সংগীত, আধ্যাত্মিকতা ও শিল্পীর দায়

ইকবাল হায়দার | রবিবার , ১৮ জুন, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

[পৃথিবীর জলময় রূপ আদিম যুগের। স্থলের আবির্ভাব হাল আমলের। সাহিত্যে পদ্যটা প্রাচীন। গদ্য ক্রমে ক্রমে জেগে উঠেছে। জলময় আদিম পৃথিবীর মত পদ্যটাও প্রাচীন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

সংগীত তেমনি মানব সভ্যতার শুরু থেকে মানুষের মনে অনুরণিত, আন্দোলিত ও বিকশিত হয়ে আসছে। সংগীত সর্বোত্তম আর্ট। আট হচ্ছে মানব মনের জাগ্রত স্বপ্নকে হয় রেখায় ও বর্ণে, নয় সুরে ও ছন্দে, নয় ভাষা ও ভাবে আবদ্ধ করার কৌশল ও শক্তি। মানুষের সবটুকু পরিচয় যেমন পাই তার কথা, ভাষা, ব্যবহারের ভঙ্গিতে, শব্দ চয়নে, তার শিক্ষা দীক্ষায়, তার কণ্ঠস্বরের উঠা নামায়, বাক্যে, ছন্দ পতনে, তেমনি সংগীতই মানুষের সুকুমার বৃত্তির পরিচয় তুলে ধরে। প্রকাশ ছাড়া যেমন ব্যক্তিত্ব নেই তেমনি সংগীতই সেই প্রকাশের বাহন।

ভাষা মানুষের সব অনুভূতি বা বোধ প্রকাশের যথেষ্ট নয়। তাই সুর, তাল, নাচ, বাজনা, ছবি আঁকা, মূর্তি গড়া, ইঙ্গিত, অঙ্গভঙ্গি, চিহ্ন, প্রভৃতি প্রয়োগই আর্টের হাজার কসরৎ, যার মধ্যে সংগীত অন্যতম।

কথার সঙ্গে সুর মিলিয়ে যখন আমরা গাই তখন তাকে বলা হয় গীত। সুর মেলানো কথাকে আমরা প্রায় সময় তালে গেঁথে নিই। এই কথা, সুর ও তাল মিলে একটি গান হয়। আর তাল, বাদ্য ও নৃত্য সহকারে পরিবেশিত হয়ে যখন মনের ভাব প্রকাশ করে তখন তাহাকে সংগীত বলে। মানুষ কবে থেকে গান গাইতে শুরু করল এমন প্রশ্নের কোনো সন, তারিখ মাপার জবাব নেই। আদিতে মানুষের মুখে মুখে ফেরত সুর। তারপর শিখল ভাষা। তখন তারা ভাষাকে সুরে বসিয়ে দিল। সেই থেকে শুরু গান।

কথা, সুর ও তাল মিলে হচ্ছে গানের প্রকৃত ভাষা। মানুষের মুখের ভাষাকে, চিরন্তন বেদনাকে, চিরন্তন প্রেমবোধ ফুটিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সুললিত কণ্ঠ। শিল্পীকে গানের বাণী ও সুরের দোলায়িত তরঙ্গের সাথে একাকার হতে হয়। স্রোতমান বাস্তবের পথরেখা ধরে মানুষের মন যেন এক রহস্যময় মরমীয়তার দিকে ধাবিত হয়।

ভাবের প্রকাশ সুরের ভেতর দিয়ে। তাই সুর সংগীতেরই অংশ। সুর ছাড়া সংগীত হয় না। মনের ভাবের প্রকাশ সম্ভব হয় না, সুরের সঙ্গে তাই ভাব যুক্ত। ভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত মনের কথা যখন উদয় হয় তা সুরের মাধ্যমে সংগীত হয়ে প্রকাশিত হয়। তাই সুরের ভেতর দিয়ে কথার এই প্রকাশই হল সংগীত। ভাব যখন আধ্যাত্ম চেতনায় বিভোর থাকে তখন তার প্রকাশ ঘটে আধ্যাত্মিক গানে। সেই গানকে ‘ভাবসঙ্গীত’ বলা যায়। কারণ এর ভাবোদ্রেককারী বাণী ও সুর শ্রোতার মনে এক পবিত্র ভাবের সৃষ্টি করে। এ ধরনের গানের ভাবে গভীরতার প্রাধান্য প্রভূত থাকে। চুটলতার কোন অবকাশ এ গানে নেই।

