ জগতে অনেকের জানা নাও থাকতে পারে।
একবার ভুলক্রমে হযরত দায়েম (রহ.) হতে তাঁর পীর ছাহেবের সামনে কারামত প্রকাশ পেয়ে যায়, এতে নিজের পীর হযরত শাহ আমানত (রহ.) চরম অসন্তুষ্ট হন। তরিকতের যাবতীয় কিছু চলব (সীজ) করে নেন। শত অনুনয় বিনয়ের পরও হযরত শাহ আমানত (রহ.) তাঁর মুরিদ হযরত দায়েম (রহ.) কে ক্ষমা করেননি। এতে অনুন্যপায় হয়ে হযরত দায়েম (রহ.) ঢাকার নবাবপুর লক্ষীবাজারে তাঁর দাদাপীর হযরত আবদুর রহীম শহীদের যেয়ারতে যান। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁর ভাতিজার সাথে আলাপে হযরত দায়েম (রহ.) কে পরামর্শ দেন বানারসে বিশ্বখ্যাত মহান অলী রসুল নোমা (রহ.)র সান্নিধ্য লাভ করতে যেতে।
রসুল নোমা লকব তথা টাইটেলের বিশ্লেষণ হল: নবী পাক (স.) এর ওফাতের পর নবীপ্রেমিকগণের মধ্যে অনেকেই বিভিন্নভাবে বিশেষ অবদানে মূল্যায়নে বিশেষ সম্মানে স্বীকৃত হয়েছেন। তৎমধ্যে রসুল নোমা একটি। রসুল নোমা সরাসরি অর্থ রসুল প্রদর্শক অর্থাৎ রসুলকে প্রদর্শনকারী। যিনি রসুল (স.) কে দেখাতে পারেন।
ভারতবর্ষে পরবর্তীতে আরেকজন রসুল নোমা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে কলকাতা মানিকতলায় শায়িত রয়েছেন। তিনি হলেন হযরত সূফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (রহ.)। তিনিও রসুল নোমা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। হযরত সূফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (রহ.) এর জন্মস্থান চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার মল্লিক সোবহান গ্রামে। বানারস শহরে শায়িত রসুল নোমা (রহ.) কাদেরীয়া তরিকার মহান শেখ। তাঁর মূল নাম হযরত সৈয়দ মুহাম্মদ ওয়ারিশ।
দাদাপীরের ভাতিজার পরামর্শে হযরত দায়েম (রহ.) নদীপথে বানারস রওনা হন। পথিমধ্যে নদীর তীরে পাটনায় যাত্রাবিরতি করেন। বিশ্বখ্যাত মহান অলী হযরত মোনায়েম পাক (রহ.)র মোলাকাত হয়। সম্ভবত ঐ দিন সকালবেলা হযরত মোনায়েম পাক (রহ.) একহাতে আয়না আরেকহাতে কাঁচি দিয়ে দাঁড়ি মোচ কাটছিলেন। তা দেখে হযরত দায়েম (রহ.) হযরত মোনায়েম পাক (রহ.)র প্রতি অশ্রদ্ধা এসে যায়। যেহেতু হযরত দায়েম (রহ.)র নিজ মুখে লম্বা দাঁড়ি ছিল। হযরত মোনায়েম পাক (রহ.) মুহূর্তের মধ্যে আয়নাটি ঘুরিয়ে হযরত দায়েম (রহ.) এর মুখের দিকে ধরেন। তখন হযরত দায়েম (রহ.) দেখতে পান তাঁর মুখে কোন দাঁড়ি নেই। ক্লিন শেভ করা। এতে হযরত দায়েম (রহ.) হযরত মোনায়েম পাক (রহ.)র কারামতে অভিভূত হন। সেখানে থেকে যান একনাগাড়ে বার বছর। অতঃপর মোনায়েম পাক (রহ.)র কড়া নির্দেশে তিনি চট্টগ্রাম ফিরে এসে হযরত শাহ আমানত (রহ.)র সাথে মোলাকাত করলে তিনি তাঁর এ মুরিদকে ক্ষমা করে দেন। খেলাফত দানে ভূষিত করেন। এতে বোঝা যায় হযরত মোনায়েম পাক (রহ.) এবং শাহ আমানত (রহ.) এর মধ্যে হাজার মাইল দূরত্বে হলেও আধ্যাত্মিক যোগসূত্র ছিল।
অতঃপর হযরত শাহ আমানত (রহ.)র নির্দেশে হযরত দায়েম (রহ.) চট্টগ্রাম মহানগরীর লালদীঘি মতান্তরে কর্ণফুলীতে ডুব দেন। যে স্থানে তিনি উঠবেন তথায় তিনি বসতি স্থাপন করে শরীয়ত ও তরিকতের খেদমত করে যাবেন। সাথে সাথে দাম্পত্য জীবন শুরু করবেন। এতে হযরত দায়েম (রহ.) ঢাকা আজিমপুরের এক পুকুরে ভেসে উঠেন। ঐ এলাকা জঙ্গলাকীর্ণ হিংস্র পশুতে ভরপুর ছিল। তিনি তথায় জঙ্গল পরিষ্কার করে বসতি স্থাপন করেন। হযরত দায়েম (রহ.) তথায় শরীয়ত ও তরিকতের খেদমত করতে করতে ইন্তেকাল করেন ১২১৪ হিজরি তথা ১৭৯৩ সালে।
