কাছে থেকে দেখেছি শতাব্দীর সাহসিকাকে

ডেইজী মউদুদ | মঙ্গলবার , ২০ জুন, ২০২৩ at ৫:৪০ পূর্বাহ্ণ

১৯৮৮সাল। দেশজুড়ে চলছে স্বৈরশাসন। এরশাদবিরোধীূ আন্দোলন শুরু। চট্টগ্রাম মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথি হয়ে আসছেন বেগম সুফিয়া কামাল, যিনি মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আমি তখন একেবারে সাংবাদিকতায় নবীন। আমাকে অফিস থেকে এসাইনমেন্ট দেয়া হলো, সাথে আমাদের ফটোগ্রাফার রূপম চক্রবর্তীকে দেয়া হলো ছবি তোলার জন্য। অনুষ্ঠানস্থল ফুলকি মিলনায়তন। আজকের দালান ফুলকি নয়, বেড়ার ঘরের ফুলকিতে নারী পুরুষে ভরা ছিল ছোট্ট মিলনায়তনটি। চট্টগ্রাম মহিলা পরিষদের সভাপতি ছিলেন উমরতুল ফজল। তিনি আমার ননাস। তিনিও আমাকে আমন্ত্রণ জানান অনুষ্ঠানে। আমার নিয়মিত শিফট সকাল বেলা। বিকালের অনুষ্ঠান। অফিস থেকে এসে রেস্ট করার সুযোগ নেই। ছুটলাম ফুলকি অভিমুখে। দেখি মঞ্চ আলোকিত করে বসে আছেন বেগম সুফিয়া কামাল। যার কবিতা মুখস্থ করেই আমি বড় হয়েছি, নারী জাগরণের অগ্রদূত, বেগম রোকেয়ার যোগ্য উত্তরসূরী সাঁঝের মায়ার কবি। আমি নিউজটি নোট করলাম। রূপম ছবি তুললো। নারীদের প্রচণ্ড ভিড়, এই ভিড়ে আমাকে কাছে ডেকে সুফিয়া কামালের সাথে পরিচয় করে দিলেন উমরতুল ফজল আপা। বললেন ফুপু, ডেইজী মউদুদ সাংবাদিক, আমার চাচা ওহীদুল আলমের পুত্রবধূ। তিনি আমায় কাছে টেনে নিলেন পরম মমতায়। বলেন, তুই সাংবাদিক! বাহ, বাহ, ওহীদ ভাইয়ের ছেলের বউ, উনাকে আমার সালাম দিস। নারীদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করিস। আমিতো আনন্দে আত্মহারা। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেত্রী কবি সুফিয়া কামালের পাশে বসেছি, আরেকপাশে আছেন চট্টগ্রামের খ্যাতিমান আরেক নারী নেত্রী উমরতুল ফজল। আমাদের ফটোগ্রাফার রূপম আমাকে দুজনের মাঝখানে বসিয়ে একটি ছবি নিল। আমি নিউজটি লিখে অফিসে দিলাম। পরের দিন রূপম ছবি প্রিণ্ট করে দুই নেত্রীর মাঝখানে আমার ছবিটি নিয়ে এলো। ছবিটি শিশিরদা দেখলেন। তিনি তখন সাহিত্য সম্পাদক পূর্বকোণের। তিনি বলেন, এটিতো একটি ঐতিহাসিক ছবি।এই ছবিটিকে নিয়ে একটি লেখা কাল নিয়ে এসো। আমি ছাপাবো ফিচার পাতায়। আমি পরের দিন একটি ফিচার তৈরি করে নিয়ে আসি। যথারীতি দুএকদিন পরেই দুই নেত্রীর মাঝখানে আমার ছবি সহ লেখাটি ছাপা হলো।আমার লেখক জীবনের সূচনা কিন্তু এভাবেই শুরু হয়েছিল। লেখাটি ছাপা হওয়ার পরেই আমার শশুর বাড়ির নিকট আত্মীয় বিশেষ করে আমার জা (আনোয়ারুল আলমের স্ত্রী) আমাকে বলেন, তুই এতো ভাগ্যবান। আমরা কতো আগে থেকেই সুফিয়া ফুপুকে দেখে আসছি। আর তুই উনার সাথে এই পরিবারে সেদিন এসে ছবি তুলে লেখা ও লিখে ফেললি। আসলে সুফিয়া কামালের সাথে আমার শ্বশুর পরিবার আলম পরিবারের সাথে চমৎকার একটি পারিবারিক সম্পর্ক ছিল । এই পরিবারের প্রায় জনের বিয়েতে উনার বাণী থাকতো। কাজীর দেউড়ির বাসায় উনি এসেই আমার শাশুড়ির নিকানো উঠোন, গাছগাছালি ঘেরা পরিপাটি বাড়ি দেখে বিমোহিত হয়েছিলেন। (আমি আমার শাশুড়ির মুখে গল্প শুনেছি) একারণেই পরিবারের সবাই উনাকে সুফিয়া ফুপু বলেই ডাকতেন।এরপর থেকেই উনার জন্মদিনে পত্রিকায় একটি লেখা দেয়া যেন অনিবার্য হয়ে উঠলো।