এই আধ্যাত্মিক গানের মর্মকথা ‘মানুষের মনকে উদ্বেলিত করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই আধ্যাত্মিক গান প্রচলিত। লালন শাহ, পাঞ্জু শাহ যেমন কুষ্টিয়া অঞ্চলের বিখ্যাত আধ্যাত্ম সাধক, হাসন রাজা, শীতলং শাহ, আরকুম শাই, রকিব শাহ যেমন সিলেট অঞ্চলের আধ্যাত্মিক গানের অমর সাধক, ফকির আফতাবউদ্দিন খা, মনোমোহন দত্ত যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের আধ্যাত্মিক গানের রূপকার, তেমনি চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার শরীফকে কেন্দ্র করে মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভব। এ গানের মাধ্যমেই আধ্যাত্ম সাধন চলে। আধ্যাত্ম সাধনার ভেতরেই যে জীবনের নিগূঢ় অর্থ নিহিত গানের মর্মবাণীতে তাই প্রতিধ্বনি প্রতিফলিত। এ গানের সুর ও বাণী আধ্যাত্ম ভাবের এক অপরূপ নিদর্শন। হৃদয়ের কন্দরে এ গানের সুর দোলা জাগায়। এ গানের আবেদন তাই চিরন্তন।

আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে গান বা সুর যে বিপুল ভূমিকা রাখে উল্লেখিত কিছু গানের মধ্যদিয়ে সেই সত্যই প্রতিপাদনের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। মানুষ যেদিন থেকে সুর চিনেছে সেদিন থেকে গুনগুন করে গান গেয়েছে। আর এই সুর থেকেই জন্ম নিয়েছে এক নতুন ভাব। সে ভাব আধ্যাত্মবাদের, আধ্যাত্ম সাধানার রূপ প্রকাশ করে। আধ্যাত্ম গান মনকে পূতপবিত্র করে হিংসাদ্বেষ ভুলিয়ে দিয়ে অনাবিল শান্তির বাতা জাগিয়ে দেয়। দুঃখবিষাদ থেকে মুক্তিলাভের পদ প্রদর্শন করে।

স্বকীয়ত্ব প্রকাশের ভেতর। সংগীতের মাধ্যমে স্বকীয়ত্বের বিশিষ্টতা পাই। প্রকাশ সংগীতের মাধমে যতটা ততটা আর কিছুতেই নয়। মানুষের চলাফেরা, উঠা বসা, ক্রিয়া কর্ম, চিন্তাভাবনায় যেমন ভঙ্গি এনে দেয় এই স্বকীয়তা তেমনি আচারব্যবহার, চালচলন, পোশাকআশাক, মুখের ভঙ্গি ও চোখের চাহনি, অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে স্বকীয়তা ধরা পড়ে, সংগীতও তাই।

সুরের কারুকাজ হবে কণ্ঠশীলতায়। প্রক্ষেপণ রীতি, অভিক্ষেপণ রীতি, বাইলক্ষণ প্রক্রিয়া, উদগ্রভাগের কৌশল, প্রক্ষেপণ, ছাঁদ, আদল, নিহিত সুর সত্যের প্রক্ষেপণ, অন্ত:প্রবেশন, কণ্ঠে লাগাতে হয় সুর কুহকিনী যা মানুষকে মোহিত করে। মরমী সমবেদনা পূর্ণ নিখিলের যাবতীয় মাধুরী কণ্ঠে ধারণা করতে হয়। লোকজ ভাবাদর্শ, ছাঁচ, ঠাট, শিল্পমূল্য, রূপান্তরনিয়তা, ধরণ ধারণ এবং শ্রেণি করণ।