উক্ত বর্ণনা মতান্তরে বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। হযরত দায়েম (রহ.) এর প্রথম সন্তান হযরত শাহ আহমদুল্লাহ তরিকতে পিতার স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ইন্তেকাল করলে তাঁর ছোট ভাই হযরত লকিতুল্লাহ (রহ.) দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর জন্ম: ১৭৯০ ইন্তেকাল: ৩০ জুলাই ১৮৩৬। তরিকতে এ মহান সাধক পুরুষের বিশাল খেদমত রয়েছে। তাঁর ১৫ জন খলিফার তালিকা পাওয়া যায়। তৎমধ্যে হযরত ছালেহ লাহোরী (রহ.) অন্যতম।
অবশ্য হযরত লকিতুল্লাহ (রহ.)র সাথে হযরত নুর মুহাম্মদ নিজামপুরী ও তাঁর খলিফা হযরত সূফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসি (রহ.)র হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এতে হযরত নুর মুহাম্মদ নিজামপুরীকে হযরত লকিতুল্লাহ (রহ.)র মুরিদ বলে বর্ণনা রয়েছে। মূলত হযরত নুর মুহাম্মদ নিজামপুরী (রহ.) হযরত সৈয়দ আহমদ বেরলভী (রহ.)র অন্যতম খলিফা। যিনি বালাকোটের ধর্মীয় যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
আজিমপুর দায়রা শরীফ থেকে প্রকাশিত প্রায় সব গ্রন্থে এ দায়রা শরীফের প্রতিষ্ঠাতা হযরত সূফি দায়েম (রহ.)র পীর হিসেবে চট্টগ্রামের শাহ আমানত (রহ.)র নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যাচ্ছেন। হযরত মোনায়েম পাক (রহ.) হযরত দায়েম (রহ.)র আধ্যাত্মিক মুরব্বি মাত্র।
বস্তুত হযরত শাহ আমানত (রহ.) চট্টগ্রাম শহরে অতি আলোচিত পরিচিত মহান পীর সূফি দরবেশ। সর্বজনের কাছে শ্রদ্ধাভাজন। বর্তমানকালে তরিকতে সূফি দরবেশ জগতে কলুষিত পরিবেশ ব্যাপকতা লাভ করেছে। আশা করব হযরত শাহ আমানত (রহ.)র মাজার কেন্দ্রিক কঠোর শরীয়তের ব্যত্যয় ঘটবেনা।
কর্ণফুলী নদীতে শাহ আমানত সেতু এবং চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর শাহ আমানত নামকরণে হওয়ায় এই মহান সাধক পুরুষ দেশ পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেন।
সাধারণ জনগণের কাছে তিনি একজন সূফি দরবেশ। কারামতের অধিকারী মহান অলী। তিনি যে তরিকত জগতের একজন মহান শেখ পীর তা আজও মনে হয় সর্বমহলে ব্যাপকতা লাভ করেনি।
সাধারণভাবে একজন মানুষ অলী দাবি করা, কারামতের অধিকারী বলা অনেকটা সহজ সাধারণ ব্যাপার।
কিন্তু তরিকতে দাখিল হয়ে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যেতে যেতে কামালিয়ত হাসিল করা, যোগ্যতা হলে নিজের পীর থেকে খেলাফত লাভ করা খুই কষ্ট সাধ্য। আজ থেকে মাত্র ৫০/৬০ বছর বা তারও পূর্বে সাধারণ ব্যাপার ত নয়ই সহজসাধ্য ছিলনা। যা বর্তমানকালে অনেকটা যেনতেন ব্যাপার।
হযরত শাহ আমানত (রহ.) তরিকতে দাখিল হয়ে কঠোর রেয়াজতের মাধ্যমে কামালিয়ত অর্জন করতে সক্ষম হন। ফলে আদালতে চাকরিরত অবস্থায় তাঁর সম্মুখে একজন বিপদগ্রস্ত লোককে আধ্যাত্মিক শক্তি প্রয়োগ করে উপকার করে দিয়েছিলেন। তাঁর মহান খলিফা হযরত দায়েম (রহ.)ও একজন বিশ্বখ্যাত পীর সূফি দরবেশ মহান অলী। আজিমপুর দায়রা শরীফ এর মধ্যমণি তিনিই। তাঁর বংশধরের মধ্যে অনেকেই কামালিয়ত প্রাপ্ত। তৎমধ্যে হযরত লকিতুল্লাহ (রহ.) অন্যতম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, গবেষক।