আর উনার ঢাকার সাঁঝের মায়া’বাড়িতেই কতো বার যে গিয়ে উনার আন্তরিক সান্নিধ্য পেয়েছি, তা বলে শেষ করতে পারবোনা। আমি আমার মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় গেলে উনার বাড়িতে যেতাম, উনার কবিতার মতো বাড়িটি,উনি যে রকম সুন্দর বাড়িটি ও সেরকম নান্দনিক। শেষবার যখন গেলাম, তখন তিনি অসুস্থ, শয্যাশায়ী, ন্যুজ বয়সের ভারে! একটি কি সুন্দর নকশি কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়েছিলেন। বার বার বলছিলেন, আমাদেরকে আপ্যয়ন করার জন্য। আমাদের স্বপ্ন ও কল্পনার জগৎকে তিনি তাঁর লেখনির মধ্য দিয়ে দোলায়িত করেছিলেন। পাঠশালায় পড়াকালে প্রথমেই তাঁর কবিতাগুলো মুখস্থ করে ফেলতাম। এখনো একটি লাইন ও ভুলিনি। আজিকার শিশু, পল্লী স্ম,ৃতি, তাহারেই মনে পড়ে, সাাঁঝের মায়া এসব কবিতা শতাব্দী পরেও ভালো লাগা নিয়ে আসে। আমাদেও যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা/ তোমরা এখন সেই বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা/ আমরা যখন আকাশের তলে উড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/ তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগণ জুড়ি’ কিংবা ‘পল্লী স্মৃতি’ কবিতায় ‘চৈত্র নিশিথে চাঁদিমায় বসি শুনিয়েছি রূপকথা, মনে বাজিয়েছে শুয়ো দুয়ো রাণী দুঃখিনী মায়ের ব্যথা/ তবু ও বলিয়ছি মা’র গলা ধরে মাগো সেই কথা বল/ রাজার ছেলেরে পাষাণ করিতে ডাইনি করে কি ছল? আসলে তাঁর কবিতা গুলো পড়তে পড়তে আমাদের কিশোরী মন পাড়ি দিতো কল্পনার জগতে। সেই যে কল্পনা ও ভাবের জগতের উন্মেষ ঘটেছিল, তা এখনো যেন দীপ্যমান আমাদের মনোজগতে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যেই কঠিন সমাজবলয়ে তিনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন, সেই সংগ্রাম এবং সাহসকে নিজেকে বিকশিত করার জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক এবং পরিপূরক হিসেবেই মনে করেছিলেন। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধকতা না থাকলে সৃজনশীলতা আসেনা। শৃঙ্খল আর দেয়াল ছিল বলেই আমরা তা ভাঙার জন্য লড়াই করেছি। তিনি শিক্ষকতা করেছেনসাংবাদিকতা করেছেন, সাহিত্য চর্চা করেছেন, করেছেন সমাজ বদলের প্রচেষ্টা। একটি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থা তাঁর কাম্য ছিল। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ও তিনি বিরল ভূমিকা রেখেছেন। ৯০ এর গণ সংগ্রাম ও আন্দোলনে তাঁর নেতৃত্বেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশবাসী পতন হয় স্বৈরাচারী সরকারের। ১৯১১ সালের ২০ জুন তাঁর জন্ম হয়। ১৯৯৯ সালের ২০ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন দেশ ও জাতি তাঁকে পরম শ্রদ্ধায় চিরবিদায় জানায়। টিভি আর খবরের কাগজ ডুবে যায় লেখা আর নিউজে। ক্রোড়পত্র বের হয় বিভিন্ন পত্রিকায়। আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁতে শতাব্দীর সাহসিকা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সেদিন আমি নিজেও একটি ফিচার সেদিন লিখেছিলাম। তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক : সাংবাদিক, কবি ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ: নুতন কারিকুলাম অনুযায়ী মূল্যায়ন
পরবর্তী নিবন্ধআমরাই বারবার বিশ্বকে জানান দিতে পারবো, আমরা বাঙালি-বীরের জাতি