প্রতেকটি মানুষ যদি তার ভাষার ধ্বনিগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়, কোন্‌ ধ্বনি কোথা থেকে উচ্চারিত হয় সে সম্পর্কে যদি তার জ্ঞান থাকে, তাহলে নিজের সন্তান সন্ততীর শব্দ ও উচ্চারণের দোষ ত্রুটি যে সে শুধু সরিয়ে দিতে পারে তা নয় নিজের এবং অপরের শব্দোচ্চারণে প্রয়োজনমত ধ্বনি তরঙ্গের সৃষ্টি করতে পারে। তেমনি সংগীতে কণ্ঠস্বরের উত্থান পতনকে প্রয়োজনমত সংকোচিত ও প্রসারিত করে পরিবেশনের মাধ্যমে মধু ছড়িয়ে দেয়া যায় এবং নিজেকে সুন্দর করে সবার সামনে প্রতিভাত করা যায়। যার মাধ্যমে সমগ্র স্বত্তা ও ব্যক্তিত্ব সাড়া দিতে পারে সুরে, ছন্দে, তালে, লয়ে মানুষের মনে।

মঞ্চে বা প্রচার মাধ্যমে একজন শিল্পী যা ইচ্ছে করতে পারে না। প্রকৃত শিল্পীকে অবশ্যই চলন, বলন, রুচি, পোশাক, কণ্ঠ, উপস্থাপনা, উচ্চারণ, সুর, তাল, ভঙ্গি, এ সকল বিষয়ে সজাগ থাকতে হয়। একজন শিল্পী শ্রোতাদর্শক তথা দেশের প্রতি দায়বদ্ধ। দেশেবিদেশে একজন শিল্পী দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

একজন শিল্পীকে অবশ্যই নিম্নোক্ত বিষয়াবলী সতর্কতার সাথে অনুসরণ করতে হবে:

দাঁতে দাঁত চেপে গান গাইতে নাই। গাইতে চিৎকার করা নিষেধ। য়্যা য়্যা করা ঠিক না। নার্ভাস হওয়া বা গাইতে ভয় পাওয়া দোষ। ঘাবড়ে যাওয়া যাবে না। অনাবশ্যক কণ্ঠ কাঁপাতে নেই। ভয়াভহ ভাবে হা করে গাইতে নেই। অনাবশ্যক শ্রুতির প্রয়োগ করতে নেই। কাকের মত কর্কশ কণ্ঠ নিয়ে গান গাওয়া উচিত নয়। বেতালা গাওয়া শ্রেষ্ঠ দোষ। ঘাড় বাঁকিয়ে বা অস্বাভাবিক উঁচু করে গাওয়া অনুচিত। বিশ্রী মুখভঙ্গি করা ঠিক নয়। গলা বা মুখের শিরা ফুলিয়ে গাওয়া অন্যতম দোষ। গান গাইতে হাত পা নাড়া ঠিক নয়। চোখ বন্ধ করে গান গাওয়া নিষেধ। নিরসভাবে গান গাওয়া শিল্পীর গুণ নয়। শুদ্ধ উচ্চারণ বা শব্দের শুদ্ধ উচ্চারণ অবশ্যই হতে হবে। শব্দ বাণী স্পষ্টভাবে বলতে হবে। বেসুরে গাওয়া মোটেও ঠিক নয়। এলোমেলোভাবে গান গাওয়া উচিত নয়। মনোযোগ দিয়ে গান গাইতে হয়। নাকি সুরে গান গাওয়া কখনো কোনো শিল্পীর গুণ নয়। স্বাধীন উন্মুক্ত কণ্ঠে অবশ্যই গান গাইতে হবে। গান গাইতে পরিশ্রান্ত হতে নেই।

পৃথিবীর প্রতিটি সুন্দর ধ্বনিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা থেকেই সংগীতের শুরু। প্রকৃতির বিবিধ ধ্বনি, মানুষের হাসি কান্নার সুর, পশুপাখির ধ্বনি থেকে সংগীতের উৎপত্তি। সমুদ্রের গর্জন, বাতাসের মর্মর, নদীর কল কল, ঝর্ণার চলমান, বৃষ্টির রিম ঝিম শব্দের মধ্যে আছে সংগীতের সুর ঝংকার। মানুষের ভয়, দুঃখ, হর্ষ, ক্রোধ, ভালবাসা, ভাবাবেগ ও আকাঙ্ক্ষা থেকে সংগীতের উৎপত্তি। আবার অর্থবোধক, সুন্দর শব্দ, ভাব ও ছন্দের গাথুনীর সংগীত এক ভাবজগতে নিয়ে যায় মানুষকে। তারই নান্দনিক প্রকাশ করা থেকে শিল্পীর দায় সৃষ্টি।

লেখক : সংগীত শিল্পী, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তান : ভয়ংকর গন্তব্যে মিলিত অভিযাত্রা